সাম্য কি আর ফিরবে না
গৌতম বুদ্ধ সাক্যসিংহ যেমনি বৈশাখী পূর্ণিমা রাতে শিষ্য আনন্দকে সঙ্গী করে নিরঞ্জনা নদীতীরের বোধিদ্রুম পরিত্যাগ করে উরুবেলা গ্রাম ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি সাম্যও এক দিন নিখোঁজ হয়ে যায়। গৌতম যেমনি রাজকন্যা রূপসী যৌবনবতী সুজাতার নিজ হাতে রান্না করা অমৃততুল্য পায়সান্ন ভক্ষণ করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, সাম্যের বেলায় এমনটা ঘটেছিল কি না তা কারও জানার কথা নয়। হতে পারে জনশ্রুতি কিংবা গুজব, সাম্যকে আচমকাই দেখা গেছে ক্ষণ মুহূর্তের জন্য আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি কিংবা স্বাধীনতা ঘোষণার সৌধ লিবার্টি হলের পাদদেশে। গুজবের হাত-পা-চোখ-কান না থাকলেও আছে দুরন্ত পাখা। তাই উড়তে পারে হৃদয়-মন-স্মৃতির চেয়েও দ্রুতগতিতে। তাই রটে যায় সাম্যকে বিদেশি পর্যটকরা দেখতে পেয়েছে রাশিয়ার মস্কোর মিউজিয়ামে মমি হয়ে শুয়ে থাকা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের কাচের শবাধারে। হঠাৎ এমনও শোনা গেল ব্রিটেনে কার্ল মার্কসের সমাধির পাশে সাম্য দাঁড়িয়ে ছিল ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। আসলে সবই কল্পকথার গল্পের গোলকধাঁধা। আসল সত্যটি হচ্ছে সাম্য নিখোঁজ হয়ে গেছে।
অথচ কেউ প্রশ্ন করে না, আদৌ সাম্য নামের কারও অস্তিত্ব কি বাংলাদেশ কিংবা সাব-কন্টিনেন্টে ছিল? অবশ্যই ছিল সাম্যের আকাক্সক্ষা এবং আছেও। সাম্য কোনো কিশোর-বালকের নাম নয়। সাম্য হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক একটি স্বপ্ন, একটি মানবকল্যাণমূলক রাজনৈতিক আদর্শ। এর যাত্রাপথ ফুলে ফুলে ঢাকা নয়, বরং কষ্টসাধ্য দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম এবং রক্তাক্ত। এ পথ রক্ত চায়, আত্মবলিদান চায়। মৃত্যু সেখানে আতঙ্কের বিষয় নয়, বরং প্রেরণার। বাংলাদেশ আত্মবলিদানের দেশ, রক্তদানের দেশ। এ রক্তদান হাসপাতালের রোগীর জন্য রক্তদান শিবির নয়। এ রক্ত সংগ্রামের রক্ত, মৃত্যুপণ লড়াইয়ের রক্ত। রাজনৈতিক মুক্তির জন্য রক্ত। কিন্তু নির্মম সত্যটি হচ্ছে বঙ্গ-ভারত উপমহাদেশে সাম্যের সংগ্রাম আজও পরাহত। তাই অনার্জিত। বাঙালি পাঠক, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী পাঠক অতি আগ্রহে রাত শেষ করে দিয়েছে বিপ্লবী চেগুয়েভারার রোমাঞ্চকর জীবনাখ্যান পাঠ করে। উত্তেজিত হয়েছে, শিহরণ জাগিয়েছে রক্তে, কিন্তু পারেনি চে হতে। পারেনি চে-এর মতো ফিদেল কাস্ত্রোর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে কিউবা ছেড়ে বলিভিয়ায় মৃত্যুর গুহায় পা বাড়াতে। তরুণরা, এদের সঙ্গে আমরাও কল্প চোখে দেখেছি বলিভিয়ার পাহাড়ি দুর্গম জঙ্গলেঘেরা গ্রাম্য স্কুলের (বিপ্লবীদের তৈরি) বেঞ্চিতে সটান পড়ে আছে চে-এর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ।