ফিরে দেখা আমার শিক্ষকতার উনপঞ্চাশ বছর
দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা আর উচ্চ শিক্ষা প্রশাসনে কেটে গেল ৪৯ বছর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে একজন প্রভাষক হিসেবে ৪৫০ টাকা বেতনে যোগ দিয়েছিলাম ১৯৭৩ সালের ৬ আগস্ট। তার সঙ্গে রেশনে ১৫ দিনে দুই কেজি গম আর আধাকেজি চিনি। বাঙালির জীবনে ৪৯ বছর দীর্ঘ সময়। ঘটনাবহুল এই দীর্ঘ সময় যে কর্মব্যস্ত থাকতে পেরেছি তার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ, আর কৃতজ্ঞ মা-বাবার কাছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া একজন মানুষের পক্ষে এই দীর্ঘ সময়ে যা অর্জন করতে পেরেছি তার বেশি কিছু চাওয়ার আর কিছু নেই। নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করি।
১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের কারণে তার সমাপ্তি ঘটে ১৯৭২ সালে। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর কী করব তা কখনো চিন্তা করিনি। পরীক্ষার পর ফিরে গিয়েছিলাম নিজ শহর চট্টগ্রামে। পাড়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজলের বাসভবন। তাঁর দুই ছেলে আবুল মনসুর ও আবুল মোমেন আমার ছোটবেলার বন্ধু। তাঁদের বাসা ‘সাহিত্য নিকেতনে’ প্রায় প্রতিদিনই যাই। একদিন আবুল ফজল সাহেব জানতে চাইলেন আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে কি না। জানালাম, হয়েছে এবং আমি প্রথম হয়েছি। তিনি বললেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রয়োজন। আমি যেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একাধিক শিক্ষক চাইছিলেন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই। কিন্তু জানি না কেন তাতে মন সায় দেয়নি। ভাগ্যের পরিহাস, ২০০১ সাল থেকে আমি ঢাকার বাসিন্দা, হতে পারে তা অস্থায়ী।
যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির দরখাস্ত জমা দিলাম। ইন্টারভিউয়ের ডাক পড়ল সম্ভবত জুলাই মাসের প্রথম দিকে। বোর্ডে ছিলেন আমার দুই শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ শামসুজ্জোহা (বিভাগীয় প্রধান) আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হাবিবুল্লাহ। ইন্টারভিউ তেমন কিছু না। বোর্ডের সবাই আমাকে চেনেন। ৫ আগস্ট যোগ দেওয়ার চিঠি এলো। পরদিন যোগ দিলাম। আমার বেতনের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বৃত্তি পেতাম বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনটা ছিল নানা দিক দিয়ে ঘটনাবহুল। পরিচিত হয়েছিলাম শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে। কখনো কোনো নির্বাচনে হারিনি। শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম বলে কখনো বিনা কারণে ক্লাস না নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের সম্মানবোধ ছিল প্রশ্নাতীত। পরের দিকে তা কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। ছাত্র সংঘর্ষ ঘটত মাঝেমধ্যে। তা থামাতে এগিয়ে আসতেন শিক্ষকরা। এমন ঘটনা অনেক। শুরু থেকেই আমাকে পড়াতে হতো নতুন নতুন বিষয়, যার তেমন বইপত্র পাওয়া যেত না। তখন ইন্টারনেট বিশ্বের কাছে অজনা। ভরসা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যকেন্দ্র আর ব্রিটিশ কাউন্সিল। সেখান থেকে পড়ানোর নোট তৈরি করে আনতাম। আমার প্রথম ক্লাসে ছাত্র ছিল মাত্র ২০ জন। ক্লাস হতো বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ভবনে। পরে তা কলাভবনে স্থানান্তর করা হয়। আমি উপাচার্য থাকাকালীন বর্তমান বাণিজ্য অনুষদ ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবন নির্মাণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন প্রমোশন বলে কোনো কিছু ছিল না। শূন্য পদ না থাকলে ওপরে ওঠার পথ বন্ধ। এই কারণে অনেক প্রতিভাবান শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এখন তো এসবের কোনো বালাই নেই। সময় হলেই উচ্চ পদে পদায়ন।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় বলে (১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত) অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক প্রথিতযশা শিক্ষক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এসেছিলেন। কেউ কেউ এসেছিলেন কলেজ থেকে। তাঁদের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এখলাস উদ্দিন আহমদ, বাংলার অধ্যাপক আলী আহসান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, অধ্যাপক মাহমুদ শাহ কোরেশী, ইতিহাসের অধ্যাপক আবদুল করিম, অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন, অধ্যাপক রফিউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক মঈনুদ্দিন আহমদ খান, বাণিজ্য বিভাগে অধ্যাপক আলী ইমদাদ খান, অধ্যাপক সৈয়দ শামসুজ্জোহা, অর্থনীতির অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ আত্হার, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, রাজনীতিবিজ্ঞানে আর আই চৌধুরী, সমাজবিজ্ঞানে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, অধ্যাপক অনুপম সেন, চারুকলায় শিল্পী রশিদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নাট্যব্যক্তিত্বসহ আরো অনেকে ছিলেন, যাঁদের নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। সেটি ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শিক্ষকতা
- বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক