১৪ দলের ঘুমিয়ে পড়া ও জেগে ওঠা
শনিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল 'আগামী নির্বাচন ঘিরে আবারও সক্রিয় হচ্ছে'। শুধু তাই নয়; তারা 'বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে রাজপথ দখল নিতে' ধারাবাহিক কর্মসূচিও নিতে যাচ্ছে। খবরটি আর কার কাছে কেমন মনে হয়েছে, জানি না; তবে আমাকে বেশ কৌতূহলী করেছে। তাহলে কি এতদিন ১৪ দল 'ঘুমন্ত' ছিল? না হলে 'সক্রিয়' হওয়ার কথা বলা হবে কেন?
আসলে কৌতূহলটা এখানেও নয়। অন্তত ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত আমরা ১৪ দলকে বেশ সক্রিয় দেখেছি। তখন অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই আওয়ামী লীগের গত প্রায় চার দশক ধরে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ১৪ দলেরই প্রতিষ্ঠাকালীন অন্যতম শরিক ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলে, যা অন্তত ওই নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত শাসক মহলে কিছুটা হলেও কাঁপন ধরিয়েছিল। সম্ভবত সেটা আঁচ করেই আওয়ামী লীগ তখন শুধু ১৪ দলকেই সক্রিয় করেনি; এর আগের নির্বাচনে অর্থাৎ ২০১৪ সালে যে মহাজোটকে হিমাগারে পাঠিয়ে এর দ্বিতীয় প্রধান শরিক এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসিয়েছিল; সেই মহাজোটকেও পুনর্জীবন দান করেছিল।
আবার নির্বাচনের পর আমরা দেখেছি, শাসক দল শুধু যে জাতীয় পার্টিকে আবারও সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের ক্ষমতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছে, তা নয়; ১৪ দলের অন্য শরিকদেরও সোজা 'নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে' বিরোধীদলীয় রাজনীতি করতে বলে দিয়েছে। এতে তখন ১৪ দলের কোনো কোনো শরিক দলের নেতাদের হতাশার পাশাপাশি শাসক দলের উদ্দেশে উষ্ফ্মাও প্রকাশ করতে দেখেছি।
বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচনের পরের দিন থেকেই বলে আসছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট দিনে নয়, রাতে হয়েছে। অনেকটা তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ১৪ দলের একজন নেতা তাঁর এক ভাষণে বলেই ফেললেন, তিনি নিজে সাক্ষী- জনগণ ওই নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। এ নিয়ে তখন শুধু শাসক দলে নয়, জোটসঙ্গীদের মাঝেও বেশ অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল।
শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন জাসদের মতো দল তো অনেকটা রাগে-ক্ষোভে ১৪ দলই ছেড়ে গেল। যদিও দলটির অন্যতম শীর্ষ নেতা মইনউদ্দীন খান বাদল জটিল রোগে ভুগে ২০১৯ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত, অন্তত ২০০৯ সাল থেকে শাসক দলকে সংসদের ভেতরে-বাইরে বিপুল সার্ভিস দিয়েছেন। একটা কথা অনেক আওয়ামী লীগারকেও বলতে শুনেছি- মইনউদ্দীন খান বাদল যেভাবে তাঁর বক্তৃতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতেন এবং বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপিকে কুপোকাত করতেন, সেভাবে তাঁদের নেতারাও বলতে পারেন না। তাছাড়া পদ-পদবি নিয়ে বিবাদের কারণে হাসানুল হক ইনুর জাসদ থেকে বেরিয়ে আসার পর জাসদের (ইনু) দু'জন সাংসদ থাকলেও বাংলাদেশ জাসদের একমাত্র সাংসদ ছিলেন বাদল। তাঁর মৃত্যুতে সংসদে দলটি শূন্য হয়ে গেল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, যিনি ১৪ দলেরও প্রধান নেতা; ১৪ দলকে বিরোধী দলে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন- বাদলের ফাঁকা আসনে নিজ দলের এক স্থানীয় নেতাকে মনোনয়ন দিয়ে দেন।
যা হোক, আসল কৌতূহল, যে জোটকে ১৪ দলের নেতারা বিশেষ করে তার বাম শরিকরা সবসময় একটা আদর্শিক জোট বলে দাবি করে থাকেন এবং এর প্রমাণ হিসেবে তাঁরা ২৩ দফা কর্মসূচির কথাও স্মরণ করিয়ে দেন; সেই আদর্শিক জোট আবার ঘুমিয়ে পড়ে কীভাবে? আমাদের মনে আছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর জনসভায় নৃশংস গ্রেনেড হামলার পর দলটি বিশেষ করে বাম দলগুলোকে সঙ্গে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বাম দলগুলো তখন গণফোরামসহ ১১ দলীয় জোট নিয়ে দেশের আওয়ামী লীগ-বিএনপিকেন্দ্রিক দ্বিদলীয় ধারার বিপরীতে একটা বিকল্প শক্তি নির্মাণের চেষ্টা করছিল। তখন ক্ষমতাসীন বিএনপির প্রধান মিত্র ছিল '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত, আর গ্রেনেড হামলাটি ছিল পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট একটি জঙ্গি হামলা। তাই ১১ দলের দু-একটা দল বাদে গণফোরাম, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ সবাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে একমত পোষণ করে তাদের ভাষায় জঙ্গিবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে ১৪ দলীয় জোট গঠন করে। প্রশ্ন হলো, জঙ্গিবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ষড়যন্ত্র কি মাঝখানে বন্ধ ছিল যে, ১৪ দলকেই ঘুমিয়ে পড়তে হলো?
প্রশ্নের জবাবটা ১৪ দলভুক্ত বামদেরকেই দিতে হবে। কারণ এ জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ তার এজেন্ডা অনুযায়ী নড়াচড়া করবে কিংবা সময়ের প্রয়োজন অনুসারে জোটসঙ্গী নির্বাচন করবে- এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। জোটে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এবং নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরীকত ফেডারেশনের মতো আরও যে ক'টি দল আছে, তারাও এক ধরনের মৌসুমি দল। অর্থাৎ নির্বাচন এলেই কেবল তাদের সক্রিয়তা দেখা যায়। অতএব, তাদেরও দায় নেই সারাবছর জোটকে সক্রিয় রাখার। ১১ দলীয় বাম বন্ধুদের ছেড়ে ১৪ দলীয় জোট গঠনের সময় জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারা বলেছিলেন, জাতির আশু বিপদ জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে পরাস্ত করার জন্য নতুন এ জোট দরকার। তাই ওই বিপদ কতটুকু কমলো, তার ব্যাখ্যা তাদেরই দিতে হবে।