অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ
বাংলাদেশ রেলওয়ে হচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও রাষ্ট্রপরিচালিত সংস্থা। ১৯৯০ সাল থেকে সংস্থাটি রেল মন্ত্রণালয়ের অধীন নিজ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে ২৫ হাজার ৮৩ জন নিয়মিত কর্মচারীসহ আড়াই হাজারের অধিক কিমি. রুট নিয়ে দেশে রেল চলাচল করছে। মূলত এ রেলই দেশের পরিবহণব্যবস্থার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। কেননা অধিকাংশ যাত্রীর কাছে রেল যাতায়াত অনেকটা নিরাপদ ও আরামদায়ক। তাই অধিকাংশ যাত্রী যাতায়াতের মাধ্যম হিসাবে রেলকেই অধিক পছন্দ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রেল কর্তৃপক্ষ রেলের সেবার মান ও যাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করতে সক্ষম হচ্ছে? যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে শত শত অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, একের পর এক রেল দুর্ঘটনা, রেলে দুর্নীতি, টিকিট কালোবাজারি ও নানাবিধ অনিয়মের কারণে স্বাভাবিকভাবেই যাত্রীদের মনে রেল নিয়ে বর্তমানে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে রেলের সার্বিক অগ্রগতি যেমন ব্যাহত হচ্ছে, ঠিক তেমনই রেলের প্রতি যাত্রীদের আস্থা নষ্ট হচ্ছে, যা কাম্য নয়। এ অবস্থার দ্রুত আশু সমাধান হওয়া জরুরি।
প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেশে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে যেসব তথ্য সামনে আসে, তা অত্যন্ত ভীতিকর। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সারা দেশে বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৪১২টি। এর মধ্যে ৯৪৬টিতে, অর্থাৎ ৬৭ শতাংশে কোনো গেট নেই! এমনকি নেই যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মীও। নেই সংকেত বাতি। এছাড়া রেললাইনের ওপর দিয়ে স্থানীয় লোকজন অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজার, রাস্তা নির্মাণসহ বিভিন্ন সংস্থার কাজে সমন্বয়হীনতার কারণে হিসাবের বাইরেও আরও বিপুলসংখ্যক মরণফাঁদ তৈরি হয়েছে, যা রেলের সার্বিক নিরাপত্তা ও পুরো পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহতার দিকে ঠেলে ছিয়েছে। এমন এক বাস্তবতায় রেলের সার্বিক সেবার মান বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করি।
তথ্যমতে, ২০০৪-২০০৫ সালের শেষে বাংলাদেশে ১ হাজার ৬১০টি লেভেল ক্রসিং ছিল। ২০২০ সালের হিসাবে দেশে মোট লেভেল ক্রসিং ২ হাজার ৮৫৬টি, যার মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অনুমোদনহীন। ক্রসিংগুলোর (বৈধ-অবৈধ) প্রায় ৮৪ শতাংশ অরক্ষিত। পূর্বাঞ্চল রেলে মোট ১ হাজার ৩৭৭টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার মধ্যে ৮১১টি অবৈধ। পশ্চিমাঞ্চলে মোট ১ হাজার ৪৭৯টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার মধ্যে ৫৫০টি অবৈধ। বাংলাদেশ রেলওয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ধারণা করা হয়, দেশে সংঘটিত রেল দুর্ঘটনার ৭২ শতাংশ মানব ত্রুটিজনিত, ২৩ শতাংশ যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত এবং বাকি পাঁচ শতাংশ অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং এবং যানবাহন চালক ও পথচারীদের অসতর্কতার সঙ্গে লেভেল ক্রসিং পারাপারের কারণে ঘটে। মানব ত্রুটিগুলোর মধ্যে রয়েছে লোকোমাস্টার, স্টেশনমাস্টার ও পরিচালকের ত্রুটি বা অবহেলা এবং বেপরোয়াভাবে ট্রেন চালানো। যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটে লোকোমোটিভের ত্রুটি, ত্রুটিযুক্ত ট্র্যাক ও সিগন্যাল পদ্ধতির কারণে। ২০০৮-২০১৯ সালে লেভেল ক্রসিংগুলোয় ৩১০টি দুর্ঘটনায় ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৯টি দুর্ঘটনায় ১৩ জন মারা গেছে। যদিও ১৯৭২ সালে এক রেল দুর্ঘটনায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৭২ সালের ৪ জুন যশোর জেলায় স্টেশনে দাঁড়ানো একটি মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে খুলনা থেকে আসা একটি জনাকীর্ণ যাত্রীবাহী ট্রেনের সংঘর্ষ ঘটে। এতে ৭৬ জন নিহত ও ৫০০ জন আহত হয়েছিল। এর সাড়ে ছয় বছর পর, ১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি চুয়াডাঙ্গায় একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে উলটে যায়; এতে ৭০ জন নিহত ও ৩০০ জন আহত হন। এরপর ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি গাজীপুর জেলায় একটি মেইল ট্রেনের সঙ্গে একটি এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষ্যে উভয় ট্রেনে ২ হাজারের অধিক যাত্রী ছিল, যাদের অনেকেই ছাদে বা কোচের মধ্যবর্তী স্থানে ভ্রমণ করছিল। এ দুর্ঘটনায় অন্তত ১৭০ জন নিহত ও ৪০০ জন আহত হন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ৪২ জন এবং গত ১০ বছরে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কেবল যে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়েই দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটছে তা নয়, বৈধ ক্রসিংগুলোতেও হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা। এমন এক বাস্তবতায় ত্রুটিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলো যত দ্রুত সম্ভব সুরক্ষিত করতে হবে। বছরের পর বছর এগুলো অরক্ষিত থাকলেও দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ পরস্পরের ওপর দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে, যা কাম্য নয়।