ঈদুল আজহার অর্থনীতি
হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর নিজের প্রাণাধিক পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর রাহে কোরবানির সর্বোচ্চ ত্যাগ শিকারের স্মরণে পবিত্র ঈদুল আজহার উৎসব পালিত হয় মুসলিম বিশ্বে। এই উৎসবকে ভারতীয় উপমহাদেশে ‘বক্রি ঈদ’ এবং ব্যবহারিক অর্থে ‘কোরবানির ঈদ’ও বলা হয়। বক্রি ঈদ বলার কারণ এই ঈদে খাশি কোরবানি করা হয় আবার ‘বাকারা’ বা গরু কোরবানির ঈদ হিসেবেও ভাবা হয়। আরবি পরিভাষায় এই ঈদকে বলা হয় ‘ঈদুল আজহা’ বা আত্মত্যাগ বা উৎসর্গের উৎসব। সুতরাং ঈদুল আজহার তাৎপর্যগত বৈশিষ্ট্য বিচারে এই উৎসব পালনে গরু বা পালিত পশু খোদার সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ বা কোরবানি করা। আর এই কোরবানির আগে পবিত্র হজ পালনের প্রসঙ্গটিও স্বতঃসিদ্ধভাবে এ উৎসবের সঙ্গে এসে সংযুক্ত হয়। ঈদুল আজহার এই উৎসব হজ পালন ও পশু কোরবানিসূত্রে সমাজ ও অর্থনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যবাহী প্রভাব ও কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
এবারের এই ঈদুল আজহা উদযাপনের উৎসবে স্বপ্নের সেতু পদ্মা এক নতুন উন্মাদনা ও মাত্রা যোগ করবে নিশ্চয়ই। ঈদের অর্থনীতিতে যাতায়াত বা পরিবহন খাতের একটা বড় ভূমিকা থাকে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার জনপদে বাস করে যে প্রায় তিন কোটি মানুষ, এতদিন তাদের ঈদযাত্রায় বাধা-বিড়ম্বনার কারণ ছিল পদ্মা। এবার সেই পদ্মা মাত্র ৭/৮ মিনিটে শুধু পার হওয়া যাবে তাই নয়, পদ্মা সেতু ইতিমধ্যে দর্শনীয় স্থাপনাতে পরিণত হয়েছে।
গতবারের মতো এবারও বাংলাদেশে ঈদুল আজহায় প্রায় বাদ সাধার হুকুম জারি করার প্রয়াস পাচ্ছে মাইক্রোসকোপিক ভাইরাস কভিড-১৯। বিশ্বব্যাপী করোনার কমবেশি বিস্তার ও অবস্থানের কারণে প্রায় প্রতিটি অর্থনীতিতে ব্যাপক দুর্যোগ, দুরবস্থা ও দুর্ভোগ নেমে এসেছে। দ্রব্যমূল্য, জ¦ালানি ও খাদ্য সংকটের আভাস দিচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে করোনা ও যুদ্ধের অভিঘাতটি ব্যাপক, কেননা এ দেশের সিংহভাগ মানুষ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের বলয়ে, এখানে উচ্চবিত্তের সঙ্গে মধ্য ও নিম্নবিত্তের আনুভূমিক ও উলম্ব সম্পর্কের দূরত্ব সাধারণ সমীকরণ ও সূচকের ধারেকাছে নয়। বর্তমানে করোনার চতুর্থ ধাক্কার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। আগের দুই ধাক্কায় গ্রামীণ অর্থনীতির সরাসরি তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি, কিন্তু সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় নয়া নামে বাংলাদেশের প্রায় সমুদয় গ্রামাঞ্চলে করোনার প্রকোপ ও প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ আকারে প্রসারিত হতে পারে। স্মরণকালের বড় বন্যায় আসন্ন ঈদুল আজহার উৎসবে কর্মযোগ উপলক্ষে আয় উপার্জনের জন্য মুখিয়ে থাকা দেশের অধিকাংশ মানুষকে ব্যর্থ মনোরথের পথে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ঈদুল আজহার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হজব্রত পালন ও কোরবানি উপলক্ষে জেগে ওঠার সুযোগ হাতছাড়া হতে চলেছে। অথচ এই উৎসব উপলক্ষেই আয়-ব্যয় বণ্টন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৈষম্য দূরীকরণের, সম্পদ ভাগাভাগির এবং মধ্য ও নিম্নবিত্তের জীবিকা নির্বাহের একটা সুযোগ বা উপায় উপস্থিত হতে পারত। সে নিরিখে বিগত ছাব্বিশ মাসে করোনার সঙ্গে সংগ্রামে বাংলাদেশের অর্থনীতি জেগে ওঠার মতো ডজন খানেক উৎসব আয়োজন পালন হাতছাড়া হয়েছে, অর্থাৎ গত বছর এই একই সময়ে আগের রাউন্ডে হাতছাড়া হওয়ার পর সবাই পরের বার সব ঠিক হওয়ার যে আশায় বুক বেঁধেছিল এবং এবারের এই উৎসব আয়োজনের জন্য বেশ কিছু বাড়তি বিনিয়োগেও নেমেছিল সবই মন্দ বিনিয়োগে পরিণত হতে চলেছে। এটি আঘাতের ওপর আঘাত হিসেবে দেখা দিতে পারে। এর ফলে স্বাস্থ্যবিধি পালনে উপেক্ষার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, যা অবলম্বন করা অতীব প্রয়োজন। এভাবেই করোনার কবলে এবারের উৎসবের অর্থনীতি।