সমষ্টিগত স্বপ্নের কাছে ফিরে যাওয়া
মানুষের সঙ্গে নদীর অনেক ব্যাপারেই মিল আছে। এর মধ্যে বিশেষ মিল দেখা যায় ভাঙাগড়ায়। নদীর মতোই মানুষ পরিস্থিতির কারণে অনেক কিছুই ভাঙে ও গড়ে। নিজের স্বপ্নের ভাঙাগড়াও সে নিজেই করে এই নিরিখে। স্বপ্ন অবশ্যই অনেক রকম হয়, কিন্তু দুটি বিভাজন বেশ স্পষ্ট। স্বপ্নের একটি ধরন সমষ্টিগত, অপরটি ব্যক্তিগত। এ দুটির মধ্যে আবার বিরোধও বাধে, যা খুবই স্বাভাবিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সবাই মিলে আমরা বড়মাপের সমষ্টিগত স্বপ্ন দেখেছিলাম। তা হলো মুক্তির স্বপ্ন। না, শুধু স্বাধীনতার নয়, অর্থাৎ পরাধীনতার অবসান নয়; সার্বিক মুক্তিরই। মুক্তির এই আকাঙ্ক্ষাটা নতুন নয়। এটি ব্রিটিশ আমলে ছিল। পাকিস্তান আমলে তো অবশ্যই ছিল। কিন্তু স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ হয় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। আমরা স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু মুক্তি কি পেয়েছি?
মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের উল্লেখযোগ্য প্রত্যয় ছিল বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠা। আমরা গত বছর স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করলাম। কিন্তু বিগত ৫০ বছরে আমরা কি পেরেছি মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে দেশ গড়তে? বৈষম্য তো আরও বেড়েছে। বৈষম্য এখন আমাদের মানবিক সমাজ গঠনের প্রত্যয়ের আরও বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ? তাও পূর্ণতা পায়নি। গণতন্ত্র মানে তো শুধু ভোট নয়, যদিও এই ভোট নিয়ে দেশে প্রশ্নের অন্ত নেই। সমাজের স্তরে স্তরে মানুষের অধিকারের পূর্ণতা দেওয়া গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে এখনও শান্তিপ্রিয় মানুষ কীভাবে আক্রান্ত হয়, এর অনেক নজিরই তো ইতোমধ্যে কম সৃষ্টি হয়নি। ধর্মান্ধতা, জঙ্গিদের বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড; কত ক্ষতই তো সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে! এসবই আমাদের স্বপ্নকে আঘাত করে দুঃস্বপ্নের খাদে ফেলেছে বারবার।
এটা তো খুবই স্বাভাবিক ছিল- পুঁজিবাদী বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করবে এবং তা তারা করেছেও। শেষ পর্যন্ত পারল না। সমষ্টিগত স্বপ্নের জয় হলো। ঘটল বাংলাদেশের অভ্যুদয়। কিন্তু স্বাধীন দেশে আমরা কী দেখলাম? দেখলাম, জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে টেনে ধরল পুঁজিবাদ। এই নেতৃত্বের ভেতর পুঁজিবাদী আকাঙ্ক্ষাটাই ছিল। অনেকেই বলেন, সমাজতন্ত্রের কথা বলতে হয়েছে বাধ্য হয়ে; অন্তর থেকে নয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো খুশি হলো এবং তাদের আরও বেশি করে ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের ব্যাপারে ভিন্ন চিন্তায় আগ্রহী করে তুলতে থাকল। সমষ্টিগত স্বপ্নের জয় যেভাবে ঘটেছিল একাত্তরে; স্বাধীনতার পরে তা অনেক ক্ষেত্রেই মুখ থুবড়ে পড়ে। ব্যক্তিগত স্বপ্নের কাছে সমষ্টিগত স্বপ্ন পড়ে হুমকির মুখে। ব্যক্তিগত স্বপ্নের লালন-পালন যা করে এবং করতে পারে তা তো আমরা দেখেছি। ওই স্বপ্নের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সার্বক্ষণিক দৌরাত্ম্য আমাদের বিভিন্ন সময়ে ঠেলে দিয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির দিকে। এখনও এই অপপ্রক্রিয়া যে থেমে নেই, তাও তো অসত্য নয়।