গ্রামে ফিরছে মানুষ, করণীয় কী?
অর্থসংকটে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে মানুষ। কেউ সপরিবারে ছুটছেন গ্রামের দিকে। কেউ বা আবার পরিবারকে বাড়ি রেখে আসছেন। ভাড়াটিয়াদের বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ছে রাজধানী জুড়ে। পিকআপ বা ট্রাকে করে মালামাল ভরে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন এসব পরিবার।
করোনা সংকটে ইতিমধ্যে কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কারও বেতন কমে গেছে, কেউবা ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যে বিপুল পরিমাণ মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছেন, তাদের জন্য এখনই কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে গ্রামে তারা কাজ পেতে পারেন। থিতু হতে পারেন সেখানে। অন্যথায়, গ্রামের সামাজিক শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
রাজধানীর বঙ্গবাজারে কাপড়ের ব্যবসা করে আমিনুল। এখন ব্যবসা নেই বললেই চলে। একটি দোকান ভাড়া দিয়ে কিছু টাকা পেতেন। সেটা পাচ্ছেন না। ঢাকাটাইমসকে আমিনুল বলেন, ‘চাপও দিতে পারছি না, বুঝি তো বেচাকেনা না থাকলে কীভাবে ভাড়া দিবে।‘
আমিনুল পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে শাহবাগে ভাড়া বাসায় থাকেন, যার ভাড়া ২০ হাজার টাকা । তিনি বলেন, সন্তান-পরিবারের খরচসহ পাঁচ মাস ঘরে বসে থেকে সঞ্চিত দুই লাখ টাকা শেষ। এখন গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা চলে যাচ্ছেন। পরিবারকে গ্রামে রেখে আসবেন।
বেসরকারি চাকরিজীবী রফিকুল ইসলামের চাকরি চলে গেছে, তাই রাজধানী ছেড়ে গাজীপুরে তার বাপ-দাদার ভিটায় চলে যাচ্ছেন। বলেন, ‘সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়াবো এই ভেবেই পরিবারকে ঢাকায় রাখা। কিন্তু সেটা আর পারলাম না। দেখি এলকায় গিয়ে একটা কিছু করে সংসার চালাব।’
রাজধানীর হাতিরপুলে একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন রাহেলা বেগম। স্বামী একটি দোকানে আর তিনি নিজে বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। করোনার এই সংকটে চাকরি গেল দুজনেরই। তারা ফিরে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ।
ব্র্যাকের গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী চাকরি হারানো ৩৬ শতাংশ ব্যক্তির বেশির ভাগ অংশই ঢাকার ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে দেশে ভাড়া বাড়িতে থাকেন ১২ দশমিক ২১ শতাংশ পরিবার। তারা যে পরিবেশে বাস করুক না কেন তাদের আয়ের ৫০ ভাগই যায় বাড়ি ভাড়ার খরচ।
করোনার এই মহামারির ছোবলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় বেশ বড় একটা অংশের মানুষ শহরে ভাড়া থাকার সামর্থ্য হারিয়েছে। তাই গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের সংখ্যাটা নেহাত কম হবে না। তাই তাদের দিকে সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্স ফেলো বলেন, ‘যারা গ্রামে চলে যাচ্ছে তারা যেন সেখানে টিকে থাকতে পারে, তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সরকারের পক্ষে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে বেশি দিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো সম্ভব না, তাই কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের চাহিদামতো প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মাছ চাষের প্রশিক্ষণ, গরু পালনের প্রশিক্ষণ, মুরগির খামার, বিভিন্ন সবজি চাষসহ তাদের চাহিদামতো উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
মূলত এখন যারা গ্রামে যাচ্ছে তারা কোনো কাজকর্ম নিয়ে যাচ্ছে না। টিকে থাকার জন্য যাচ্ছে। ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘যেহেতু তাদের আয়ের উপায় কমে গেছে, ফলে বাড়ি ভাড়াসহ শহরে থাকার খরচটা তারা মেনটেইন করতে পারছে না। ফলে যাদের সুযোগ আছে তারা গ্রামে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কেউই সুনিশ্চিত পরিকল্পনা নিয়ে যাচ্ছে না। এখন সরকারকে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে। সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।’
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, এখন সরকারের যেটা করা দরকার সেটা হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। গ্রামে হোক, শহরে হোক ব্যবসা-বাণিজ্য চালু করতে হবে। কর্মসংস্থানের জন্য ব্যবসায়ীদের সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে সেটার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। তিন মাস আগে ঘোষণা দেয়া হলো কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হলো না। গার্মেন্টস সেক্টর ছাড়া অন্য জায়গায়ে প্রণোদনার টাকা এখনো ছাড় হয়নি।
গ্রামে যারা কৃষিসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে তারা যেন তাদের উৎপাদিত পণ্য চাহিদামতো জায়গায় পৌঁছাতে পারে, সরকারকে এর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার তাগিদ দিয়ে ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, গ্রাম থেকে শহরের সাপ্লাই চেইন ভালোভাবে গড়ে তুলতে হবে। যিনি শহর থেকে গ্রামে গেছেন, দেখা যাবে সেখানে কিছু পণ্য কম দামে পাওয়া যায়, সেগুলো তিনি শহরে সাপ্লাই করবেন। এ জন্য পরিবহন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। অর্থাৎ কৃষির সাপ্লাই চেইনটা ঠিক রাখতে হবে। ট্রাক বলি আর বাস বলি যারা পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে আছে তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে। সরকার তাদের স্বাস্থ্যসম্মত চলাফেরা করার ব্যবস্থা করে দিবে।