হৃদয়স্পর্শী ঘটনার সেই তরুণ চিকিৎসক যা করেছিলেন
গল্পটি এক তরুণ চিকিৎসকের, যিনি কর্মরত নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত করোনার উপসর্গ থাকা এক রোগীকে চিকিৎসা দিয়েও বাঁচাতে না পেরে তাঁর হতাশার ছবি ছুঁয়ে গেছে হাজারো মানুষকে। জেনে নেওয়া যাক এই চিকিৎসকের প্রচেষ্টার গল্পটি।
মঙ্গলবার বিকেল থেকে একে একে করোনায় আক্রান্ত দুই ব্যক্তির দুটি বাড়ি ও একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লকডাউন করছিলেন তিনি। পাশাপাশি দিচ্ছিলেন দরকারি ওষুধ। তৃতীয় বাড়িটিতে গিয়ে অন্য এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন নিজাম উদ্দিন। দেখেন, করোনায় আক্রান্ত এক ব্যক্তির প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেনের মাত্রা নেমে এসেছে ৩৫-এ, যা থাকার কথা ৯৫-এর ওপরে। নিজাম উদ্দিন তাৎক্ষণিকভাবে সঙ্গে থাকা অ্যাম্বুলেন্সচালককে দিয়ে তিন কিলোমিটার দূরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অক্সিজেনের সিলিন্ডার আনান। অক্সিজেন দেওয়ার পরও বিশেষ উন্নতি হয় না। তখন সিদ্ধান্ত নেন রবিউল ইসলাম (৫৫) নামের ওই রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার। রাত আটটার দিকে রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসা শুরু হয়। অক্সিজেন তখনো ৭৮-৮০-তে ওঠানামা করছে। এভাবে কেটে যায় কয়েক ঘণ্টা।
দীর্ঘ এই যুদ্ধে তাঁর সঙ্গী বলতে কেবল সহকর্মী জাফরুল আমিন। রোগীর অবস্থা যখন একটু উন্নতির দিকে, ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় ১১টা। এমন সময় খবর আসে হাসপাতালের সামনে একজন রোগী এসেছেন, যিনি সাত দিন ধরে জ্বর, কাশিতে আক্রান্ত।
নিজাম উদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলেন, খবরটি যখন কানে যায়, তখন তিনি এতটাই ক্লান্তÍযে শরীরে আর শক্তি নেই। তবু এগিয়ে যেতেই দেখেন অল্প বয়সের একটা ছেলে তাঁর বাবাকে কোলে নিয়ে ফটকের সামনে বসে সাহায্য প্রার্থনা করছে। বুকটা কেঁপে ওঠে তাঁর। রোগীকে সেখানেই মাটিতে শুইয়ে সিপিআর (প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃদ্যন্ত্র চালুর চেষ্টা) দেওয়া শুরু করেন।
অনেকক্ষণ সিপিআর দেওয়ার পর আর শ্বাস নিতে পারছিলেন না পবন চন্দ্র দাস (৫০) নামের ওই রোগী। একটা সময় খেয়াল করলেন, রোগীর পালস নেই। চোখ দুটো স্থির। ছেলেটি তখন তাঁর বাবার অবস্থা জানতে চায়। তিনি সেই উত্তর দিতে পারেননি। হতাশ হয়ে ফটকের সিঁড়িতে হাত-পা ছেড়ে বসে পড়েন।
২০১৪ সালে ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন নিজাম উদ্দিন। বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আমানতপুর গ্রামে। ৩৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার পর হাতিয়া তাঁর প্রথম কর্মস্থল। অনেকে যেখানে নদী-সাগর পাড়ি দিয়ে দ্বীপে চাকরি করতে ভয় পান, সেখানে নিজাম উদ্দিন সব ভয়কে জয় করে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের করোনা ফোকাল পারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নিজাম উদ্দিন। তাঁর পর্যবেক্ষণমতে, দ্বীপের অনেক লোকের মধ্যেই করোনার উপসর্গ রয়েছে। কিন্তু শত অনুরোধের পরও নমুনা পরীক্ষা করাতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন না।
ওষুধের দোকানদারেরা এখানকার মানুষের বড় চিকিৎসক। যাঁরা হাসপাতালে আসেন, তাঁরা শেষ অবস্থায় আসেন। যেমনটি হয়েছে পবন দাসের ক্ষেত্রে।
প্রায় পাঁচ লাখ জনসংখ্যা-অধ্যুষিত হাতিয়া দ্বীপে এ পর্যন্ত ৩৫৯ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৪৫ জনের ফলাফল এসেছে। তাঁদের মধ্যে ১৫ জন করোনা পজিটিভ। ছয়জন করোনামুক্ত হয়েছেন। করোনা রোগীদের জন্য উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সকে ছয় শয্যার আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছে। উপজেলায় অক্সিজেন সিলিন্ডার ২৩টি। ‘দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে’ ২২ জুন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পায়ের সমস্যা দেখাতে নিজাম উদ্দিনের কক্ষে যান সাজেদ উদ্দিন নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি। তখন বিকেল ৫টা ১৫ মিনিট। হঠাৎ একটি ফোন আসে। ফোনটি ধরে তিনি অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে বলছিলেন, ‘দুপুরের খাবার এখনো খাইনি, খুব ক্ষুধা লাগছে।’ সাজেদ উদ্দিন ফেসবুকে লেখেন, ‘আমি অবাক হই, যে চিকিৎসক আমাদের বলেন বেলা একটার মধ্যে খাবার খেতে, সেখানে তিনি না খেয়ে রোগীর সেবা দিয়ে যাচ্ছেন!’