হ-য-ব-র-ল টেস্ট ক্রিকেটের নেপথ্যে ‘যা’
কলকাতা টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১০৬ রানে অলআউট বাংলাদেশ। ভারতের এক সাংবাদিক উত্তেজিত হয়ে বললেন,- ‘এত বাজে ক্রিকেট তো ওদের খেলতে দেখিনি। নিশ্চয়ই কোনো গণ্ডগোল আছে!’ সত্যিই ভাবার বিষয়, বাংলাদেশের এমন ছন্নছাড়াভাব গত পাঁচ-সাত বছরে দেখা যায়নি। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান শনিবার হঠাৎ জানালেন টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাতারাতি সিদ্ধান্ত বদলে গেছে! ইনজুরি আক্রান্ত ক্রিকেটারদের বদলিও আনা হয়নি। যে কারণে ‘কনকাশন-সাব’ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড। সবকিছু মিলিয়ে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা। টাইগার ক্রিকেটকে যেন টেনে নিচ্ছে ব্ল্যাকহোল (কৃষ্ণ গহ্বর)। বোঝা যাচ্ছে বিসিবি, ক্রিকেটার, টিম ম্যানেজম্যান্ট, নির্বাচকদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। অন্যদিকে মাঠে নয়া টেস্ট অধিনায়ককে মনে হয়েছে নিঃসঙ্গ। তার নেতৃত্বে যেন কোন প্রভাবই নেই। সব নিয়ন্ত্রণ করছেন প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। এমনকি বিকল্প ক্রিকেটার নিতে চায়নি ডমিঙ্গো। যদিও দৈনিক মানবজমিনকে দলের কাছ পূর্ণ সমর্থন পাওয়ার কথা জানান অধিনায়ক মুমিনুল হক সৌরভ। তিনি বলেন, ‘আমি আমার দলের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন পেয়েছি। মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ ভাই সবাই আমাকে দারুণ সাহায্য করেছে। তবে এটি সত্যি যে আমরা দল হিসেবে খেলতে পারিনি। সবকিছু নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে সময় দিতে হবে।’দলের এমন অবস্থা একদিনে হয়নি। একটু পেছনে ফিরে গেলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ভারত সফরের আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নেমে এসেছিল বড় দুর্যোগ। হঠাৎ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বিপক্ষে আন্দোলনে যায় দেশের সব ক্রিকেটার। যার নেতৃত্ব দেন টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা যায় দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবালকে। ছিলেন মুশফিকুর রহীম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ থেকে শুরু করে জাতীয় দলের প্রায় সব ক্রিকেটার। আর্থিক থেকে শুরু করে অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধাসহ ১৩ দফা দাবি ছিল তাদের। বিসিবির সভাপতি ৯ দফা মেনে নিয়ে সংকট নিরসন করেন। তবে এর প্রভাব কিন্তু রয়ে গেছে। নানা সূত্রে জানা গেছে বোর্ডের সঙ্গে ক্রিকেটারদের এখনো বেশ দূরত্ব। যার প্রভাব পড়েছে দল ও পারফরম্যান্সে। ক্রিকেটারদের মাঝে নাকি একটি ভয়ও কাজ করছে। ভারত সফরে ঠিক আগমুহূর্তে সাকিবকে নিয়ে ভয়ঙ্কর বার্তা আসে ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (আইসিসি) থেকে। জুয়াড়িদের প্রস্তাব গোপন রাখার অভিযোগে আইসিসি সাকিবকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। এর মধ্যে এক বছর তিনি খেলতে পারবেন না সব ধরনের ক্রিকেটে। তাই শেষ মুহূর্তে সাকিবের বিকল্প অধিনায়ক খুঁজতে হয়েছে বিসিবিকে। কিন্তু দলের সবচেয়ে সিনিয়র ক্রিকেটার মুশফিক বোর্ডের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েও নাকি নেতৃত্ব নিতে রাজি হননি! রিয়াদকে টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব তুলে দেয়া হয়েছে। তবে টেস্টে তাকে নিয়ে ভাবা হয়নি। কারণ বিসিবি টেস্টের জন্য লম্বা সময়ের একজন অধিনায়ক চাইছিল। তাই ১১তম টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে বেছে নেয়া হয় ২৮ বছর বয়সী মুমিনুলকে। কিন্তু তামিম ইকবালের সফর থেকে স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ায় সফরের আগে দ্বিতীয় ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। সাকিব নেই। তামিম সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে ছুটিতে। মাহমুদুল্লাহ পুরোপুরি ফিট ছিলেন না। দলের সেরা পেসার মোস্তাফিজুর রহমানও আনফিট। দুই টেস্টেই একাদশের বাইরে ছিলেন তিনি। তবে তার বিরুদ্ধে আরো বড় অভিযোগ তিনি নাকি টেস্ট খেলতেই আগ্রহী নন! একই অভিযোগ সাকিবের বিরুদ্ধেও তুলেছিলেন বিসিবি সভাপতি। তামিমের ছুটিটাও নাকি ভালোভাবে নেয়া হয়নি। কারণ দলের আারেক সদস্য আল আমিনও তার স্ত্রীকে হাসপাতালে রেখে দেশের জন্য খেলতে এসেছেন ভারতে। তিনি এখানে এসে দ্বিতীয় সন্তানের পিতা হওয়ার খবর পান। তাতে প্রশ্ন উঠেছে তামিমের দেশপ্রেম নিয়েও। বলা হচ্ছে যতটা সময় তিনি পেয়েছেন তাতে অন্তত টি-টোয়েন্টি কিংবা শেষ টেস্ট খেলতে পারতেন। ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেই দিলেন এমন পারফরম্যান্সের বড় কারণ সাকিব ও তামিমের দলে না থাকা। তিনি বলেন, ‘সাকিব-তামিম নেই। মুশফিক একা কি করতে পারবে! একেবারেই অনভিজ্ঞতাই দলের এমন পারফরম্যান্স।’ ভারত সফরে দুই টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হারের পর প্রশ্ন উঠেছে টেস্ট খেলার মানসিকতা নিয়ে। অধিনায়ক মুমিনুল ম্যাচ শেষে গতকাল ফের বলেন, ‘আমাদের ভালো খেলতে হলে টেস্ট খেলার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।’ কোচ রাসেল ডমিঙ্গোতো টেস্ট দলটাই আলাদা করে ফেলতে চান। তার পরিকল্পনা মতে যারা টেস্ট খেলতে চায় তাদের নিয়ে দল করার প্রয়োজন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে কেন টেস্ট খেলতে আগ্রহ নেই ক্রিকেটারদের? এই জন্য দায়টা ক্রিকেট বোর্ডকেই নিতে হবে। ভারতের অধিনায়ক বিরাট যেমন বললেন, টেস্টে উন্নতি করতে হলে বোর্ডের ভূমিকা থাকতে হবে সবচেয়ে বেশি। কারণ ৫০ ওভারের ওয়ানডে বা ২০ ওভারের টি-টোয়েন্টি যত টাকা মেলে টেস্টে তা দেয় না বোর্ড। আর সেই কারণেই টেস্টের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে ক্রিকেটাররা। তাই বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে টেস্ট ক্রিকেটরা সম্মানি থাকতে হবে সবচেয়ে বেশি যা ভারত করেছে এবং ফলও পাচ্ছে। আর টেস্ট খেলার জন্য আইসিসির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও পায় বিসিবি। তাই তাদের টেস্টে ক্রিকেটারদের সম্মানি বাড়াতে বা অবকাঠামোন উন্নতি অর্থিক অস্বচ্ছলতা থাকার কথা নয়।প্রশ্ন উঠছে নয়া প্রধান কোচ ও নির্বাচকদের ভূমিকা নিয়েও। কারণ লিটন দাসের মাথায় বল লাগার পর ‘কনকাশন’ সাব হিসেবে দলে কোন ব্যাটসম্যান ছিল না। তার বিকল্প করতে হয় স্পিনার মেহেদী হাসানকে। মোসাদ্দেক চলে গেলেও তাকে ফিরিয়ে আনা বা তার বিকল্প ভাবা হয়নি। সাইফ হাসানের হাতে পুরানো ইনজুরি প্রথম টেস্টের অনুশীলনেই ধরা পড়ে ইন্দোরে। কিন্তু তারও বিকল্প আনা হয়নি। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় ইডেনে গোলাপি বলের টেস্টে মাঠে গড়ানোর একদিন পর বিকল্প হিসেবে নাজমুল হোসেন শান্তকে পাঠানোর সিদ্বান্ত। তার মানে টিম ম্যানেজন্ট, কোচ ও অধিনায়কের সঙ্গে নির্বাচকদের সমন্বয় সঠিক ছিল না। বিশেষ করে প্রধান নির্বাচক শক্ত অবস্থান কেন নেয়নি সেটিও প্রশ্ন। কোচ না চাইলেও তিনি ভাবতে পারতেন বা জোর দিয়ে পাঠতে পারতেন বিকল্প কাউকে! জানা গেছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দলের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে ঘুড়ে বেড়ানোরও।ভারতে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিততে জিততে হাতছাড়া হয়েছে। ইন্দোরে লাল বলের টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে হার। এরপর কলকাতায় ঐতিহাসিক গোলাপি বলের দিন-রাতের টেস্ট লজ্জার ব্যাটিং। এই সবের জন্য যেমন ক্রিকেটারদের দায় আছে তেমনি দায় এড়াতে পারবে টিম ম্যানেজম্যান্ট ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বিসিবি।