
ছবি সংগৃহীত
প্রচলিত কিছু কবীরা গুনাহ
আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৭, ০৩:১৭
কবীরা গুনাহ। ছবি : সংগৃহীত
(প্রিয়.কম) গুনাহ বা পাপ প্রথমত দুই ভাগে বিভক্ত- এক. কাবীরা । দুই. সগীরা। কেউ কেউ বলেছেন, মূলত সব গুনাহই গুনাহ। এর কোনো বিভাগ নেই। তবে মুহাক্কিক উলামায়ে কিরামের মতে, গুনাহ দুই প্রকার- এক. সগীরা গুনাহ। দুই. কবীরা গুনাহ।
আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, যদি তোমরা কাবীরা গুনাহসমূহ বর্জন করো, যা করতে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, তবে আমি তোমাদের সগীরা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেব। (সূরা নিসা, ৪ : ৩১)
হাদিস শরিফেও গুনাহ দুই প্রকার হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে- সগীরা ও কবীরা। (তাফসীরে বায়যাবী, সূরা নিসা)
কাবীরা গুনাহের আভিধানিক অর্থ ‘বড় গুনাহ’। আর শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যে সকল কাজ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এবং যে সকল কাজের জন্য শাস্তির বিধান অথবা আল্লাহর ক্রোধের ঘোষণা রয়েছে, তাকে কবীরা গুনাহ বলা হয়। কবীরা গুনাহ কোনো ইবাদতের দ্বারা মাফ হয় না বরং এর জন্য তওবা করা আবশ্যক। আর সগীরা গুনাহ নেক আমল দ্বারাও মাফ হয়ে যায়। উলামায়ে কিরামের মতে সগীরা গুনাহও যদি বেপরোয়া ও ঔদ্ধত্বের সাথে বরাবর করা হয়, তবে তাও কবীরার পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়।
ইব্ন হুমাম ও হাসান বাসরী (রহ.) বলেছেন, যে সকল গুনাহের কারণে আল্লাহ্ তাআলা দোজখ, লানত, আজাব ইত্যাদি দ্বারা ভীতি প্রদর্শন করেছেন, সেগুলো কবীরা গুনাহ। অন্যান্যগুলো সগীরা গুনাহ।
কবীরা গুনাহসমূহের সংখ্যা: পবিত্র কুরআন ও হাদিসে কবীরা গুনাহের পূর্ণ সংখ্যার বর্ণনা এক সাথে উল্লেখ নেই। তবে কুরআন ও হাদিসে যে সকল গুনাহকে কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, উলামায়ে কিরাম তার সংখ্যা ৭০টি বলে বর্ণনা করেছেন। আবার তাঁদের কেউ কেউ তার সংখ্যা এর চেয়ে অধিক বলেও উল্লেখ করেছেন।
হজরত আবূ হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, ৭টি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে তোমরা দূরে থাকবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! সে ৭টি কাজ কি কি? তিনি বললেন, ১. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক কর। ২. জাদু করা। ৩. শরিয়তের বিধান ছাড়া কাউকে হত্যা করা, যা আল্লাহ্ হারাম করেছে। ৪. সুদ খাওয়া। ৫. ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা। ৬. জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা এবং ৭. নিরাপরাধ ও পবিত্র মুসলিম নারীদের নামে যিনার অপবাদ রটানো। (বুখারী ও মুসলিম)
হজরত ইব্ন উমর (রা.) বর্ণনা করেন, কবীরা গুনাহ ৯টি- ১. আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা। ২. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা। ৩. নির্দোষ নারীকে যিনার অপবাদ দেওয়া। ৪. যিনা করা। ৫. যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করা। ৬. ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা। ৭. মুসলমান পিতামাতার নাফরমানী করা। ৮. হরম শরীফে কুফরি করা। ৯. জাদু করা। হজরত আবূ হুরায়রা (রা.) এর সাথে সুদ খাওয়া, চুরি করা ও মদ পান করাকে যোগ করেছেন।
হজরত আনাস (রা.)-এর বর্ণনা, নবী করীম (সা.) আমাদের এরূপ উপদেশ খুব কমই দিয়েছেন যেখানে নিন্মোক্ত কথাগুলো বলেননি- ১. যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই। এবং ২. যে ওয়াদা রক্ষা করে না তার মধ্যে দীন নেই। (শারহে আকাইদে নাসাফী)
হজরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসঊদ (রা.) বলেনে, এক ব্যক্তি নবী করীমকে (সা.) জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ্ তাআলার কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি? উত্তরে নবী (সা.) বললেন, কোনো কিছুকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করা। অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, অতঃপর কোনটি? নবী (সা.) উত্তরে বললেন, তোমার সন্তান তোমার সাথে খাবে এ ভয়ে তাকে হত্যা করা। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর কোনটি? নবী করীম (সা.) জবাব দিলেন, পরস্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। এরপর পবিত্র কুরআনের এই আয়াত তিনি তিলাওয়াত করে শুনালেন, (অর্থ) ‘যারা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে মাবুদ বলে ডাকে না, আল্লাহ্ যাকে হত্যা করা হারাম করে দিয়েছেন তাকে আাইনের বিধান ব্যতীত হত্যা করে না এবং যিনায় লিপ্ত হয় না।’ (ফুরকান, ২৫ : ৬৮; বুখারী ও মুসলিম)
হজরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন ঊমর (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.)-এর ঘোষণা গুরুতর কবীরা গুনাহ হচ্ছে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা, মিথ্যা হলফ করা। (বুখারী)
এছাড়া হজরত ইবন জাবাল বলেছেন নবী করীম (সা.) আমাকে দশটি বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন, ১.আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় বা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ২. পিতামাতার অবাধ্য হবে না যদিও তারা তোমাকে স্ত্রী, পুত্র, ধন-সম্পদ পরিত্যাগ করতে বলেন। ৩. ইচ্ছে করে কখনো ফরজ নামাজ তরক করবে না। কেননা তা করলে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে হিফাজতের দায়িত্ব উঠে যায়। ৪. কখনো শরাব পান করবে না। কেননা তা হচ্ছে সকল অশ্লীলতার উৎস। ৫. সাবধান! গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে। ৬. সাবধান! জিহাদের ময়দান হতে পলায়ন করবে না। যদিও সকলে ধ্বংস হয়ে যায়। ৭. লাকের মধ্যে মহামারী দেখা দিলে সে স্থান ত্যাগ করবে না। ৮. তোমার সামর্থ্যানুযায়ী পিতামাতার জন্য ব্যয় করবে। ৯. পরিবারের লোকদের আদব-কায়দা শিক্ষা দিবে, শাসন করতে কখনো দ্বিধা করবে না। ১০. তাদেরকে আল্লাহ্ তাআলার ভয় প্রদর্শন করবে। (মুস্নাদে আহ্মাদ ও মিশকাত)
সমাজে প্রচলিত কিছু কবীরা গুনাহ: ১. আল্লাহ্ তাআলার সাথে কাউকে শরিক করা। ২. কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা। ৩. পিতামাতার অবাধ্য হওয়া ও তাদের কষ্ট দেয়া। ৪. কাউকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা। ৫. ইয়াতীদের সম্পদ আত্মসাত করা। ৬. যিনা-ব্যভিচার করা। পুরুষে পুরুষে, নারীতে নারীতে মৈথুন করা। ৭. ওজনে কম দেয়া। ৮. দারিদ্রের আশঙ্কায় সন্তান হত্যা করা। ৯. কোনো নির্দোষ মহিলার উপর যিনার অপবাদ দেয়া। ১০. সুদ খাওয়া ও সুদ দেয়া। ১১. জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা। ১২. জাদু, বান, টোনা ইত্যাদি করা। ১৩. আমানতের খিয়ানত করা। ১৪. ওয়াদা ভঙ্গ করা। ১৫. মিথ্যা বলা। ১৬. কুরআন শরীফ শিক্ষা করে তা ভুলে যাওয়া। ১৭. আল্লাহ্ তাআলার কোনো ফরজ ইবাদত যেমন- নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি বিনা করণে ছেড়ে দেয়া। ১৮. আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে সিজ্দা করা। ১৯. কোনো মুসলমানকে কাফির, বেঈমান, আল্লাহর নাফরমান, আল্লাহর দুশমন ইত্যাদি বলা। ২০. চুরি করা। ২১. গীবত করা ও শোনা। ২২. খাদ্যশস্যের দাম বাড়লে খুশি হওয়া। ২৩. কোনো বস্তুর দাম সাব্যস্ত হওয়ার পরও জোরপূর্বক তার মূল্য কম দেয়া। ২৪. শরাব পান ও মাদকদ্রব্য সেবন করা। ২৫. জুয়া খেলা। ২৬. গায়ের মুহাররম- এর নিকট নির্জনে বসা। ২৭. আল্লাহর নিয়ামতের না-শোকরী করা। ২৮. জুলুম-আত্যাচার করা। ২৯. আল্লাহ্ তাআলার রহমত থেকে নিরাশ হওয়া। ৩০. কারো প্রতি অহেতুক মন্দ ধারণা পোষণ করা। ৩১. অপরের দোষ অনুসন্ধান করা। ৩২. কারো ঘরে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করা। ৩৩. বিনা অজুতে জুমুআর নামায তরক করা। ৩৪. মিথ্যা কসম খাওয়া। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নামে কসম খাওয়া। ৩৫. কাফিরদের রীতিনীতি ও প্রথাকে পছন্দ করা। ৩৬. অশ্লীল নৃত্য-গীতি বা গানবাজনা উপভোগ করা। ৩৭. সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ন্যায় ও সত্যের পথে আহবান না করা ও অন্যায় অসত্য প্রতিরোধের চেষ্টা না করা। ৩৮. মুসলমানের উপর জুলুম করা ও তাকে অপমান করা। ৩৯. কোনো পশুর সাথে যৌন অপরাধে লিপ্ত হওয়া। ৪০. শূকরের গোশত ভক্ষণ করা। ৪১. কোনো হারাম দ্রব্য ভক্ষণ করা। ৪২. আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্য কারোর নামে জবেহকৃত পশুপাখি গোশত ভক্ষণ করা। ৪৩. মিথ্যা সাক্ষী দেয়া। ৪৪. জ্যোতিষীদের ভবিষ্যত বাণীকে বিশ্বাস করা। ৪৫. গর্ব ও অহংকার করা। ৪৬. ঋতুমতী অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করা। ৪৭. সত্য ও ন্যায়ের উল্টো ফয়সালা দেয়া বা বিচার করা। ৪৮. জালিম ও অত্যাচারীর প্রশংসা করা। ৪৯. আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা। ৫০. ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজের ওয়াক্ত না হওয়া সত্ত্বেও ফরজ নামাজ আদায় করা। ৫২. মুসলমান মুসলমানে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। ৫৩. সাহাবায়ে কিরামকে (রা.) মন্দ বলা। ৫৪. ঘুষ খাওয়া। ৫৫. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ বাঁধিয়ে দেয়। ৫৬. কোনো প্রাণীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা। ৫৭. কারণ ছাড়াই স্ত্রীর স্বামী সহবাসে অসম্মত হওয়া। ৫৮. আল্লাহর শাস্তি হতে নির্ভয় থাকা। ৫৯. আলিম ও হাফিয ক্বারীদের অসম্মান ও অবজ্ঞা করা। ৬০. স্ত্রীর সাথে যিহার করা। ৬১. বেপরোয়াভাবে বরাবর গুনাহে লিপ্ত হওয়া। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, আশআতুল লুমআত, ফাতহুল বারী শারহে বুখারী)
সম্পাদনা: ফারজানা রিংকী
- ট্যাগ:
- কবিরা গুনাহ
- ইসলাম
- ইসলাম
- গুনাহ
- পাপ