.jpg)
ছবি সংগৃহীত
ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল: হেলাল হাফিজ
আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৭, ০৭:৩৫
হেলাল হাফিজ। ছবি: রিয়াজ আহমেদ, প্রিয়.কম
(প্রিয়.কম) তিনি কষ্টের ফেরিওয়ালা। অল্প লিখেও যিনি গল্প হয়েছেন। যে নিজের কষ্টগুলোকে মানুষের মাঝে শাশ্বতরুপ দিয়েছেন। সমাজের পথভ্রষ্ট মানুষগুলো যখন না পাওয়ার তাড়নায় নিজের সাথে নিজে কাটাকুটি খেলায় হেরে গিয়েছে তখন তাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে তার কবিতাগুলো। তিনি সমকালীন বাংলা কবিতার রাজপুত্র। কবিতা দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, প্রণয়বার্তা জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তার কবিতা ফেরি করেও বেড়াচ্ছেন বর্তমান প্রজন্মের অনেক তরুণ প্রেমিক প্রেমিকা। প্রিয় পাঠক এতসময় যার কথা বলছিলাম, তিনি আর কেউ নন, কবিতার জীবন্ত কিংবদন্তী হেলাল হাফিজ। প্রিয়.কম ব্যক্তিগত ও সাহিত্য জীবন নিয়ে সরাসরি কথা বলেছিল তার সাথে।
প্রিয়.কম: কেমন আছেন আপনি?
হেলাল হাফিজ: ভালো। আপনি কেমন আছেন?
প্রিয়.কম: জ্বি, ভালো। আপনার জীবনের শুরু থেকে শুনতে চাই…
হেলাল হাফিজ: আমি তো নেত্রকোনায় জন্মেছি। আমার বাবা ছিলেন একজন নামকরা শিক্ষক। সবাই আব্বাকে চিনতেন। আমার মা যখন মারা গেলেন, আমি তখন তেমন বুঝতাম না। খুব ছোট ছিলাম তো। আমার মায়ের কোনো স্মৃতি-ই আমার মনে নেই; এমন কী চেহারাও না। কিছুদিন পর আমার আব্বা আবার বিয়ে করেন। সঙ্গত কারণে তাকে এটা করতে হয়েছে। কারণ আমরা দুই ভাই ছোট ছিলাম, সংসার দেখাশোনার একটা ব্যাপার আছে। তারপর দ্বিতীয় সংসারে দুই ভাই, তিন বোন হয়। এই হলো আমার ফ্যামিলি মেম্বার। মায়ের আদর যখন মিস করতাম; তখন কিছুই ভালো লাগতো না। একটা দস্যিভাব চলে আসতো নিজের মধ্যে। চারদিক ছুটে বেড়াতাম। যা ভালো লাগতো তাই করতাম।
প্রিয়.কম: এই ভালোলাগার মধ্যে কী কী থাকতো?
হেলাল হাফিজ: এই ধরেন, নেশা-টেশা করতাম। আমি ক্লাস ফাইভ-সিক্স থেকেই সিগারেট ধরেছিলাম। খুব এডভেঞ্চার ভালো লাগতো। সারাদিন খেলাধুলা নিয়ে-ই পড়ে থাকতাম।
প্রিয়.কম: ছোট মা কী আদর করতেন না?
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ, হ্যাঁ। করতো… করতো। তখন তো বুঝতাম না। যে বিষয়গুলো নিয়ে বাড়িতে ঝগড়া হতো; সেগুলো কোনো বিষয়ই না। এখন সেটা বুঝি- অনেক দোষ আমারও ছিল।
প্রিয়.কম: আর বাবা?
হেলাল হাফিজ: উনি হয়েছিল কী- উনি একটা দ্বন্দের মধ্যে পড়ে গেছিলেন। নতুন সংসার হলো, নতুন সন্তান হলো, তো একজন মা তার সন্তানকেই বেশি আদর করবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমিতো বাচ্চা মানুষ ছিলাম; ব্যাপারগুলো বুঝতাম না। দেখা গেলো একদিন রাগ করে ঘর থেকে বের হয়ে যেতাম; দু-তিন-দিন ঘরেই ফিরতাম না। এক ধরনের উশৃঙ্খল বিষন্নতা আমাকে গ্রাস করতে থাকে। এক উদ্বাস্তু জীবন যাপন শুরু করলাম।
হেলাল হাফিজ। ছবি: রিয়াজ আহমেদ, প্রিয়.কম
প্রিয়.কম: তারপর?
হেলাল হাফিজ: একটা সময় এসে বুঝতে পারলাম- খেলাধুলা আমাকে আর শান্ত করতে পারছে না। অন্য কিছুর আশ্রয় নিতে হবে। কবিতা অনেক আগে থেকেই লিখতাম। আমার কেন যেন মনে হতো কবিতাই আমার মাতৃহীনতার কষ্টকে দাবিয়ে রাখতে পারবে। কবিতার মধ্যেই নিজের আশ্রয় খুঁজলাম। ঢাকায় যখন আসলাম তখন আমি কবিতায় মহাচ্ছন্ন। ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবো। পরে ভাবলাম ডাক্তারি করতে গেলে অনেক পড়াশোনার চাপ আসবে; আমি কবিতা লেখার সময় পাবো না। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম। তখন সারা ঢাকা শহর উত্তাল। চারদিকে মিছিল-মিটিং। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দেশ এক হতে লাগলো। আমি কখনো মিছিলে-মিটিং-এ যাইনি। রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম না। কিন্তু ৬৯ এর আন্দোলন এতটাই সর্বগ্রাসী ছিল- যেটা থেকে কিছুতেই দূরে থাকা সম্ভব ছিল না। আমি কিন্তু তার আগেই ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লিখে ফেলেছি। আমার এখন মনে হয়- কবিতাটা আমি লিখিনি আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নিয়েছে। আই ওয়াজ বাউন্ট টু রাইট দিস, আই ওয়াজ ফোরসড টু রাইস দিস।
প্রিয়.কম: বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার কোনো স্মৃতি আছে?
হেলাল হাফিজ: অবশ্যই। আমি কেন সারা দেশের মানুষ ওনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আমার তিনবার বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল। ৬৯-এ আ স ম আব্দুর রব রাজনৈতিক ভাই আলোচনার জন্য ৩২ নম্বর তার বাড়িতে যাবে। আমি রব ভাইকে বললাম- রব ভাই আমিও আপনাদের সাথে যাবো। বললেন চলো। গেলাম সবাই মিলে। রব ভাই বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘এই যে- এই ছেলে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লিখেছে।’ তখন উনি বলেছিলেন, ‘ওহ্… আচ্ছা, আচ্ছা। তুই লিখেছিস। কাছে আয়, কাছে আয়। করেছিস্ কী! আরো লিখ্, আরো লিখ্।’ আমাকে কাছে নিয়ে কী নাটকীয়ভাবে যে আদর করেছিলেন।
প্রিয়.কম: প্রথম কাব্যগ্রন্থের জন্য সময় নিয়েছেন ১৭ বছর, আর দ্বিতীয়টির জন্য পাঠকরা অপেক্ষা করছে ৩০ বছর; এতো ধৈর্য ধরা কী করে সম্ভব?
হেলাল হাফিজ: আমি একটু অলস প্রকৃতির মানুষ। কষ্ট সয়েছি বলেই আজ তার ফল পাচ্ছি। ‘ফেরিওয়ালা’ কবিতার শেষের পংক্তি- ‘আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট’। এই হৃষ্টপুষ্ট শব্দটির জন্য আমি চার মাস অপেক্ষা করেছি। কবিতার জন্য এই কষ্টটা আপনাকে সইতে হবে। এই যে- এতো বড় একটা বইমেলা হয়ে গেল। মেলা শেষে কিন্তু কবিতা বা কবিকে কেউ আর মনে রাখছে না। আমি চেষ্টা করেছি; ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ এমন একটি বই করবো যা মানুষ ভুলতে পারবে না। সেটা যতো সময়ই লাগুক। আমি আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনকে বলেছি তুমি কেঁদো না’ এর জন্যও সময় নিচ্ছি কারণ এই বইটার প্রত্যেকটি কবিতা যেন মানুষের বুকে তীরের মতো গেঁথে থাকে। মানুষ যেন তাদের অধিকার, প্রতিবাদ, প্রহসন, প্রেম ও দুঃখ-বেদনা প্রকাশ করতে আমার কবিতার আশ্রয় নেয়- এটা হলো আমার জেদ, এটা আমার প্রেম।
প্রিয়.কম: কবিতার জন্য কী সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে?
হেলাল হাফিজ: কবিতা লিখতে হলে অনুশীলন, জ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান-মনষ্ক হতে হবে। শুধু আবেগে এখন আর কবিতা লিখলে হবে না। স্বভাব-কবিতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। লেখার চেয়ে পড়াশোনা বেশি লাগে। আবেগ থাকবেই, প্রেম থাকবেই, দেশের জন্য মানুষের জন্য প্রেম না থাকলে কিন্তু হবে না। প্রথমে আপনাকে প্রেমিক হতে-ই হবে।
প্রিয়.কম: ‘কবির জীবন খেয়ে জীবন ধারণ করে’- কবিতা আসলে কী তাই?
হেলাল হাফিজ: হুম্। আমার কষ্টগুলো; আমার কবিতার এক একটি শব্দ। আমি শব্দগুলোকে এভাবেই কবিতায় বুনেছি। মাতৃহীনতার বেদনা থেকে- আমি মূলত কবিতা লিখি। যে কষ্টে আমার বুক ব্যথা হতো। সেই কষ্ট দিয়েই আমি পুষ্ট করেছি আমার কবিতা। ‘কবি ও কবিতা’য় আমি লিখেছি-
কবির জীবন খেয়ে জীবন ধারণ করে
কবিতা এমন এক পিতৃঘাতি শব্দের শরীর,
আবার বলেছি, কবির কষ্ট দিয়েই কবিতা পুষ্ট হয়।
হেলাল হাফিজ। ছবি: রিয়াজ আহমেদ, প্রিয়.কম
প্রিয়.কম: আপনার জীবনে নারী ঘনিষ্ঠতার কথা অনেক শুনেছি...
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। আমার কবিতায় যে নারীরা এসেছে; তারা আমার মতোই রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। কোনো কল্পনা নয়। আমার জীবনে প্রথম নারী হলো সবিতা সেন। তাকে আমি মায়ের মতো দেখতাম। তার কাছে যেতাম। আদর খেতাম। তখন কিন্তু ফ্রয়েড-এ কথা আমার মাথায় ছিল না। সেক্স-এর বিষয়গুলো বুঝতাম না। যখন নাইন-টেইন-এ উঠলাম; আমারও শারীরিক পরিবর্তন হতে লাগলো। তখন আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম। সেও আমাকে খুব পছন্দ করতো। এই ক্যামিস্ট্রিটা ছিল দ্বি-মুখি বা অসমও বলতে পারেন। তখন তো সমাজ ছিল খুব-ই কনজারভেটিভ।
প্রিয়.কম: ‘ইচ্ছে ছিল তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো’ কে সে?
হেলাল হাফিজ: ‘ইচ্ছে ছিল’ কবিতাটা বলছেন…, এটা হতে পারে কাউকে উদ্দেশ্য করে লিখেছি। আবার নাও হতে পারে। এই বিষয়টা উহ্য-ই থাক। অনেকে বলতে পারে; শেষ পরিণতি কেন হয়নি। হয়নি- আমিতো মনে করি ভালোই হয়েছে। হলে হয়তো এই কবিতাগুলো মাথা থেকে বের হতো না। ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল; এমনটা শুধু আমার কথা না। ‘অভাগীর স্বর্গ’তে শরৎচন্দ্রও বলেছেন, ‘অতৃপ্ত বাসনাই মহৎ প্রেমের প্রাণ।’
প্রিয়.কম: ‘দুঃখের আরেক নাম’-তে আপনি বলেছেন, ‘নারী তুমি শৈল্পিক তাবিজ’ নারী ব্যাপারটা আপনি কীভাবে দেখেন?
হেলাল হাফিজ: দেখেন- সব নারীতো আর প্রেমিকা না। সব নারী প্রেমিকা হয়ে ওঠেও না। পড়াশোনা বাদে আমাকে দু’টি জিনিস তাবিজের মতো-ই দারুণ প্রভাবিত করেছে। একটি হলো- বেদনা। দুঃখ, বেদনা, বিরহ এগুলো আমার খুব পছন্দের বিষয়। সুখের চেয়ে দুঃখটাকে আমি বেশি উপভোগ করি। আরেকটি হলো- নারী। আমাদের দেশে শৈল্পিক দুঃখ দেয়ার মানুষ বড্ড অভাব। আমি কবি হয়েছি নারীর কারণে। আমার মা মারা না গেলে হয়তো আমি কবিতার দিকে আসতাম না। নারীর প্রতি প্রেম একেক রকমের হয়। কে কীভাবে নেয়, সেটা তার উপর নির্ভর করে; এই প্রেমের বিশেষণ। নারীর কাছে পরাজিত হতে হয়। দুই জায়গায় আমার নত হতে কোনো বাঁধা নেই। আমার ভালো লাগে নত হতে। সেটা হলো নারী আর শিশু। নারীর কাছে নত হওয়া মানে নিজেকে বিকিয়ে দেয়া নয়- এর মানে হলো তার কাছে বিনয় হওয়া, তাকে শ্রদ্ধা দেখানো। এই ‘শেল্পিক দুঃখ’ আমি কিছু নারীর কাছে পেয়েছি। আবার কিছু কিছু কষ্ট আমি আমার নিজের ভেতর তৈরি করে নিয়েছি। তাই এই কবিতাটিতে আমি বলেছি-
এতোদিন নারী ও রমণীহীন ছিলাম বলেই ছিলো
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।
প্রিয়.কম: ‘হিরনবালা তোমার কাছে দারুণ ঋণী সারা জীবন’ ঋণের কারণেই কী এই দুঃখ প্রকাশ?
হেলাল হাফিজ: ভালোবাসার একটা ঋণতো থেকেই যায়। হিরনের কাছে আমার অ-শেষ ঋণ। কবিতাটায় বলেছিলাম-
‘আঙুল দিয়ে তোমার আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার
আঙুলে আজ সুর এসেছে’
ভালোবেসে সেটার দোষ দেয়ার চেষ্টা করেছি। হিরনের সাথে আমার শারীরিক কথোপকথন হয়েছে। অনেকের সাথেই হয়েছে; সবাই তো আর সেইভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। (বলেই কবি থেমে গেলেন…)
হেলাল হাফিজ। ছবি: রিয়াজ আহমেদ, প্রিয়.কম
প্রিয়.কম: কষ্ট হচ্ছে?
হেলাল হাফিজ: না…। এক জীবনে কতোটা আর কষ্ট হবে, এক মানবী কতোটাই বা কষ্ট দেবে।
প্রিয়.কম: উপার্জন হিসেবে জুয়া খেলাকে কেন বেছে নিলেন?
হেলাল হাফিজ: আমার প্রথম চাকরি হয় মুন্সিগঞ্জে একটি স্কুলে। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লেখার কারণে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় চাকরি হয়। কিন্তু ৭৪-এ বাকশাল হলো। বাকশাল হওয়ার পর একটা কাগজ রেখে বাকি সব কাগজ বন্ধ করে দেয়া হলো। যদিও সরকার সবাইকে চাকরি দিয়েছিল। আমাকেও দিয়েছিল। কিন্তু আমি চাকরিটা করিনি। সরকারি চাকরি আমার ভালো লাগতো না। সেই তুলনায় সাংবাদিকতা ভালো লাগতো। স্বাধীন একটা পেশা ছিল। সেই কারণে তাস খেলা শুরু করলাম। আপনি ‘Gigolo’ ব্যাপারটা বুঝেন তো, আমি সেটাও করেছি। কিছু বিত্তশালী নারীদের সাথে আমি করেছি। তাদের সঙ্গ দিয়েছি; অস্বীকার করার কিছু নেই। দুজনের সম্মতিক্রমেই ব্যাপারগুলো হয়েছে। আমিতো দেখতে অনেক সুন্দর ছিলাম। আমাকে দেখে কেউ চোখ ফেরাতে পারতো না। তারকাদের জীবনে এইসব হয়; অনেক সময় বাধ্য হয়েও এগুলো করতে হয়।
প্রিয়.কম: ‘আমার পুড়েছে কপাল আকালের এই বাংলাদেশে’ আকালের বাংলাদেশ কী এখনও আছে?
হেলাল হাফিজ: আছে। এই আকাল হলো মননশীলতার আকাল, এই আকাল হলো চিন্তাশীলতার আকাল। মুক্ত বুদ্ধি এবং মেরুদন্ডসম্পন্ন মানুষ খুব কম। ২৫-শে মার্চ আর ১৪-ই ডিসেম্বর সব শেষ করে দিয়ে গেছে। আমি হয়তো থাকতম না। যদি সেদিন ইকবাল হলে থাকতাম। কালো রাতে খাবারের জন্য বের হয়ে বন্ধুর সাথে যদি আড্ডা না দিতাম। আমরা বড়াই করতাম যে বন্ধুদের নিয়ে, যে তারা একদিন অনেক বড় হবে। সেই ছেলেদের লাশগুলো আমি দেখেছি। সহ্য করতে পারিনি- নির্মলেন্দু গুণ আর আমি একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি।
প্রিয়.কম: ‘অসুস্থ সচ্ছলতা’ বলে একটা শব্দ আপনি কবিতায় ব্যবহার করেছেন।
হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। সমাজের যে শ্রেণি বিন্ন্যাস, সম্পদের অসম বণ্টন, বিত্তশালীদের আর্থিক বিলাসিতা- এই ব্যাপারটি থেকে এই শব্দটি ব্যবহার করেছি। সমাজের জন্য তাদের যে দায়বদ্ধতা সেটা এড়িয়ে না চললেও তারা পারেন। আবার আমি দেখেছি বিত্তশালী পিতার ছেলে-মেয়েরা সুযোগ-সুবিধা বেশি ভোগ করে থাকে কিন্তু সমাজের ভিতখুঁটি- কষ্ট করে বেড়ে ওঠা গরিবের ছেলেটিই ধরে। সেখান থেকেই এই শব্দটা খুঁজে পাই। এখন পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ‘ক্যাকটাস’ কবিতায় আমি ব্যাপারটা বুঝাতে চেয়েছি। আমরা শুধু নিতেই শিখেছি, দিতে না। জৈষ্ঠ মাসে ফল গাছগুলোকে দেখবেন; ফল গাছগুলো মৃত্তিকার কাছাকাছি চলে আসে। কেন? কারণ, ফলের ভারে তাকে নত হতে হয়ে। মানুষকেও বড় হলে নত হতে হয়। একটুতে সুখি আর সুখি হলেই নত হতে জানতে হয়। কথাগুলো পৃথক পাহাড়ে আছে।
প্রিয়.কম: ‘নগরের জ্যেষ্ঠ শামুক, যারা গুটিয়ে যায়, নতুন মুদ্রায় নিজের নির্জনতা খোঁজে’ তাদের তাহলে কী বলবেন?
হেলাল হাফিজ: যারা বুদ্ধিজীবী, যারা উপর থেকে রাষ্ট্রের কাজে নিয়োজিত মধ্যে যদি ছোট ছোট প্রাপ্তির আশা থাকে তাহলে কাজগুলো কারা করবে। যেকোনো সমাজের জন্য দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো ধর্ম আরেকটি রাজনীতি। এই দুইটা জিনিস-ই অপেক্ষাকৃত অযোগ্য মানুষের হাতে পড়ে গেছে। এখন এর প্রভাব কিন্তু সবাইকে ভোগ করতে হবে- কারণ নগর যখন পুড়ে তখন দেবালয়ও এড়ায় না।
প্রিয়.কম: আপনার ‘হিজলতলীর সুখ’ তাহলে পাওয়া হলো না?
হেলাল হাফিজ: আমরা হয়তো দেখে যেতে পারবো না। আপনারা হয়তো পারবেন। আমি তো বলেছি- একটি পতাকা পেলে সমান সুখের ভাগ নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।
প্রিয়.কম: আপনি এও বলেছেন, ‘স্বাধীনতা সবই খেলো মানুষের দুঃখ খেলো না।’
হেলাল হাফিজ: হে হে। সুখ পেয়েছি কিন্তু শীতল না। হিজলতলীর মানুষ সব জানতে পারবে। ‘যার যেখানে জায়গা’তে দেখবেন আছে, আমিও গ্রামের পোলা চুত্-মারানি গাইল দিতে জানি। তখন কিন্তু হিজলতলীর মানুষ এটাই বলবে।
প্রিয়.কম: এমন কোনো বিষয় আছে যা ভুলে যেতে চান?
হেলাল হাফিজ: আমার অল্প কিছু সুখস্মৃতি আছে। আমি সে-টুকু ভুলে যেতে চাই।
প্রিয়.কম: অবসরে কী করেন?
হেলাল হাফিজ: আমি তো সারাবেলা-ই অবসর। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে হয়। একটু লেখালেখি করি। নিঃসঙ্গ থাকতেই আমার বেশি ভালো লাগে। এই…
হেলাল হাফিজ। ছবি: রিয়াজ আহমেদ, প্রিয়.কম
প্রিয়.কম: ‘তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো’ কে সে?
হেলাল হাফিজ: (কবি হেসে বললেন) ফেসবুক। ফেসবুক বলতে পারেন।
প্রিয়.কম: এখন জীবনটাকে কীভাবে দেখেন?
হেলাল হাফিজ: নিজেকে খুব অপরাধী মনে করি। কারণ আমি অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। ৭০ বছরের জীবন তো কম না। আমার জীবনে কিছু প্রায়োরিটির বিষয় আছে। সেগুলো হলো- অক্সিজেন, শষ্যদানা, প্রেম এবং কবিতা। এগুলোকে ঘিরেই আমার জীবন। আমার আরো লেখা উচিৎ ছিল। জীবনে কবিতা ছাড়া আর কিছুই করিনি যেমন সত্য, আবার খুব কম লিখেছি এটাও সত্য। আমি সবার কাছে অনুতপ্ত, দুঃখিত। সবাইতো টাকা জমাতে চায়- আমি মানুষ জমাতে চেয়েছি।
প্রিয়.কম: কবি আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদের সময় দেয়ার জন্য।
হেলাল হাফিজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সম্পাদনা: ফারজানা রিংকী