কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

আপনি কি ড্রাইভারকে মারবেন?

মিজানুর রহমান
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৩:৩৭
আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৩:৩৭

আমার একদম প্রথম আউটডোর এসাইনমেন্ট ছিলো ঢাকা শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিয়ে। অফিস থেকে আমাকে বলা হয়েছিলো রিপোর্টটা যেনো স্টুডেন্ট বান্ধব হয়। গরমে সারাদিন আমি ঘুরে ঘুরে, বিভিন্ন বাস ড্রাইভার, হেলপার, যাত্রীদের সাথে কথা বলে আমি অফিসে যে রিপোর্টটা করলাম তার অধিকাংশই গেছে স্টুডেন্টদের বিপক্ষে। অফিসের কথা অমান্য করার কারনেই কিনা আজো আমার সেই রিপোরর্টটা আলোর মুখ দেখেনি।

স্টুডেন্টদের একটাই কথা। হাফ ভাড়া দেয়াটা তাদের অধিকার। আর এটা সরকারী নিয়ম। কিন্তু সত্যি কথাটা হলো সরকার স্টুডেন্টদের জন্য হাফ ভাড়ার কোনো নিয়ম এখনো করেনি। রিপোর্টটা করতে গিয়ে আমি বেশ কিছু যাত্রী ও শিক্ষাথীদের হিংস্র আচরনের কথা জানতে পারি। বিহঙ্গ পরিবহনের এক হেলপার তার গায়ের শার্ট খুলে আমাকে তার পিঠের ১২ ইঞ্চি লম্বা দাগ দেখাইছে। লোকটার সারা পিঠে এমন মোটা কাটা দাগ দেখে আমার জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ঢাকার একটা কলেজের সামনে থেকে কিছু স্টুডেন্ট বাসে উঠতে চাইছিলো। বাসে জায়গা ছিলোনা বিধায় তিনি উঠতে দেননি। এই ছিলো তার দোষ।

এই ‘অপরাধে’ একটু দূরে বাস জ্যামে থামলে শিক্ষার্থীরা গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে তার পিঠে পোছ দেয়। এই ঘটনার পরবর্তী তার দূর্দশার কথাগুলো আসলে আর বলার মত না। একটা বাসের হেলপার কি-ই বা এমন দোষ করলো যে তার এমন শাস্তি হলো?? বিচার রইলো। পিছনের গাড়ির ধাক্কায় একবার অন্য এক হেলপারের হাত ভেঙ্গে গিয়েছিলো। তার মাসিক বেতন চার হাজার টাকা। আবার তার বাসা ভাড়াও প্রতি মাসে চার হাজার টাকা। কিন্তু তার ভাঙ্গা হাত জোড়া লাগতে খরচ হয়েছে পনেরো হাজার টাকা। এই টাকার একটাও মালিকপক্ষ দেয়নি। উল্টা চাকরি থেকে বহিষ্কার। হেলপার আমাকে বললো, আমার তখন ভাঙ্গা হাত। গাড়ি চালাইতে পারিনা। কেউ কি চাইবো আমারে কাজ ছাড়া টাকা দিতে?? মালিকের কি দোষ? বোঝেন অবস্থা.. আসলে প্রত্যেকেরই এইরকম দুই একটা করে গল্প আছে। সব বলে শেষ করা যাবেনা। আশা করি সবারই কমবেশ পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠার অভিজ্ঞতা আছে।

সামান্য অযুহাতে বাসের স্টার্ফ নির্যাতনের দৃশ্য নিশ্চয়ই আপনার কাছে নতুন কিছু নয়। অনেক সময় তো হয়তোবা আপনি নিজেই এমনটা করেছেন !! একজন স্টুডেন্ট কত উপায়ে টাকা ভাঙ্গে, তার আসলে কোনো ইয়ত্তা নেই। তো বাসে ৫ টাকা ভাড়া দিতে এত অাপত্তি কিসের? কোনো উত্তর আছে? প্রায় প্রত্যেক ড্রাইভার বা হেলপারই আমাকে বলেছে তারা প্রতিনিয়ত যাত্রীদের চড় থাপ্পড় খায়। আপনি একবার ড্রাইভারের সিটটার কথা ভাবুন। সবসময় এই সিটের তাপমাত্রা ৩৫-৪০এর বেশি থাকে। এমন একটা উত্তপ্ত উনুনে আপনি বসে থাকতে পারবেন? অথচ সে সারাদিন ওইখানে বসে বসে গাড়ি চালায়। আর আপনি কথায় কথায় তারে মারেন !! এদের থাকার জায়গাতো আরো সঙ্গীন। বড় একটা অংশতো গাড়িতেই রাত কাটায়। আর যারা টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকে, সখোনকার কোনো কিছুই ঠিক নাই। পানি থাকেনা।একটা টয়লেট অনেকের জন্য। মোটকথা অসাস্থ্যকর এক পরিবেশে আপনি আমি দুইদিনও টিকতে পারবোনা।

আসলে সারা দিন এরা এত খারাপ ব্যাবহারেরর সম্মুখীন হয় যে, ভালো ব্যাবহারটাই ভুলে যায়। কিন্তু একবার এদের সাথে একটু আদুরে গলায়, একটু কাঁধে হাত দিয়ে স্বান্ত্বনার ভঙ্গিতে কথা বলেন, আমি নিশ্চিত, আপনি এদের অন্য একটা রূপ দেখবেন। বিভিন্ন সময় আমি নিজে এটার প্রমান পেয়েছি। ঐদিন আমি বিভন্ন জায়গায় অন্তত ছয়জনের সাথে বসে বসে চা খেয়েছি। কেউই আমাকে চায়ের বিলটা পর্যন্ত দিতে দেয়নি। হ্যাঁ, কিছু স্টাফ তো আছেই যারা সমস্যা করে। খালি খালি ভেজাল করতে চায়। আমি নিজেও স্টুডেন্ট। নিজেওতো কত সময় এই ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়েছি। কিন্তু কোনোটাই এই পর্যায়ে পৌছেনি যে, তাকে আমার আঘাত করতে হবে। ব্যাপারটা একটু তাদের জায়গা থেকে চিন্তা করূন। আপনিতো ২-৩ ঘন্টা রাস্তায় থেকে বাসায় গিয়ে আরাম করবেন। আর তারা তো সারাদিন এই রাস্তায়ই। উত্তপ্ত পরিবেশে।

আবার সারাদিন কাজের শেষে যে বাসায় গিযে বউ বাচ্চার চেহারা দেখে মনটা জুড়াবে, সেই সুযোগও নাই। ধরেন, আপনি একজন হেলপারের সাথে গালাগালি বা মারামারি করে বাস থেকে নামলেন। আপনি কি জানেনা যে, আপনি নামার সাথে সাথে আপনার গুষ্টি সহ আপনাকে গালাগালি করে? আপনি জানেন। কারন অন্যদেরকে এই গালিটা দেয়ার সময় আপনি বাসে ছিলেন। গালি দেয়াটা একজান ড্রাইভারের আত্নসম্মানের ব্যাপার নয়। গালি খাওয়াটা একজন স্টুডেন্টের আত্নসম্মানের ব্যাপার। গত কিছুদিন আগে ইফতারের আগ মূহুর্তে আমি শাহবাগ থেকে বাসে করে মিরপুরের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু দেখলাম ড্রাইভার অস্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। এই নিয়ে যাত্রীরাও অনেকে অনেক কথা বলেছেন। মিরপুরে গাড়ি থামার পর আমি ড্রাইভারকে বললাম, এত জোরে গাড়ি চালানোর কি আছে? গাড়িতে এত যাত্রী ছিলো। একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো তো। ভদ্রলোক বললো, ‘আপনি এইভাবে ভাবছেন? আর আমি ভাবছি, আমি একটু দ্রুত পৌঁছালে কতমানুষ পরিবারের সাথে গিয়ে ইফতার করতে পারবে।’ এবারও আমার জবান বন্ধ।