কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

প্রতীকী ছবি

কথিত বন্দুকযুদ্ধ এবং একটি জীবন

মোক্তাদির হোসেন প্রান্তিক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯ জুলাই ২০১৯, ১৮:৪৩
আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৯, ১৮:৪৩

(প্রিয়.কম) দেশে প্রতিনিয়তই কোথাও না কোথাও কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচার বহির্হভূত হত্যার খবর পাওয়া যায়।  কখনো অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক/গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে। আবার কখনো বন্দুকযুদ্ধের পর ঘটনাস্থলে আসামি বা অপরাধীর মৃতদেহের সন্ধান মিলছে। বলতে গেলে বন্দুকযুদ্ধ যেন এখন স্বাভাবিক একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেননা ইস্যুটিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর অনির্ধারিতভাবেই পক্ষে-বিপক্ষে দুটো অবস্থান দাঁড়িয়ে যায়। যার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংঘটিত অপরাধের মূল তথ্য-উপাত্ত আড়াল পড়ে যাওয়া শঙ্কা তৈরি হয়। কেউ কেউ আবার এই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের পদ্ধতি বা প্রক্রিয়াকে অপরাধীর দায়মুক্তি হিসাবেও বিবেচনা করছেন। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে এর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করে থাকেন।

সাধারণত কথিত বন্দুকযুদ্ধে ‘চিহ্নিত অপরাধী’ বা ‘সন্দেহভাজন অপরাধী’ বা ‘অপরাধীগণ্য’ কোন ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিহত হওয়া ঘটনা ঘটছে। এ সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্য আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। 

যেভাবে বন্দুকযুদ্ধের প্রচলন: ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাদী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্য নিয়ে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রণজিৎ গুপ্ত ১৯৭৩ সালে এই কৌশলটি প্রয়োগ শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এর নাম দিয়েছিল ‘পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যু’। আর বাংলাদেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত প্রথম ব্যক্তি হলেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদার। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি তাকে আটক করা হয়। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তার লাশ সাভারের তালবাগ এলাকায় পাওয়া যায়। এর দীর্ঘদিন পর বিএনপির শাসনামলে ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে এই পদ্ধতির পুনঃপ্রয়োগ শুরু হয়। যদিও আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অন্তর্গত হওয়ায় শুরু থেকেই এটি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।

৬ মাসে 'ক্রসফায়ারে' নিহত ১৯৩

গত ছয় মাসে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে’ ১৯৩ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। গত ১ জুলাই চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে দেশের প্রধান জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংস্থাটি এই তথ্য দেয়।

সংস্থাটির হিসাব বলছে, ‘গত ছয় মাসে র‍্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ ৫৯, পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ ৯২, ডিবি পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে ‘১২, যৌথবাহিনীর ‘ক্রসফায়ারে’ এক, কোস্টগার্ডের ‘ক্রসফায়ারে’ এক, বিজিবির ‘ক্রসফায়ারে’ ২৮।

সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, গ্রেফতারের আগে ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছেন ১৫১ জন ও গ্রেফতারের পরে ‘ক্রসফায়ারের’শিকার হয়েছেন ৪২ জন। এর বাইরে কারা হেফাজতে আরও ৩০ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। এদের মধ্যে কয়েদি ১০ জন ও হাজতি ২০।’

বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার ইস্যুতে হাইকোর্ট যা বলল

বাংলাদেশে বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে প্রতিনিয়ত ঘটছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। গত ছয় মাসে ক্রসফায়ারে অন্তত ১৯৩ জন নিহত হয়েছেন বলে মানবাধিকার সংস্থার তথ্যে উঠে এসেছে।

হাইকোর্ট বলেছে, এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তারা পছন্দ করে না। সম্প্রতি বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যায় জড়িত প্রধান আসামি নয়ন বন্ডের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হাইকোর্ট এমন কথা বলেছে। 

৪ জুলাই এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হলে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

এ সময় হাইকোর্ট বলেছে, আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যা পছন্দ করি না। নয়ন বন্ড একদিনে তৈরি হয়নি। কেউ পেছন থেকে তাকে লালন-পালন করেছে, ক্রিমিনাল বানিয়েছে।

কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও একটি জীবন 

একরামুল হক কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন, তিনবার পৌর কাউন্সিলর নির্বাচিত ছিলেন। ২০১৮ সালে ২৬ মে তাকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় সে। তবে অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের চেয়ে এটি ছিল ব্যতিক্রম ঘটনা। একরামুল হকের পরিববারের দাবি হত্যা চলাকালে সময়েও পরিবারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে একরামের মৃত্যু ঘটে।

সম্প্রতি বরগুনায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে রিফাত শরীফকে হত্যা করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরাধীকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে দেওয়া হউক এই মর্মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়াজ উঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন পোস্ট দিয়ে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে রিফাতের খুনিদের বন্দুকযুদ্ধ দিয়ে প্রমাণ করে যে তারা ‘‘ভালো’’ উদ্দেশ্যে বন্দুকযুদ্ধ করে। এ রকম যুক্তি আরও অনেক মানুষ তুলে ধরেছেন। 

পত্র-পত্রিকায় গত ২ জুলাই খবরে উঠে আসে বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। 

ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে আইন কী বলে

আইনের ভাষায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুকে বিচারবহির্ভুত এবং বেআইনি হত্যাকাণ্ড হিসাবে দেখা হয়।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের উদ্দেশ্যে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। তারা হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেছে যার সূত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ‘কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না’ এবং ‘কেন এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি কার্যক্রম গ্রহণের আদেশ দেওয়া হবে না’ সে মর্মে কারণ দর্শানোর আদেশ দিয়ে ২৯ জুন ২০০৯ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি একটি রুল জারি করে হাইকোর্ট।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড কখনোই কাম্য হতে পারে না। যেখানে অনেক ঘটনায় বিচারের আগেই শাস্তি হয়ে যায়, সেখানে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। কে অপরাধী আর কে অপরাধী নয়, তা আদালত ঠিক করে দেবে আদালত। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আদালতকে এড়িয়ে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করতে পারে না।  

কথিত বন্দুকযুদ্ধের বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধ, মিসিং বা এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স এগুলোর ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।’

একই সঙ্গে সকল ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানান কাজী রিয়াজুল হক৷

প্রিয় সংবাদ/কামরুল