কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ইতিহাসে ইরান পরমাণু চুক্তিটি ছিল সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি চুক্তি। ছবি: সংগৃহীত

নতুন করে নিষেধাজ্ঞা: ছেড়ে কথা বলবে না ইরান

রুহুল আমিন
জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৮ জুলাই ২০১৯, ১৯:১৫
আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৯, ১৯:১৫

(প্রিয়.কম) ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি থেকে গত বছরের মে মাসে সরে যায় যুক্তরাষ্ট্র। পরে চলতি বছরে ওই চুক্তির শর্তাবলি না মানার সিদ্ধান্ত নেয় ইরানও। এর জেরে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে ইরানের ওপর চাপও বাড়াতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি ইরানের কাছ থেকে যারা তেল কেনে তাদেরকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যেই উপসাগরীয় অঞ্চলে তেলের ট্যাংকারে হামলার ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, ওই হামলার পেছনে ইরানের হাত রয়েছে।

এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যেই ইরানি কর্মকর্তারা তাদের ইউরেনিয়াম মজুদের সীমা বাড়ানোর ঘোষণা দেন। আর ট্রাম্পও ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞার অনুমতি দেন। এমনকি এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনিও। সবমিলিয়ে অবস্থা খুব নাজুক। এই সংকট থেকে উত্তরণের আশু কোনো সম্ভাবনা সামনে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি মধ্যপ্রাচ্যে আবারও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে? নাকি ট্রাম্প কিছুটা নমনীয় হবেন, ইরানও হাঁটবে নিজেদের জন্য ভালো হয় এমন পথে। দেশ দুটির সম্পর্কের চলমান অচলাবস্থা নিয়ে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে একটি মতামত লিখেছেন হোসেইন মৌসাবিয়ান। হোসেইন মৌসাবিয়ান হলেন ইরানের পরমাণু আলোচক দলের প্রাক্তন সদস্য। বর্তমানে তিনি প্রিস্টন ইউনিভার্সিটির সায়েন্স অ্যান্ড গ্লোবাল সিকিউরিটি প্রোগামের পলিসি স্পেশালিস্ট। প্রিয়.কমের পাঠকদের জন্য তার লেখাটি ভাষান্তর করে দেওয়া হলো।

গত বছরের মে মাসে ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির করা চুক্তি থেকে একতরফাভাবে সরে যায় যুক্তরাষ্ট্র। ইরান যেন পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে না পারে এই জন্য এ চুক্তিটি করা হয়েছিল। টানা ১২ বছরের নিরন্তর চেষ্টার পর এবং দীর্ঘ আলোচনার পর এই চুক্তিটি সম্পন্ন হয়েছিল।

নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের। 

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে নতুন করে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আর এই নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য কেবল ইরানের অর্থনীতির বিভিন্ন অংশ না, দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিও এর আওতায় রয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে দৃশ্যত সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক আলোচনার সম্ভাবনার মৃত্যু হলো। শুধু তাই নয়, এর ফলে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি পুরো মধ্যপ্রাচ্য এতে আক্রান্ত হবে। আর বর্তমান পরিস্থিতিও খুবই নাজুক। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতিক্রিয়ায় ইরানও তাদের ইউরিনিয়ামের মজুদ বাড়িয়ে দিয়েছে।

বারাক ওবামার আমলে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হলেও বর্তমানে তা আবার খারাপ হয়েছে। দেশ দুটির মধ্যে রীতিমতো শত্রুতা শুরু হয়েছে। আর মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এই সংকট কাটানো খুবই জরুরি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতি এই সংকট সমাধানে প্রথাগত কূটনীতির রাস্তাও বন্ধ করে ফেলেছে।

পারমাণবিক চুল্লি। 

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংলাপের জন্য দেশ দুটির সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কমান্ড ও ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড সদস্য, এই দুই পক্ষই নিজেদের দেশের সীমা ছাড়িয়ে অভিযানের জন্য দায়ী। রেভল্যুশনারি গার্ডকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দেওয়া হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কমান্ডের বিরুদ্ধে ইরানের বাহিনীর প্রতিক্রিয়া দেশ দুটির মধ্যে আলোচনার সম্ভাবনাকেও নষ্ট করেছে।

অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন খুবই আগ্রাসী এবং অভিনব পদ্ধতিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। যেমন তারা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও দেশটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র ব্যক্তি আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন প্রেসিডেন্টই দেশের বিদেশ নীতি কোন পথে যাবে তার নির্ধারক, তেমনি ইরানে খোমেনিই ঠিক করেন দেশটির বিদেশ নীতি কেমন হবে। আর এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, খোমেনিই সেই নেতা যিনি বারাক ওবামার সময় পরমাণু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসতে ইরানি কর্তৃপক্ষকে অনুমতি দিয়েছিলেন। যে আলোচনার পর ওই পরমাণু চুক্তিটি হয়েছিল।

কিন্তু খোমেনির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে কূটনৈতিকভাবে এই সমস্যা সমাধানের শেষ সুযোগটুকুও নষ্ট করেছেন ট্রাম্প। অন্ততপক্ষে ট্রাম্প যত দিন ক্ষমতায় আছেন তা আর হচ্ছে না হয়তো।

এখানে এটাও উল্লেখ্য যে, খোমেনি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতাই নন, লাখ লাখ শিয়া মুসলিম যারা শুধু ইরানের নয়, ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বাহরাইনসহ অন্যান্য স্থানেরও বাসিন্দা তাদের একজন ধর্মীয় গুরুও।

পরমাণু ইস্যুতে বিশ্ব নেতাদের সম্মেলন। 

শুধু কি তাই, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ট্রেজারারি সেক্রেটারি (কোষাধ্যক্ষ সচিব) স্টিভেন ম্নুচিন বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফের ওপরও কর আরোপ করতে চেয়েছিল। উল্লেখ্য, জাভাদ যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী কূটনীতিক। জাভাদ জারিফকে ইরানের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মোসাদ্দেগ ইরানের তেল ইন্ডাস্ট্রিকে জাতীয়করণ করেছিলেন। তবে ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র যদি কখনো ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি চায় তবে জারিফের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ভুল হবে। কারণ সংকট সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতা জরুরি, আর জারিফ হলেন ইরানের কূটনৈতিকদের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান ব্যক্তি। সুতরাং আলোচনার জন্য তাকে দরকার হবে। এই যেমন ২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের আলোচক দলের নেতৃত্ব দেওয়া উইন্ডি শেরম্যান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কখনো যদি কোনো সংলাপের সম্ভাবনা থাকে, তাতে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করতে পারে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোনো মানে হয় না বলে আমি মনে করি।

পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ইতিহাসে ইরান পরমাণু চুক্তিটি ছিল সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি চুক্তি। আর এর অংশ হিসেবে বরাবরই চুক্তির অন্য পক্ষগুলোর প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করেছে ইরান এবং পরমাণু কর্মসূচি হ্রাসের ক্ষেত্রে সব বিধি-বিধান মেনেছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক আনবিক সংস্থার সাম্প্রতিক এক মূল্যায়নেও। তারা বলেছে, ইরান চুক্তির সব শর্তাবলী সম্পূর্ণরূপে পালন করেছে। তাতে কি হলো, ইরান যখন শর্তাবলী মেনে চুক্তি শেষ করছিল তখন তাকে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা ও চাপ প্রয়োগ করে পুরস্কৃত করা হলো। চুক্তি করে ইরানের লাভ হলো, নতুন করে আবারও নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ল। ওবামা প্রশাসনের কূটনৈতিক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু তারা কি এটা বুঝতে পারছে না যে, এর ফলে কূটনৈতিকভাবে সংকট সমাধানের পথও বন্ধ হয়ে যাবে।

ইরানে অবস্থিত একটি চুল্লি।

ইরান কর্তৃপক্ষ বারবার ট্রাম্পকে আলোচনার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের নেওয়া আগ্রাসী কার্যকলাপে মনে হয়েছে, ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর এখনই সবচেয়ে বেশি যুদ্ধভাবাপন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিন্তু ইরানের এই আলোচনা প্রস্তাব ও একই সময়ে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া দেশটিকে নতুনভাবে কৌশলী হতে বাধ্য করছে।

ইরান বিশ্ব শক্তিগুলোকে অগ্রিম হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, যদি পরমাণু চুক্তির অন্য সদস্যরা চুক্তির ওয়াদা না রাখে তবে তারাও চুক্তির বাইরে গিয়ে কাজ শুরু করবে। আর এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেশটি গত কয়েকদিনে ইউরিনিয়ামের মজুদ ৩০০ কিলোগ্রামের সীমা অতিক্রম করেছে। চুক্তি অনুযায়ী তা করার কথা না। আর এখন তারা বলছে, চুক্তিতে উল্লেখিত ৩ দশমিক ৬ শতাংশ মাত্রার ইউরিনিয়াম মজুদের যে শর্ত ছিল তাও তারা মানবে না।

এ ছাড়া ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি তার মন্ত্রিসভাকে বলেছেন, ইরান আরেক নামের চুল্লিটি পুনরায় তার মূল নকশায় ফিরিয়ে আনবে। দাবি করা হয় যে, ওই চুল্লিতে প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করা যেত। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আশঙ্কার কথা যে, এই প্রথমবার ইরান চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করছে। গত বছর ট্রাম্প প্রশাসন চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার পর থেকে ইরান ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করেছিল যে, চুক্তির অন্য পক্ষগুলো তাদের ওয়াদার প্রতি সম্মান রাখতে এগিয়ে আসবে। কিন্তু এই প্রতীক্ষার ফল কি হলো, তারা নতুন করে চাপে পড়ল এবং নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ল। যখন অন্যরা শর্তাবলী মানছে না তখন ইরানও চুক্তির শর্ত পুরোপুরি মানতে ইচ্ছুক না।

চুল্লি। 

নিজেদের সরিয়ে নিয়ে বিশ্বশক্তি ও ইরানের মধ্যে টানা ১২ বছরের দীর্ঘ আলোচনায় সৃষ্ট চুক্তিটি একাই পণ্ড করে দিলেন ট্রাস্প। তিনি আগ্রাসী নীতি নিয়ে ভয়ংকর পথ বেছে নিলেন। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে আরও একটি ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি স্বীকার করেন যে, ইরানের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষ দেশটির (ইরান) জন্য যেকোনো রকমের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির হবে। তবে তাকে এ বিষয়টিও অনুভব করতে হবে যে, ইরান কখনো তেমনটা হতে দিবে না।

ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যি অপ্রয়োজনীয় ও স্ব-আরোপিত এই সংকট সমাধান করতে চান তবে তাকে খুব দ্রুত তার কৌশল পাল্টাতে হবে। আর তাতে দুটি দেশই নিজেদের রক্ষা করতে পারবে। তখনই আবার দেশ দুটির মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য কূটনৈতিক আলোচনা সম্ভব হবে।

প্রিয় সংবাদ/রিমন