কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

নিহত সাংবাদিক ফাগুন রেজা। ২১ মে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাকে হত্যা করা হয়। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ০৩ জুন ২০১৯, ১৩:২৭
আপডেট: ০৩ জুন ২০১৯, ১৩:২৭

নবারুণ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায় আমি তাকে ঘৃণা করি-’। আমি আমার সন্তানের লাশ সনাক্ত করেছি। কোমল সেই হাসি ভরা মুখটি ছিল, ছেড়া-কাটা। মুখের সব সময়ের ধরে রাখা হাসিটা ছিল অনুপস্থিত। তার বদলে ছেলেটার মুখ জুড়ে ছিল একটা করুণ জিজ্ঞাসা, ‘কী দোষ ছিল আমার’। তার চোখ খোলা ছিল। তীক্ষ্ণ সেই চোখেও ছিল প্রশ্ন, ‘কার কোন ক্ষতি করেছিলাম আমি।’

যেন বলছিল, ‘দেশটাকে ভালোবেসেতো আমি দেশেই ছিলাম। সকল সঙ্গতি থাকা সত্বেও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাইনি পরবাসে। চাইনি অন্যের দেশে সাজাতে নিজের নিশ্চিন্ত জীবন। আমি তো বেছে নিয়েছিলাম, এই দেশকে। জন্মভূমিকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের জন্য যোগ দিয়েছিলাম আরেক মুক্তির যুদ্ধে। নিজের কলমকে অস্ত্র করে তুলেছিলাম। তবে কেন, আমাকে চলে যেতে হলো, কেন আমাকে মেরে ফেলা হলো!’

বাবা হয়ে আমি পড়তে পেরেছি তার চোখে-মুখে উৎকীর্ণ সেই প্রশ্ন। আমি জানি, শুধু অন্ধরা পারে না সেই প্রশ্ন পড়তে। কেবল মূক, বধিররাই নিশ্চুপ থাকে এমন প্রশ্নের মুখে। নবারুণ ভট্টাচার্য লিখলেন, ‘যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না আমি তাকে ঘৃণা করি –’।

আমিও এই হত্যার প্রতিশোধ চাই। চাই ধরা পড়ুক সেই হন্তারকরা। যারা হত্যা করেছে, সেই হন্তারকদের প্রশ্ন করি, তারা কীভাবে নিজের সন্তানের মুখে চুমু খায়। কীভাবে নিজ সন্তানের মায়ের সাথে মিলিত হয়। তাদের হৃদয় কী একটুও কাঁপে না! তাদের কী মনে পড়ে না মৃত্যুর আগে আমার ছেলেটার বিস্ফোরিত চোখ! তাদের চোখে কী কোনো অশ্রুনালী নেই! তাদের চোখ, মুখ, মগজ সবখানেই কী রক্ত চেখে দেখার সাধ! মানুষের শ্বাসনালী চেপে ধরার আনন্দ! আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। চাই হন্তারকের বুক থেকে মুছে যাক হত্যার আনন্দ। তার বদলে তাদের বুকে ভিড় করুক সন্তান হারানোর তীব্র শোক। যে শোক হত্যার চেয়ে তীব্র, মৃত্যুর চেয়েও বিষাদের।

অনেক ভয় পান। মৃত্যুকে ভয় পান, ধ্বংসকে ভয় পান। ভয় পান বলেই ভয় তাদের চেপে ধরে। সারাক্ষণ ভয় নিয়ে বাঁচেন। অন্ধকার ঘরে আঁতকে উঠেন। কাগজের পাতায় নিহতের লাশ দেখে কুঁকড়ে যান। আমি ভয় পাই না। বুক জুড়ে তীব্র হাহাকার ক্রমেই শাণিত হাতিয়ার হয়ে উঠে। আমার ছেলেটা কলম বেছে নিয়েছিল। বংশ পরম্পরায় নিজ থেকে নিজ হাতে তুলে নিয়েছিল সেই মহার্ঘ হাতিয়ার। আমিও এই বয়সে আবার শাণ দিই নিজের জং ধরা অস্ত্রে, কালি ভরে প্রস্তুত রাখি পুরানো কলম। নবারুণ ভট্টাচার্য’র ভাষায় বলি, -

‘ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে
যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে হত্যা করলে
বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাব
আমার বিনাশ নেই-
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
আমার বিনাশ নেই-
সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন
মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।’

পুনশ্চ: যারা এখনো জানেন না, তাদের জানাই- আমি সেই পিতা। যার সন্তান সারা দেশে পরিচিত একজন গর্বিত সাংবাদিক হিসেবে। যে আপোষ করেনি, অসৎ হয়নি। যে বলেছিল, ‘‘I’d rather die like a man, than live like a coward....।” সে বীরের মতন মরেছে, ভীরুরা তাকে মেরে ফেলেছে। একুশে মে রাতে হন্তারকরা আমার একুশ বছরের ছেলেটিকে মেরে ফেলে রেখেছিল রেললাইনের ধারে। যুদ্ধের শুরুতেই শহীদ হওয়া সন্তানের পিতা আমি। সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন আমার ছেলে, এটাই আমার মতো গর্বিত বাবার পরিচয়।

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কমের সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে।]