কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

কিংবদন্তি শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। ছবি: ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি

‘জয় বাংলা না হলে হয়তো আজকে আমি বেঁচে থাকি না’

গোলাম রাব্বানী
ফিচার এডিটর
প্রকাশিত: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২০:০০
আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২০:০০

(প্রিয়.কম) ৩১ আগস্ট, বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট। খুব ভয়ে ছিলাম। ৩০ মিনিট লেট! কী জানি কী বলেন। জলপাই গাছটার পাশে বসে মনে হলো, না বেঁচে গেছি এই যাত্রায়। পাঁচতলার আধখানি ছাদ-বাগানে পিনপতন নীরবতা। কামিনী গাছটার ডালপালার ফাঁক-ফোকরে চোখ রেখে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম কিংবদন্তি শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের ছবি আঁকা। খালি গায়ে ঘাম ঝরছে। পরনে হাফ প্যান্ট। কোমরে গামছা বেঁধে ধ্যানমগ্ন হয়ে ছবি এঁকে যাচ্ছেন একমনে। দুই হাতে রং। হাতে তুলি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু ক্যানভাস। দূরে ঘাপটি মেরে বসে চুপি-চুপি ছবি তুলছেন ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি। গত প্রায় ১০ বছর ধরে শাহাবুদ্দিনের ছবি তুলছেন তিনি। চোখে চোখ পড়তেই ইশারা দিয়ে হায় জানালেন। আমিও শূন্যে ভেসে আসা হায়টা গ্রহণ করলাম।

মূলত আমার কোনো কাজ নেই গাছ দেখা ছাড়া। পুরো ছাদ-বাগানটায় লাল-সবুজের একটা আভা আছে। আম, কামরাঙা, ডালিম, লেবু, পুদিনা পাতাসহ অনেক গাছই অাছে বাগানটায়। এর মাঝে শাহিন নামের একটি ছেলে এসে চা-বিস্কিট দিয়ে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আমি তখনো মানুষটার ছবি আঁকাই দেখছিলাম। এই ৬৮ বছর বয়সেও কোনো ক্লান্তি নেই। অদ্ভুত প্রাণশক্তি তার দেহাবয়বে। চোখ-মুখের অভিব্যক্তিও বলে দেয় কাজের প্রতি তার প্রেম কতটা।

শাহিন এরই মধ্যে ছাদে আরও কিছু চেয়ার ও একটা লম্বা স্কুল বেঞ্চের মতো টেবিল নিয়ে এলো। একটা টেবিল ফ্যান ফিট করা হলো বড় কামিনী গাছটার নিচে। তার সামনেই একটা টেবিল টেনিস খেলার কোট সাজিয়ে রাখল শাহিন। ছেলেটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই কি প্রতিদিন টেবিল টেনিস খেলেন?’ ছেলেটি কাজ করতে করতে বলল, ‘প্রায় প্রতিদিনই খেলেন।’

‘কাদের সঙ্গে খেলেন?’

‘বসেন, একটু পরই দেখতে পারবেন। ওনার সঙ্গে খেলার মানুষের অভাব হয় না।’

কথাটা বলেই ছেলেটা চলে গেল। ফিরে এসে টেবিলের উপর একটা ঠান্ডা পানির বোতল, বেশ কয়েকটা গ্লাস রাখল। আর একটা অ্যাশট্রে। ওদিকে খেয়াল করে দেখলাম ছবি আঁকার রুমটা ফাঁকা। ইফতি ভাইও বের হয়ে চলে এসেছেন। ইফতি ভাইয়ের সঙ্গে আরেক দফা চা পান করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম একটা হালকা সবুজ রঙের শার্ট গায়ে হাফ প্যান্ট পরেই চলে এলেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, ‘তোমার নাম?’

‘গোলাম রাব্বানী।’

‘হুম।’

কথার মাঝেই একটা সিগারেট ধরালেন তিনি। বেশ আয়েশ করে সিগারেটে টান দিয়ে সামনে দাঁড়ানো শাহিনকে বললেন, ‘এদের খেতেটেতে দিয়েছো কিছু?’

শাহিন: জি, চা-বিস্কিট দিয়েছি...

শাহাবুদ্দিন: চা দিলে হইব? মিষ্টি আছে না! মিষ্টি দাও মিয়া।

[শাহিন চলে যায়। আমাদের আলাপ আবার শুরু হয়।]

শাহাবুদ্দিন: তুমি নাকি প্রীতিলতাকে নিয়া কী করতাছো...

প্রিয়.কম: জি, একটা মুভি বানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। স্ক্রিপ্টটা আমার।

শাহাবুদ্দিন: প্রীতিলতার একটা প্রোর্ট্রেট অনেক আগে করেছিলাম। কোথায় যে আছে জানি না। এবার ফ্রান্সে গিয়ে তোমাকে একটা প্রীতিলতার প্রোর্ট্রেট এঁকে দেবো।

প্রিয়.কম: আপনার একটা পেইন্টিং নিয়ে মাসুদ পথিক একটা সিনেমা বানানোর কথা শুনেছিলাম...

শাহাবুদ্দিন: দূর, কিসের সিনেমা! আনা  ওরে খুঁজতেছে। শোনো, আমাদের এখানে অনেকেই আছে, যারা শেষ পর্যন্ত তার আদর্শ ধরে রাখতে পারে না। এ কারণে চারদিকে মানুষের এত অধঃপতন। নোংরা জলের সঙ্গে মিশে যায়। যেমন ধরো আল মাহমুদ কত বড় কবি। অথচ সে মিশে গেল কাদের সঙ্গে?

প্রিয়.কম: কিন্তু আল মাহমুদ আমার কাছে দেওয়া এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন জামায়াত তার বিপদের দিনে পাশে দাঁড়িয়েছে।

শাহাবুদ্দিন: এসব কোনো কথা না।

প্রিয়.কম: মানুষ তো অর্থনৈতিক ক্রাইসিস আর ক্ষমতার কারণেই আদর্শচ্যুত হয়...

শাহাবুদ্দিন: ক্রাইসিস তো সাময়িক। আদর্শটা তো সাময়িক কোনো বিষয় না। আমি কি কম ফাইট করছি জীবনে! কই আদর্শের বাইরে তো যাই নাই।

[শাহিন জিলাপি নিয়ে এসে টেবিলে রাখল।]

শাহাবুদ্দিন: নাও নাও, জিলাপি খাও...

ইফতি: ও জিলাপি খায় না ভাই...

[এর মধ্যে কবি ওসমান গণি নামে একজন এলেন। তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে। ওসমান গণি শাহাবুদ্দিন আহমেদের লেখা মুক্তিযুদ্ধের বইটা পড়ে এসেছেন। এসেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে আলাপ শুরু করেন। শাহাবুদ্দিন আহমেদ তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, ঢাকার যুদ্ধ, কলকাতা, বঙ্গবন্ধু—নানা ইস্যু নিয়ে কথা বলতে থাকেন। এরই মধ্যে কেটে গেল দেড় ঘণ্টা।]

প্রিয়.কম: ভাই, তাহলে ইন্টারভিউটা কবে নিতে আসব? কাল আসি?

শাহাবুদ্দিন: না না, আমি ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যস্ত থাকব। ৫ তারিখ আসতে পারো।

প্রিয়.কম: ভাই, ৫ তারিখ আমার ছেলের জন্মদিন।

শাহাবুদ্দিন: তাহলে ৬/৭ যেকোনো একদিন আসো।

প্রিয়.কম: ধন্যবাদ ভাই।

শাহাবুদ্দিন চলে গেলেন টেবিল টেনিস খেলতে। আজকের সন্ধ্যায় তার পার্টনার কবি ওসমান গণি। আমি চলে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে খেয়াল করলাম পুরো সিঁড়িটাও লাল-সবুজে রং করা। এই লাল-সবুজ মাথায় নিয়েই বাড়ি ফিরলাম।

স্ত্রী আনা ইসলাম এবং দুই মেয়ে চর্চা ও চিত্রর সঙ্গে শাহাবুদ্দিন আহমেদ। ছবি: ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি 

অবশেষে ৮ সেপ্টেম্বর, বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় লক করা হলো। আজ চেয়ার-টেবিল সব গোছানোই ছিল। টেবিল টেনিস খেলছেন যথারীতি কবি ওসমান গণি। তার পার্টনারকে চিনতে পারলাম না। অজয় রায় নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি কলকাতার নির্মাতা। ১০ বছর ধরে শাহাবুদ্দিনকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন। বার্তা সংস্থা বাসসের বার্তা সম্পাদক আয়ুব ভূঁইয়ার সঙ্গেও আলাপ হলো। এক মিনিটের মধ্যে লাল রঙের প্যান্ট আর সবুজ শার্ট পরে চলে এলেন শাহাবুদ্দিন। ভেবেছিলাম আমাকে চিনতে পারবেন না। দেখেই মুখে হাসির রেখা টেনে বললেন, ‘কি চলে এসেছো তাহলে?

প্রিয়.কম: জি, চলে এলাম...।

চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘চলো তাহলে শুরু করে দিই।’

প্রিয়.কম: প্রথমেই আপনাকে ৬৯তম জন্মদিনের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানাই। জন্মদিনের দিন ঘুম থেকে উঠে প্রথম যে কাজটা করতে মন চায়। আপনি কি কারো জন্য অপেক্ষা করেন...

শাহাবুদ্দিন: ঘুম থেকে উঠে ছবি আঁকতেই মন চায়। অপেক্ষাও করি একটা ভালো ছবির জন্য।

প্রিয়.কম: আপনি ঘুম থেকে উঠে আগে দাঁত ব্রাশ নেন না রঙের ব্রাশ...

প্রশ্নটা শুনে হেসে দিলেন শিল্পী। তারপর বললেন—

শাহাবুদ্দিন: আরে না না...ব্রাশ করে খেয়েদেয়ে তবেই তো ছবি আঁকতে বসি। আমি ঈদের দিনও ছবি আঁকি।

প্রিয়.কম: আপনি প্রতিদিন ছবি আঁকেন। এই যে আপনি বললেন ঈদের দিনও ছবি আঁকেন। প্রতিদিন ছবি আঁকার জন্য তো একটা অনুপ্রেরণা বা দমের দরকার হয়। এত দম পান কোথায়?

শাহাবুদ্দিন: দমের বিষয়টা তো আর এক দিনে ঘটে না। ফট করে কি আর হয়? আমি একটু অন্যভাবে বলি, যেমন ধরো রবি শঙ্কর, এত বড় পণ্ডিত; উনি প্রতিদিন সকালে উঠে রেওয়াজ করতেন। না করলেও তো চলত ওনার। কিন্তু না, কোনো প্র্যাকটিক্যাল কাজ চর্চা না করলে ধীরে ধীরে নিচে নামে। সো, এটা একটা ভয় ঢোকে। তাই নিয়মিত চর্চা করতে হয়।

প্রিয়.কম: কিন্তু অনেকেই তো বলে থাকেন শিল্পীরা একটু অলস প্রকৃতির হয়...

শাহাবুদ্দিন: অলস প্রকৃতির হয়, অন্যান্য বিষয়ে অলস [টেবিলের রাখা মোবাইল ফোন দেখিয়ে] এইগুলো হ্যান্ডেল করতে অলসতা আসে। 

প্রিয়.কম: সংসার জীবনে...

শাহাবুদ্দিন: নো...নো...সংসার জীবনে উল্টা, আমি সব করি। না, আমি বলছি ধরো আগেকার যুগের শিল্পী আর এখনকার যুগের শিল্পীর মধ্যে কোটি কোটি তফাৎ। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। ঝোলা নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে শিল্পী—ওই যুগ চলে গেছে। তখনকার সময়ে আর্থিক-সামাজিক যে অবস্থা ছিল, গোলা ভরা ধান ছিল। বুঝতে পেরেছো, এগুলো ব্যাপার আছে কিন্তু। এখন তো কম্পিটিশনে নেমে গেছে সবাই। তুমি কম্পিটিশনে নাই, তার মানে তুমি হারিয়ে গেলে অনেক জিনিস। মনে হয় না কোনো শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি তার কাজের জন্য অলস।

প্রিয়.কম: যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা গালফ কোস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলেছেন অলসরা নাকি বেশি বুদ্ধিমান হয়...

শাহাবুদ্দিন: তা জানি না। বুদ্ধিমানরা অলস হয়, শোনো, যেকেনো ক্রিয়েশনে কারো যদি বুদ্ধি না থাকে তাহলে সে ক্রিয়েশন করবে কী করে? যেমন ধরো সুলতান ভাই বলো, জয়নাল আবেদিন বলো বা বঙ্গবন্ধুর কথাই বলি, তারা রিয়েল ক্রিয়েটর। তাদের কিছু কিছু জায়গায় আছে দেখবে একেবারে নতুন ফর্মুলা, এদেরকে অনেক ফর্মুলার সঙ্গে মেলানো যায় না। একই ব্যাপার আসে আইনস্টাইন, পিকাসোর বেলাতেও।

প্রিয়.কম: আপনার শৈশব তো আলগীতেই কেটেছে...

শাহাবুদ্দিন: আমি ক্লাস থ্রি পর্যন্ত আলগীতেই ছিলাম। মনে আছে, মাটির শ্লেটে আমি তখন লিখতাম। তখনকার সময় তো পড়ালেখা, স্কুল অন্য রকম ছিল। এত ক্লাস করতে হতো না। ক্লাস থ্রি শেষ করে আমরা কলাবাগানে আসি। এখানে আমার মামার বাড়িতে থেকেই আমরা তিন ভাই লেখাপড়া করতাম। ছুটি হলেই আবার গ্রামে চলে যেতাম। আমাদের বাড়িটা মেঘনা নদীর পারেই। যখন বর্ষা আসতে তখন আমরা চকিতে বইসা মাছ ধরতাম। যেমন ধরো সাঁতার কাটাটা কবে যে হয়েছে জানি না। অনেকেই বলে না সাঁতার জানে না, আমার খুব অবাক লাগে কিন্তু শুনলে। দেখবে ঘুরে-ফিরে শৈশবই কিন্তু মূল চাবিকাঠি। আমি মেঘনা পারের ছেলে, এটা ভাবতেই মন বড় হয়ে যায়। ক্লাস থ্রি, ফোর, ফাইভ, সিক্স—এরপর তৈরি হলো আমার অন্য জগৎ।

প্রিয়.কম: ছবির জগৎ...

শাহাবুদ্দিন: হ্যাঁ, ছবির জগৎ, কেন হলো, কীভাবে হলো আমি জানি না। ছবি নকল করতে করতেই ছবি আঁকা শুরু।

নিজ গ্রামে মেঘনা নদীতে নৌকায় শাহাবুদ্দিন আহমেদ। ছবি: ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি 

প্রিয়.কম: আপনার গ্রাম আলগীতে কি কোনোদিন জন্মদিন পালন করেছেন?

শাহাবুদ্দিন: না, জন্মদিন বলতে এখন যা হয়, এইগুলি তো কোনোদিন ছিল না আগে। ইদানীং এইগুলি ইউরোপ থেকে এসেছে। যেমন ভ্যালেনটাইনস ডে। এসব কী সব ডেস-মেস। এইগুলো যেহেতু ইউরোপের কালচার থেকে নেওয়া, এইগুলা গিলে ফেলতেছে তোমাদের-আমাদের। আমাদেরটা ওরা নেয় না।

প্রিয়.কম: আপনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘সৃষ্টি খুব বিপজ্জনক শব্দ, এটি ঈশ্বর প্রদত্ত বিষয়। এটা কারো জীবনে একবারই ঘটে। সবাইকে দিয়ে কিন্তু সবসময় সবকিছু হয় না। চিত্রকলা অনেক কঠিন কাজ। এই শিল্পকে আত্মা ও উপলব্ধি দিয়ে জয় করতে হয়।’ তার মানে আপনি ভাগ্যে বিশ্বাস করেন...

শাহাবুদ্দিন: এটার সঙ্গে তো ভাগ্যের ব্যাপার না। একটা ফিলোসফি। আসলে সৃষ্টি যখন কেউ বলে না, তখন আমার খুব হাসি লাগে কিন্তু, মনে হয় কত সহজ। সৃষ্টি সহজ নয়। তাহলে তো সবাই করত।

প্রিয়.কম: এ কারণে এটাকে আপনি বিপজ্জনক শব্দ বলতে চাচ্ছেন?

শাহাবুদ্দিন: বিপজ্জনক বলছি গুড ওয়েতেই। নট বেড ওয়ে। যেমন ধরো আমি বলছি...

প্রিয়.কম: মানে গভীরতা অর্থে...

শাহাবুদ্দিন: হ্যাঁ, গভীর, আরে লোকটা খুব ডেঞ্জারাস বলে ফেলি না...

প্রিয়.কম: হ্যাঁ, হ্যাঁ...

শাহাবুদ্দিন: এর মানে কী? লোকটা ভালো বা লোকটা খুব ক্ষমতাবান। ওইভাবেই বুঝাতে চেষ্টা করেছি।

প্রিয়.কম: ভাগ্যে বিশ্বাস করেন আপনি?

শাহাবুদ্দিন: লাকটা কিন্তু...আমি কনফিউজড, নিশ্চয় লাকের একটা ব্যাপার আছে। বুঝেছো...মাঝে মাঝে মনে হয় ভাগ্যের প্রয়োজন আবার মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি নিজেই তো একটা ভাগ্য।

প্রিয়.কম: এটা একটা রহস্য?

শাহাবুুদ্দিন: হ্যাঁ, সব জিনিস যদি জেনেই ফেলি বা জানি, মনে হয় মানুষের আর তখন কিছু দেওয়ার থাকে না। আর এই মিস্টেরিয়াস বিষয়টাই কিন্তু আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়। যার ফলে আমরা আগাচ্ছি, চিন্তা করছি। যেমন ধরো, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই যে ধরো মঙ্গলগ্রহে যাচ্ছি, এতে করে কিন্তু পৃথিবীটার অন্য রকম পরিবর্তন দেখা দেবে। যেমন আমরা একবার চাঁদে যাওয়ার পর পরিবর্তন ঘটে গেল পৃথিবীর। আমাদের চিন্তাধারা বদলে গেল। এ রকম মঙ্গলে যখন যাবে, আমরা অনেক জিনিস জেনে ফেলব।

[আরেক দফা চা দিয়ে গেল শাহিন। টেবিল টেনিস খেলা শেষ করে অাড্ডায় যুক্ত হন কবি ওসমান গণি। ছবি তুলে যাচ্ছেন ইফতেখার ওয়াহিদ। তথ্যচিত্র নির্মাতা অজয় রায় একবার এসে জানিয়ে গেলেন তিনি রান্নার আয়োজন করছেন। বাসসের নিউজ এডিটর আয়ুব ভূঁইয়া মাঝেমধ্যে নিজের মতামত যুক্ত করছেন আলাপে।]

চায়ের মগে চুমুক দিয়ে শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘তারপর বলো...’

প্রিয়.কম: এখন তো লোকজনের শিল্পচর্চায় আগ্রহ বেড়েছে আগের তুলনায়। আপনার কি মত?

শাহাবুদ্দিন: ধান উৎপাদন হয় না, এভাবে আমাদের শিল্পীদের উৎপাদনটা বাড়ছে। তো উৎপাদন বাড়লে তো চোখে পড়বে। সেটা হয়েছে। আগে তো ডেকে ডেকে ছাত্রদের আনতে হতো। এখন প্রচুর স্কুল-কলেজ হয়েছে আর্ট বিষয়ে। লোকজনের আগ্রহ বেড়েছে।

প্রিয়.কম: শিল্পচর্চায় ইজম কতটা জরুরি? দুনিয়ায় এত এত ইজম তৈরি করে কী লাভ? আমরা কি ইজম তৈরি করব নাকি শিল্প?

শাহাবুদ্দিন: কিসের ইজম! এগুলো অন্যরা তৈরি করে হিসাব-নিকাশ করে। এটা আর্টিস্টের কাজ না। যেটা আমাদের দেশে হবে স্বাধীনতার আগে ও পরে। ওরা যেভাবে থেকেছে, খেয়েছে আমরা সেভাবে নেই।

প্রিয়.কম: যেহেতু ইজম প্রসঙ্গটা এসে গেল, তাহলে জানতে চাই বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিল্পী সংঘ গড়ে উঠেছে, যেমন স্কেচ গ্রুপ, সেঁজুতি, ফাইভ ফিঙ্গার, ঢাকা আর্ট গ্রুপ, আর্ট গ্রুপ—এসব সংঘ কি আদৌ কোনো বড় শিল্পী বা শিল্পকর্ম তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে?

শাহাবুদ্দিন: সেঁজুতি, তুমি দেখলাম সেজুঁতির নাম নিছো?

প্রিয়.কম: জি, সেজুঁতি...

শাহাবুদ্দিন: [হেসে বললেন] আমিই সেজুঁতির প্রেসিডেন্ট ছিলাম। পৃথিবীর সব দেশেরই শিল্পীদের একটা সমিতি থাকতে হয়। যেমন ধরো প্রাগৈতিহাসিক সময় খণ্ড খণ্ড গোষ্ঠী ছিল, এখানে গান-বাজনা হতো, ওখানে মারামারি হতো। এভাবে কিন্তু সভ্যতার অগ্রসর হয়েছে। এই সংঘ কখন তৈরি হয়, যখন তুমি সভ্যতার দিকে এগুবা। না হলে তো একজন-দুজন দিয়া কী করবা। এতে শিল্পের প্রসার বাড়ে, কম্পিটিশনটা বাড়ে। নার্ভের কিন্তু ব্লাড সার্কুলেশন প্রয়োজন হয়। ধরো তোমার নার্ভ ঠিক আছে কিন্তু ব্লাড সার্কুলেশন নেই, তখন দেখবে বডি কাজ করছে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছবি আঁকছেন শাহাবুদ্দিন। ছবি: ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি 

প্রিয়.কম: শিল্পীর রাজনৈতিক পরিচয় থাকাটা কতটা জরুরি, থাকলে ভালো নাকি না থাকাই ভালো...

শাহাবুদ্দিন: অফকোর্স, অফকোর্স, সোসাইটির শিল্পীরা কে আছে রাজনীতি ছাড়া দেখাও। পিকাসোর গোয়ের্নিকার কথা একবার ভাব। শিল্পী অটোমেটিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। যখন আমি গান্ধী [মহাত্মা গান্ধী] আঁকতেছি, তার চেহারার কারণে তো আঁকি না। আমি আঁকি আমার অন্য কারণে। ফিলিংস, একটা লোক কী করে না খেয়ে এভাবে আন্দোলন করতে পারে! পুরো ভারতবর্ষ ঘুরল। মিস্টিরিয়াস! এত শক্তি কী করে হলো!

প্রিয়.কম: আপনিই তো প্রথম বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছিলেন...

শাহাবুদ্দিন: প্রথম ছবিটা আঁকি কলকাতার ক্যাম্পে। ওই ছবিটা সংরক্ষণ করতে পারিনি। পরের ছবিটা আঁকছি দেশ স্বাধীনের পর। উনি আসলেন ১০ জানুয়ারি। আমার সঙ্গে দেখা হয় ২২ জানুয়ারি। আমরা সবাই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘এই তুমি কী করো, তুমি কী করো।’ আমি জানি প্যাঁচটা লাগবে আমারটা আসলেই। নতুন পাবে। আমাকে জিজ্ঞেস করার পর বললাম, ‘আমি আর্ট কলেজে পড়ি।’ তিনি বুঝতে না পেরে বললেন, ‘কী বললে?’ আমি তখন বললাম, ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আর্ট কলেজে ছবি আঁকি।’ এটা শুনে তিনি বললেন, ‌‘ছবি আঁকো?’ এটা বলে যে একটা তাকানি দিলেন। ‌‘ছবি আঁকো...’ বলে আবার বললেন, ‘আচ্ছা’, ‘ছবি...’ মানে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এই যে তাকালেন, এই তাকানোতেই আমি কাপুত। মনে হচ্ছে যেন আমার বাবা আমাকে বলছেন বড় শিল্পী হও। তারপর বললেন, ‘আমাকে তোমার ছবি দেখাইও তো’। আমি বললাম, ‘আনব।’ এই যে বলছি আনব পরে আর রাতে আমার ঘুম হয় না। তো ওই ছবিটি ছিল জেলখানার। যেটা আমি ইমাজিন করে আঁকি। এরপর নিয়ে গেলাম। ওইদিন কেবিনেট মিটিং হচ্ছিল। তখন ১৪ জন মন্ত্রী। ছবিটা অন্যরা দেখে ফেলবে এই লজ্জায় সাদা কাপড় প্যাঁচাইয়া ছবিটা নিয়া গেছি। সবাই দেখতে চায়। আমি বলি, ‘না... না...উনি দেখবেন।’ এক ঘণ্টা পর ওনার দেখা পেলাম। আমাকে দেখে বললেন, ‘আয় আয় ‘ আমার তখন লজ্জা লাগতেছিল, তার ওপর নার্ভাস। ছবিটা দেখার পর উনি হাতের পাইপটা রেখে দিয়ে বললেন, ‘এত বড় ছবি! আমি তো এত বুঝি না, তবে কোথায় যেন ব্যথা-বেদনা আছে রে।’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনাকে চিন্তা করেই আঁকছি।’ তারপর বললেন, ‘এই ছোট্ট ছেলে যুদ্ধ করেছে আবার ছবিও আঁকে। এই তাজউদ্দীন এই। আহ! কী সুন্দর...সুন্দর! বিদেশিদের বলো, আমাদের ছেলেরা যুদ্ধ করতে জানে আবার ছবিও আঁকতে জানে।’ টাকা দিতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘না, টাকা দিলে আমি জীবনেও আসব না।’

তিনি বলে থাকেন বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ আর ছবিই তার জীবনের মূল শক্তি। ছবি: ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি

প্রিয়.কম: শিল্পীর ইমোশন বা আবেগ থাকাটা কতটা জরুরি...

শাহাবুদ্দিন: আমাদের এই অঞ্চল কিন্তু পুরাই ইমোশনে ভরা। কিন্তু যখন তুুমি টেকনোলজি দিয়া ইমোশন কন্ট্রোল করতে চাচ্ছ, তখনই কিন্তু সমস্যা। ইউরোপে ইমোশন স্টপ কইরা দিচ্ছে। এটা ইচ্ছা করে দেয় নাই। করতে করতে হয়ে গেছে। যার ফলে দেখবা ইউরোপ-আমেরিকা ডোমিনেট করে পুরো বিদেশিরা। কারণ বিদেশিরা ইমোশন নিয়ে যায় ওখানে।

প্রিয়.কম: শিল্পের রহস্য...

শাহাবুদ্দিন: একটা রহস্য তো থাকতেই হবে। সেটা তুমি ফিল্ম বলো, কবিতা বলো বা আর্ট ওয়ার্ক। দুর্গা যখন কাশবনে অপুকে খুঁজছিল। ডাকছে, অপু...ট্রেনের সে কী আওয়াজ, পুরো সিচুয়েশনটা মিস্টিরিয়াস করে ফেলেন সত্যজিৎ। এ কারণেই তিনি গ্রেট। ছবিটা তোমাকে জাগাল, চিন্তা করতে দিচ্ছে। এরপর তো বুঝে ফেললা। পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রেও কিন্তু একই। রং আর রেখা দিয়ে কীভাবে বুঝাবা? এগুলো করতে করতে অটোমেটিক চলে আসে। এই অটোমেটিক যতক্ষণ না হবে যতই আঁকো না কেন, কোনো লাভ হবে না। যেমন ধরো যখন জিদান ফুটবল খেলে, অনেক জিনিস করতে করতে ফট করে কী একটা যেন করে ফেলে ও নিজেও জানে না। এই জিনিসটা প্র্যাকটিস করতে হয়। এ জন্যই চর্চা। এটা অনেকটা ধর্মের মতো। বডি চায়, আকর্ষণ করে। যাকে আকর্ষণ করে না সে হয় অলস, তখন সে হারিয়ে যায়। প্রতিদিনই হারায়। আবার আনতে হয়।

প্রিয়.কম: আপনি একজন নাইট উপাধি পাওয়া শিল্পী, দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বিশ্বশিল্প সংস্কৃতির ভুবনে আপনি একটি নাম না শুধু, একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আপনি আপনার শেকড় ভুলতে পারেননি এখনো। যেমন আপনার উচ্চারণে আলগীর টান আছে। ছবি আঁকেন কোমরে গামছা বেঁধে। তথাকথিত ভদ্রলোকদের সমাজ কী বলে আপনার এই আঞ্চলিকতা নিয়ে...

শাহাবুদ্দিন: শোনো, ধরো আমি বাইরে সবার সামনে একরকম করে কথা বলছি, আবার বাসায় গিয়ে ইংরেজিতে কথা বলছি। এটা কিছু হইল? যা বিশ্বাস করি অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করি। আমি ভেতরে-বাইরে একই মানুষ। লোক দেখানো কিছু নাই আমার ভেতর। এক জীবনে কম তো দেখিনি। বাংলাদেশ থিকা প্যারিস গিয়া ফরাসিরা না যতটা কোট-টাই পরে, আমাদের এখানকার অনেকে তার চেয়ে বেশি কোট-টাই পরে থাকে। নকল বাবুগিরি তো ভালো না। আমারে নিয়া কে কী কইলো তা নিয়া তো ভাবি না।

প্রিয়.কম: আপনার ছবির পুরুষ চরিত্রগুলো অনেক বেশি দানবীয় রূপে শক্তিমান হয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। কিন্তু নারীকে আপনি কোমলতার জায়গাতেই রেখেছেন। নারী কি শক্তির রূপ হতে পারে না আপনার ছবিতে?

শাহাবুদ্দিন: না, অনেক ছবি আছে। তুমি কয়টা দেখছো?

প্রিয়.কম: আমি যে কয়টা দেখেছি সে জায়গা থেকে বললাম।

শাহাবুদ্দিন: কিন্তু অনেকে তো উল্টা বলে যে আমি মেয়েদের পুরুষ বানিয়ে দিচ্ছি। কেন হোমো সেক্সুয়াল, লেসবিয়ানরা কি মানুষ না?

প্রিয়.কম: ভারতে সম্প্রতি সমকামিতা বৈধতা পেয়েছে। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। আপনি কি সমকামিতা সমর্থন করেন?

শাহাবুদ্দিন: এগুলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না আমার কাছে। হিউম্যান সারা জীবন থাকবে, আছে। যেগুলো আগাচ্ছে আবার ভাঙবে, এগুলো নরমাল। এগুলো খুব সস্তা পলিটিক্স, যারা অরডিনারি পলিটিক্স করে।

প্রিয়.কম: সেক্স নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে ইচ্ছে করছে...

শাহাবুদ্দিন: সেক্স তো একটা পাওয়ার। যখন যার দরকার তখন সে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সেক্সটা খুব বাজেভাবে ব্যবহার করা হয়।

[হুট করে বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকার নেমে আসে ছাদে। কিন্তু কথা থামে না। অন্ধকারেই কথা বলে যান এই গতির কারিগর। নীরব শ্রোতা হয়ে আলাপে মগ্ন অন্যরা।]

নিজের রঙের মতোই রঙিন থাকতে পছন্দ করেন এই শিল্পী। ছবি: ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি

প্রিয়.কম: আপনি তো দেশপ্রেম আর মুক্তিযুদ্ধের কারণেই অধিকাংশ সময় লাল-সবুজ রং পরে থাকেন...

শাহাবুদ্দিন: এটা ঠিক আমি মুক্তিযোদ্ধা বলে এই রংটা ক্যারি করি। বহন করি আমি। ঢাকা আসলেই যে পরি এমন না। বরং প্যারিসে বেশি পরি। এগুলো অর্থবিহীন বেকার আলাপ না। জয় বাংলা তোমার-আমার বইলা লাভ নাই। আমি বিদেশিদের বলি জয় বাংলা বলে খা। ইটস নট ইজি জব। জয় বাংলাটা কেন? এটাও একটা বিরাট ইতিহাস আমার জন্য। অন্যরা কীভাবে এটা নেয় আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ না। জয় বাংলা না হলে আজকে আমি বেঁচে থাকি না।

প্রিয়.কম: চিত্রসমালোচকরা বলে থাকেন যে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের শিল্পীরাই সবচেয়ে বেশি পশ্চিমা আর্ট ফর্ম দ্বারা প্রভাবিত। দেশীয় সংস্কৃতি তাদের আর্ট ফর্মে আসে না। আপনার কী মত?

শাহাবুদ্দিন: এটা এক দিনে ঘটে নাই। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। এর আগে কী বলো। যেমন জয়নাল আবেদিন, কামরুল হাসান, ওনাদের কাজ দেখলে কিন্তু আরেকটা ধারা পাওয়া যায়। জয়নাল আবেদিন স্যারের কাজ দেখলে দেখবে একটু ওরিয়েন্টাল, জাপানিজ আবার ইউরোপ, মিক্সড হয়ে একটা জয়নাল আবেদিন। আবার কামরুল হাসান দেখবে ইন্ডিয়ার ভাবটাব নিয়া হইছে। সুলতানেরও মিক্সড ইউরোপিয়ান আবার কেমন কেমন যেন। আমিনুল ইসলাম বলো, রশিদ চৌধুরী, মুতর্জা বশির, কিবরিয়া—এরা সম্পূর্ণ ইউরোপিয়ান। যেহেতু ফ্রন্টইয়ার ওরা খুঁজে পাচ্ছিল না নতুন। প্রভাবটা একদিক দিয়া ভালো। অনেকগুলো ফ্যাক্টর আছে। সংগীতের যন্ত্র দেখো। আমাদেরগুলো ডোমিনেট করে কিন্তু তারপরেও ডিশুম ডিশুম চলে আইছে।

প্রিয়.কম: আপনার প্রিয় সাদা রং...

শাহাবুদ্দিন: যেমন কাশফুল সাদা। কত দেখছি কত ছিঁড়ছি। কোনোদিন কিন্তু খেয়াল করি নাই কাশফুল এত সুন্দর হতে পারে। ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে কাশফুলকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে, সত্যজিৎ রায়ের ছবির ওই দৃশ্যটা মুগ্ধ করে ফেলল। ওখান থেকে সিদ্ধান্ত নিছি, আমি ওই সাদাই ব্যবহার করব। ইশ! দৃশ্যটা চোখে ভাসে, ট্রেনের ধোঁয়া চলে যাচ্ছে কাশফুলের বনের ভেতর দিয়ে। উনি যে কী ট্যালেন্ট লোক! দ্বিতীয়ত ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলার সময় সাদা ড্রেস পরতাম। আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। আগের পোশাক-আশাক দেখবা সব সাদাই ছিল। এটা আমাকে আকর্ষণ করেছে। কালার করো আর যা-ই করো, দেখবা সাদাই ডোমিনেট করে। তৃতীয়টা হলো ক্যানভাসটা তো সাদা। না ঘষাইয়া, না নাড়াইয়াও তো এটা ইউজ করতে পারি।

কাশফুলের শুভ্রতায় শাহাবুদ্দিন। ছবি: ইফতেখার ওয়াহিদ

প্রিয়.কম: প্যারিসে যদি না যেতে পারতেন...

শাহাবুদ্দিন: প্যারিসে না থাকলে আমার কী হতো জানি না। তবে এটা জানি, ওখানে না গেলে স্পেসের বিষয়টা জানতাম না। ওখানে যাওয়াতে আমি ফিল করতে পারলাম যে স্পেস খুব ডেঞ্জারার্স জিনিস। একটা মারাত্মক ব্যাপার।

প্রিয়.কম: আপনিই বাংলাদেশের একমাত্র শিল্পী, যার ছবির দাম শুরু হয় ১০ লাখ টাকা থেকে। এখন কথা হচ্ছে, সমাজের মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তরা তো আপনার ছবি কেনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চিত্রকর্মকে কি আপামর জনতার জন্য করা যায় না?

শাহাবুদ্দিন: ছবি কিনতে পারো না। আমারও তো জীবন আছে। ছবি কিনবা, সামনে ড্রইং এক্সিবিশন করব। ছোট ছোট ড্রইং করব, যাতে কিনতে পারো। কিছু কিছু বিষয় থাকে, যা সবার টাচ করতে হয় না। ছবি তো মাছ না যে আমি মাথায় করে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করব। আমি যখন ঢাকায় ছবির দাম বাড়ালাম তখন ঢাকার অনেক শিল্পীই মন খারাপ করেছিল। তখন তারা বলছিল যে আমি নাকি তাদের বাজার নষ্ট করে ফেলেছি। অথচ এখন তারাই লাখ লাখ টাকায় ছবি বিক্রি করে। শিল্পকর্মের তো আসলে দাম হয় না।

[বিদ্যুৎ চলে এসেছে অনেকক্ষণ। শাহিন একটা বোলে করে পেঁয়াজ, মরিচ, চানাচুরসহ মুড়ি দিয়ে গেল। শাহাবুদ্দিন আরও তেল আনালেন। তেল ঢেলে লবণ দিয়ে নিজের হাতে মুড়ি মেখে সবাইকে খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। মুড়ি খেতে খেতে মুড়িবিষয়ক আলোচনা শুরু হয় আমাদের।]

আয়ুব ভূঁইয়া: আগে তো আমাদের আড্ডার মূল আকর্ষণ ছিল মুড়ি। শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের একজন ভাই আছেন; তিনি আমাদের মুড়ি মাখিয়ে দিতেন। এখানে এলে প্রকৃত বাংলাদেশের আপ্যায়ন পাওয়া যায়।

প্রিয়.কম: প্যারিসে মুড়ি পান কোথায়...

শাহাবুদ্দিন: পাওয়া যায়, ওগুলো পচা। মাঝেমধ্যে আপা [প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা] গেলে তিনি নিয়ে যান। মাঝখানে যাওয়ার কথা ছিল তখন আমি বললাম, ‘আমার জন্য মুড়ি নিয়ে আসবেন।’ তিনি বলেন, ‘ধুত, মুড়ি-টুড়ি এটা কোনো জিনিস হলো! আর কী?’ আমি বললাম, ‘আর কিছু না, মুড়িই লাগবে।’ পরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার আর যাওয়া হলো না, আমার মুড়িও পাওয়া হলো না। তিনি যখনই যান আমার জন্য মুড়ি নিয়ে যান।

প্রিয়.কম: সত্যজিতের কথা বলছিলেন, সেই সূত্র ধরে বলি, বাংলাদেশের নৃত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক নিয়ে আপনার অবজারভেশন শুনতে চাই...

শাহাবুদ্দিন: সিনেমা? আর্ট আর্টই, আর্টফিল্ম করাটা কঠিন। দেশের যে পরিস্থিতি, ইকোনোমি, নট সস্তা। সবাই চেষ্টা করছে। শর্টফিল্ম আর আর্টফিল্ম কোটি কোটি তফাৎ। অন্যরা কী ভাবে জানি না। তবে আমার কাছে শর্টফিল্ম হচ্ছে স্টাডি। কিন্তু সত্যি সত্যি ফিচার ফিল্ম করা, অনেক দক্ষতা লাগবে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ডিকটেটরশিপ থাকতে হবে। কারিশম্যাটিক হতে হবে। যেটা এখন অব্দি আমাদের বাংলাদেশে হয় নাই।

অজয় রায়: ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’, কেন...‘জীবন থেকে নেওয়া’...আছে না!

শাহাবুদ্দিন: এগুলো বলার জন্য বলা। এখন আবার দেখেন। দেখে হাসবেন। নাটক। তখনকার সময় আমাদের এডুকেশন। আমার কোনোটাই ভালো লাগে না। আজ অব্দি যত কিছু দেখছি, তার মধ্যে ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ বেটার, আর ধরো, ‘মাটির ময়না’, না। তবে একটাই আমার বুকে লাগছে, সেটা হলো ‘মুক্তির গান’। আমি দেখে কেঁদেছি। এগুলো হলো গভীরতা। তুমি কাকে ভালোবাস, তুমি ছাড়া তো আর কেউ জানে না। তুমি বলতে পারো আমাকে, অনেক কিছু ভালোবাসি, এই করি, সেই করি। আসলে আমি জানি আমি কাকে ভালোবাসি। ‘মুক্তির গানে’র একটি দৃশ্যে ওরা যখন প্রথম মাটি ছোঁয় এবং সোনার বাংলা বলে মাটিতে চুমা দেয়—এটা একটা বিরাট জিনিস।

শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বলিউড অভিনেত্রী শাবানা আজমি। ছবি: ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি 

প্রিয়.কম: গানে বা কবিতায়...

শাহাবুদ্দিন: গান অনেক হয়েছে। কবিতাও। সিনেমটা একটু দুর্বল হইয়া গেছে। নাটক আগাইছে। টাকা হলেই যে সিনেমা হবে আর টাকা হলেই যে আর্ট হবে—এগুলো সম্ভব না। অনেকেই বলে টাকা নাই তাই সিনেমা বানাইতে পারছি না। আরে একটা ক্যামেরা দিয়াও তো সিনেমা বানাইতেছে না।

[আবার বিদ্যুৎ চলে গেল। অন্ধকারেই বসে আছি আমরা। শাহাবুদ্দিন ঘামছেন। কিন্তু এক বিন্দু ক্লান্তি তার চোখে-মুখে দেখা যায় না। কথা বলে যাচ্ছেন।]

প্রিয়.কম: আমাদের এই অঞ্চলে আপনার আগে এসএম সুলতানের ছবিতে বিপুল পেশিবহুল ক্যারেক্টার পাওয়া গেছে। এসএম সুলতান নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী...

শাহাবুদ্দিন: সুলতানের পেশি আর আমার পেশির মধ্যে কোটি কোটি তফাৎ। এমনিতে মনে হতে পারে, যেহেতু ফিগার আছে বলে। কিন্তু স্পিরিচুয়াল বলো বা ফিলোসফি, এক না। কারণ ওনার দেখা আর আমার দেখার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। ওনার জগৎটা ধরো এই যে, বাউল-টাউলের ভাব, প্রকৃতি, ন্যাচারের কাছে গিয়ে বসবাস করা, পশু-পাখি নিয়ে ওই জগৎ। আর এখনকার মেশিন মেকানিকের জগৎ। আমি প্যারিস থাকি। এগুলো চিন্তা করলে তো লাভ নাই। লজিক থাকতে হইব তো। তবে এটা সত্য, সুলতানের মতো শিল্পী আর হবে না। এটাই শেষ অধ্যায়। এখন অন্য জিনিস হবে। এটাই তার নিজস্বতা।

প্রিয়.কম: আমাদের এই উপমহাদেশে মকবুল ফিদা হুসেন তার চিত্রকর্মের জন্য বেশ আলোচিত। তার সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন কী?

শাহাবুদ্দিন: শুধু এই উপমহাদেশ না, উনি ওনার কাজের জন্য গোটা বিশ্বের কাছে প্রশংসিত। গ্রেট আর্টিস্ট। নিজের ছবির আলাদা ভাষা তৈরি করতে পেরেছিলেন। যার চিত্রকর্মে ভারতীয় ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ এক স্থান অধিকার করেছিল। ফিদা এক অন্য জিনিস।

তখনো অন্ধকার নামেনি। আলাপের শুরুতে লেখকের সঙ্গে শাহাবুদ্দিন। ছবি: ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি 

[অন্ধকারে মুখোমুখি বসে কথা বলে যাচ্ছি আমরা। লোকজনও কমতে শুরু করেছে। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে এখানে বসে আছি। ওদিকে অজয় রায় রান্নার প্রস্তুতি করে বসে আছেন, শাহাবুদ্দিন রান্না করতে যাবেন। এখনো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। সব প্রশ্নের উত্তর আজ আর জানা সম্ভব না। কিছু প্রশ্ন থাকুক না আগামীর জন্য। তবে শেষ একটা প্রশ্ন আছে মনে। বিদায় নিয়ে চলে এসে আবার ফেরত গেলাম। আর বললাম]

প্রিয়.কম: শেষ একটা প্রশ্ন ছিল...

শাহাবুদ্দিন: আরও প্রশ্ন! বলো...

প্রিয়.কম: আপনি কি ভূতে ভয় পান?

[হেসে উঠলেন শিল্পী। অন্ধকারে তার হাসিটা দেখা গেল।]

শাহাবুদ্দিন: ভূত কেন, অনেক কিছুতেই ভয় আছে আমার। বিশেষ করে যা কিছু আমার ক্ষতি করতে পারে তাতেই আমার বেশি ভয়।

প্রিয় সাহিত্য/আজাদ চৌধুরী