কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

হাট থেকে গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন একজন। ছবি: ফোকাস বাংলা

কোরবানি, সিজনাল পশুপ্রেম এবং ইনফেরিয়রিটি

কাকন রেজা
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রকাশিত: ২৩ আগস্ট ২০১৮, ২০:৩৮
আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০১৮, ২০:৩৮

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পশুপ্রেমের একটি ‘সিজন’ রয়েছে। একে ‘সিজনাল পশুপ্রেম’ বলেও আখ্যায়িত করা যায়। যেমন–কোরবানির ক্ষেত্রে। কোরবানি ঈদ এলেই অনেকের ভেতরে পশুপ্রেমের এক মহা আকুলতা সৃষ্টি হয়। বিষয়টা আগে তত বোঝা যেত না, কিন্তু হালের যোগাযোগমাধ্যম পশুপ্রেমীদের ব্যকুলতার এমন চিত্র অধিকতর দৃশ্যমান করেছে। এবার কোরবানিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইনিয়ে-বিনিয়ে পশু হত্যাকে অমানবিক, মনের পশু কোরবানি না দিয়ে কেন পশু কোরবানি দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি সব কথামালায় ভরপুর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেয়াল। বিপরীতে ঈদের আগের দিন সড়কে মারা গেছেন ৩০ জন আদম সন্তান। ঈদ উপলক্ষে অনেকের বাড়ি ফেরা হয়নি, ছুটি কাটাতে গিয়ে চিরদিনের ছুটি নিয়েছেন তারা। এমন মৃত্যুতে এসব পশুপ্রেমীদের আহাজারি চোখে পড়েনি। তাদের যত আহাজারি কোরবানির গরু-খাসি নিয়ে!

মানুষের মৃত্যুতে, কষ্টতে যাদের ‘রা’ নেই, তাদের এই পশুপ্রেমের আকুলতাকে কী বলতে পারি, ন্যাকামো না ফাজলামো। খ্যাত সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা একে ন্যাকামো বলেছেন। আমার এক বন্ধু এমন প্রশ্নের উত্তরে যোগ করেছেন আরেকটি শব্দ, ‘বাঁদরামো’। শব্দটি কিন্তু মন্দ নয়। ‘বাঁদরামো’র সাথে সংশ্লিষ্ট প্রজাতিটি অনুকরণ প্রিয়, আমাদের দেশে গজিয়ে উঠা পশুপ্রেমীরাও তাই। ভারতে আলোচিত বিজেপি নেতা আদিত্য যোগীনাথ বলেছেন, ‘কোথাও যেন গো-হত্যা না হয় তা খেয়াল রাখতে’। এখানের প্রজাতিটি হয়তো তারই অনুকরণ করছেন। ভারতে গো-হত্যা রুখতে মানুষ হত্যা করা হয়। এখানেও সড়কে হারানো ৩০ মানব প্রাণের প্রতি মায়া জাগে না, জাগে গরুর প্রতি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গরু জবাইয়ের দৃশ্য আপলোড করা ঠিক নয়। এতে অনেকে ভয় পেতে পারেন, বিশেষ করে বাচ্চারা। এ কথাটা সচেতন সবাই বলেন। কিন্তু কোরবানির জন্য কেনা গরু-খাসির ছবি কেন আপলোড দেওয়া যাবে না, তার কোনো ব্যাখ্যা আমি বের করতে পারিনি। বিদেশি কুকুর কোলে নিয়ে ছবি যদি পোস্ট করা অপরাধ না হয়, তাহলে গরু বা খাসির দোষ কী! অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি কুকুরের দাম কিন্তু গরু-খাসির চেয়ে বেশি হয়। সুতরাং কোরবানির গরু-খাসির ছবি আপলোডকে যারা প্রদর্শনবাদিতা বলেন, তারা মার্সিডিজ, রোলসরয়েসের ছবি পোস্ট করাকে কী বলবেন?

প্রদর্শনবাদিতার বাইরে খুব বেশি মানুষ নেই। এই বাতিক কমবেশি সবারই রয়েছে, ব্যতিক্রম যারা রয়েছেন, তারা সংখ্যায় লঘু। কোরবানির ঈদে যারা কোরবানির গরু-খাসির ছবি পোস্ট দেওয়াকে একচেটিয়া প্রদর্শনবাদিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, তাদের ওয়ালে গিয়ে দেখুন তো, সেখানে গাড়িটা, ড্রয়িংরুমের ঝাড়বাতিটা, আইফোন টেন কিংবা বাড়ির ছবিটা নেই কিনা। আর বিদেশে বেড়াতে গেলে তো কথাই নেই, ছবিতে ছবিতে সয়লাব ওয়াল। এসব কী প্রদর্শনবাদিতা নয়? নাকি প্রদর্শনবাদিতা শুধু কোরবানিতেই আটকা? অনেকেই এক্ষেত্রে ধর্মের দোহাই দিতে পারেন। অনেকে বলবেন, ত্যাগ নীরবে করতে হয়, কোরবানি প্রদর্শনের কোনো ব্যাপার নয়। কথাটা একশত ভাগ সহি। ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম প্রদর্শনবাদিতাকে নিরুৎসাহিত করে, সাথে অকারণ বিলাসিতাকেও। আর এ নিরুৎসাহ শুধু কোরবানির গরু-খাসির ক্ষেত্রে নয়, সব ক্ষেত্রেই।

রাসুলের (সা.) ক্ষেত্রে একটি ঘটনা বারবার বর্ণিত হয়, তিনি মিষ্টি খাওয়া বিরত করার উপদেশ দেওয়ার আগে নিজে মিষ্টি খাওয়া ছেড়েছিলেন। কারণটা ছিল নৈতিক। তিনি নিজে মিষ্টি খাবেন অথচ অন্যকে না খাওয়ার জন্য উপদেশ দিবেন, এটা এক ধরনের প্রতারণা। খোদার রাসুল এই প্রতারণা করতে চাননি। এটাই ইসলাম। যারা কোরবানির গরু-খাসির ছবি আপলোডের বিরুদ্ধাচারণ করে পোস্ট দিচ্ছেন, তারা এ জানা বিষয়টি অনুধাবনের চেষ্টা করতে পারেন। তাহলে হয়তো সেলফোন, গাড়ি আর বাড়ির ছবি আপলোড করার সাথে গরু-খাসির ছবি পোস্টের বিষয়ে নিজ বক্তব্যের কনফ্লিক্টটা বুঝতে পারবেন।

আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ আছেন, যারা হয়তো অর্থবিত্তে সামর্থ্যবান বা চাকরিতে কোনো বড় পদের অধিকারী। এদের মধ্যে দেখবেন মানুষকে তাচ্ছিল্য করার একধরনের প্রবণতা। তাদের সাথে কথা বলতে গেলে এড়িয়ে যাবেন, ফোন করলে ধরবেন না, দেখা করতে গেলে বসিয়ে রাখবেন। এর অর্থ হলো তারা যে বড় হয়েছেন, সফল হয়েছেন তা প্রদর্শন করা। এক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কথা পুনর্বার উদ্ধৃত করি, ‘চোর-বাটপাররাও অনেক সময় সফল হয়ে যায়। কিন্তু তিনিই প্রকৃত মানুষ যিনি স্বার্থক হোন।’ সফলতা একটি সাময়িক অবস্থা, এর যখন তখন পরিবর্তন ঘটতে পারে, কিন্তু স্বার্থকতা হলো স্থায়ী একটি চিত্র যা মুছে যাওয়ার নয়। যেমন যাননি, রাসুল (সা.) থেকে মাদার তেরেসার মতন মানুষেরা। এমন মানুষগুলো স্বার্থক বলেই তারা মুছে যাবেন না।

‘চেনা বামুনের পৈতা লাগে না’ এমন একটি কথা রয়েছে। যারা চেনা ‘বামুন’, তাদের আর নিজেদের ‘বামুন’ প্রমাণ করতে হয় না। অচেনাদের অর্থাৎ যারা বামুন সাজতে চান তাদের প্রদর্শবাদিতা তথা ‘পৈতা’ লাগে। এক্ষেত্রেও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে আবার টেনে আনি। ইনফেরিয়র আর সুপিরিয়র প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘যারা “এই গেল এই গেল” বলে ভয়ে ভয়ে থাকেন এবং নিজেকে বারবার সুপিরিয়র প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, তারা মূলত ইনফেরিয়র। সুপিরিয়ররা এটা করেন না, কারণ তারা জানেন, তারা সুপিরিয়র।’

যারা প্রদর্শনবাদী তারা ইনফেরিয়র। তাই তারা নিজের পদ, বিত্ত প্রদর্শনের চেষ্টা করেন। এরাই সামাজিকমাধ্যমে বাড়ি-গাড়ি কখনো সুন্দরী নারীও প্রদর্শনের চেষ্টা করেন। কোরবানির গরু-খাসির ছবি যারা প্রদর্শন করেন তারাও তাই। কিন্তু এ দু’য়ের মাঝে পার্থক্য হলো, যারা গাড়ি-বাড়ি প্রদর্শন করে গরু-খাসি প্রদর্শনকে ট্রল করার চেষ্টার করেন, তারা আরো বেশি প্রদর্শনবাদী, আরো বেশি ইনফেরিয়র।