ছবি সংগৃহীত

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ-এর স্বনির্বাচিত সনেট

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ০৮:৩২
আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ০৮:৩২

গ্রাফিক্স : আকরাম হোসেন।

(প্রিয়.কম) বাংলা ভাষায় সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এ বছরেই সনেটের দেড়শ’ বছর পূর্তি হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে প্রিয়.কম বিশেষ আয়োজন করেছে। তারই অংশ হিসেবে পুন:মুদ্রিত হলো কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের স্বনির্বাচিত সনেট।


পারাদিসো

আমি তার বাণী শুনি, যে আমারে কভু শোনে নাই।
তারই পল গুনিতেছি, তারই তুলা ধুনিতেছি, ভাই।
সে কি নীল নাকি লাল? নাকি দিক্-ভোলা বিভ্রম?
উপরে যাহারা, কহো, যে আমারে নামায়েছে নীচে

সে কি নীল? অহে নীল, নীল হ’তে নীল খুলে এলে
থাকে লাল? লাল না-কি? লাল থেকে লাল তুলে নিলে
নীল থাকে? সে আমার নাল হ’ল, সে আমায় লীন,
সে আমার শখ হ’ল জোনাকির কাঁচুলির মতো;

সে আমার সময়ের জোনাকির আঁচলের মতো।
কুহেলি উড়িয়া যায় নীলালাল; শিলীন্ধ্র কত
মগজে গজায়, স্বামী, ষড়্-ঋতু শরমে লুকায়
জলপাই-সাদা জেবে, হেরো, তারকারা

পুড়ে যায়, যেন তারা, যেন তারা তাহারেই দেবে
আহুতি আমার হোমে, আমারে কি নেবে তারা হোমে?

 

বন্দেগি

আমি যেদিকেই ঘুরি সেদিকেই তুমি, দিক্পাল!
ইমানের কাবা তুমি, বেইমানিরও তুমিই হারাম,
অন্তরে বাহিরে, সাঁই, সর্বথাই তোমার বারাম,
সকলই নফল হেথা- জীবন মরণ আনফাল!
কলম ছুঁড়িল কেবা? জিব্রাইল নাকি বিলজিবাব?
হাতের তালুতে নয়, ধমনি-শিরায় ভাগ্যরেখা-
দেহের চৌহদ্দি ঘিরে হরফের গহরা পরিখা,
ডিএনএ-ভিয়েনে পাকে এককাট্টা বরকত-আজাব।
মাথার উপরে এক পড়ো-পড়ো পাহাড় রাখিয়া
হরুফে মোকাত্তেয়াত পাহারা বসায়ে সবখানে
অজস্র আরশিতে তুমি গড়িলে আরশ আসমানে
নুরানি মুখানি তব কোটি-কোটি মুখোশে ঢাকিয়া-
ঝরিছে জবুর আলো-অন্ধকারে ফোলিও-ফোলিও :
রায়েনা কইয়ো না, বান্দা, শুধু উনজোরনা বলিয়ো!



পানপাত্রে ছবি

আমি তো জেনেছি ভয়- যত ভয় গেথ্সিমানি বাগানবাড়িতে
জানে নি মনুষ্যপুত্র; যত ভয় বীভৎসায় ক’রে ফেলতে পারে
স্নায়ুকে অবশ, এত, যে তোমার মনে হবে এমন মোহন
আলোহিম কামনায় কাঁপে নি বাসরঘরে নবপরিণীতা :
তাছাড়া তিনলোকে কার চেহারা হাসিন আরও শয়তানের চেয়ে?
সে আমার সাথে-সাথে, যেন ছায়া, সে আমার অসীম আপন,
আমার হৃৎপিণ্ডে তার আত্মার আশংসা বাজে- ঠিক যে-রকম
জীবনে একবার কোনো নারীর হৃদয় উঠে এসেছিল স্তনে
নরম তন্দ্রার মতো; যে-রকম আধাক্রোশ কাদাভরা পথ
ভেঙে আমি পৌঁছে গেছি বৌবাজার ঘাটে আর সামনে ইছামতি
লহমায় একটা মোটা ঘায়েল ড্রাগন হ’য়ে মোচড়াতে-মোচড়াতে
আকাশ ঘুলিয়ে ফেলল আলোর ধুলায়- আমি কী ভেবেছি, জানো?
আমি কি ভেবেছি তুমি এরকম শুয়ে থাকবে আমার কবরে?
আমি কি জেনেছি ভয় তোমাকে এতটা ম্লান ক’রে দিতে পারে?



জ্ঞাস্তিক

স্বর্গকে লাথি মেরে উল্টে ফেলব আমি,
যে-স্বর্গ গড়েছে গোরা কর্তা তোমাদের,
বুড়ো এক ধীবরের উড়ো প্রমাদের-
আমি তো আপনার ইচ্ছা-হাবিয়ার স্বামী!
প্রজ্ঞার কাফন-গায়ে জন্ম আমার,
মায়ের চেহারা, মেঘে, দেখি নাই কভু,
কুমারীর জরায়ুর চিরন্তন হবু,
আমিই লেখক মম আমলনামার।
না নাদ, না বিন্দু, রবি, নয় শশী-তারা,
আমার হৃৎপিণ্ড এক জিজ্ঞাসার ভ্রূণ,
কিছুটা শিরিন তার, কিছু বিট-নুন;
হরদম নিজেকে পয়দা করবার পাঁয়তারা
ধুকপুক-ধুকপুক করে, সেফিরা ঠিকরায়-
কালো-হিরা রক্ত ছোটে শিরোপশিরায়...



শ্রীগুরবে

গাঙ্গুলি স্যরের মতো গতিশীল একাকিতা কোনোদিন আমাকে খেদাবে?
যুদ্ধ থেমে গেছে ব’লে, মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠির-অগস্ত্যযাত্রায়
গুটিগুটি পায়ে পৌঁছে যাবেন গাঙ্গুলি স্যর আলোহিম তৃতীয় মাত্রায়।
আখেরি ছুটির ঘণ্টা বেজে গেলে ওখানে কি ভাদাম্যারা হাঙ্গামা বাধাবে
আবারও একবার? তবু, লীয়মান দৃশ্যপটে ফুটে ওঠে নীরব আজাবে
যখন আত্মগোপন (কোনো পদ্মা-বোটে) আমি চেয়ে দেখি ঐ দু’টি পায়ে
জীবন-মৃত্যুর বল লাথি খেতে-খেতে ছোটে, সম্বোধির করুণা-নৌকায়
ঘুণজীর্ণ বোঠে, তবু, এখনও সতত ঋজু- সোজা চ’লে-চ’লে থেমে যাবে...
আমাকে আলোতে নাও, হে কৌন্তেয়, অন্ধ আমি, হায়! আমাকে খাওয়াও বেটে
যৌবনের চুম্বনকমলরস, চেখেছ যা দ্রৌপদীর ঠোঁটে; পরাজয়
মগজ-ম্যাগমায় ফোটে ক্রিমির ডিমের মতো হাজারেবিজারে; তাল কেটে
বাঁয়ে ডানে সামনে পিছে নয়ানজুলির স্রোতে, ফতে অরাজক এ-হৃদয়।
আমাকে শেখাও, গুরু, জনতার জ্যামিতিক ঊর্ধ্বঋতি নয়, শুধু হেঁটে
নাসাগ্রনিবদ্ধ চোখে হ’ঠে যাওয়া- যেখানে ঈশ্বর নিত্য বিবর্তিত হয়।



কালো-জল

আমি তার রায়বার গাই দশ মুখে :
সে যদিও কদাচন টানেনি স্ব-দলে,
নরুনই চুনেছে নিত্য নাকের বদলে,
শিথিল করেনি পর্দা আমার সম্মুখে,
তবু তারই রেক্তা এই হিবাচির ধারে
ধুনার ধোঁয়ায় আর তেলের আলোয়
গেয়ে যাই, যে সময় আমার আলয়
ফুট-ফুট ডুবে যায় তরল আঁধারে।
এই একটিবারই আমি পেয়েছি যে তাকে-
নিজ-হাতে তার সাদা ঘোমটা ঘোচালাম!
বলো একে শুভদৃষ্টি, বা বলো চেহ্লাম,
আমারই আয়েশে সে তো চোখ বুজে থাকে
আমারই গায়ের নীচে আবেশ-নিথর...
আমরা দু’জনেই কালো-জলের ভিতর।



আহ্ !

আয়নার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলাম
    আলোর মেমব্রেন ছিঁড়ে- রইয়ে- সইয়ে- ধীরে-
এমন আলগোছে, যেন কোনো কিশোরীর
    হাইমেন ফেটে গেল স্বপ্নের ভিতর
গির্জার স্পায়ার দেখে। বেরিয়ে এলাম
    এমন আলগোছে, ঘুমও ভাঙে নি আয়নার ;
তারপর আমার পিছে আস্তে খুলে গেল
    জন ব্যাপ্টিস্টের চোখে আস্ত অস্তাকাশ-
কাঁপন লাগল না কাঁটে, এমন সঞ্চার !
    আমাদের মাঝখানে কাচের হিজাব,
চামড়ার আড়াল কোনো থাকল না মোটেই,
    থাকল না আত্মার বাধা, থাকল না আলোর ;
আমাদের মাঝখানে কেবল ঈশ্বর-
    আমাদেরই হাতে আজ খুন হ’য়ে যাবে...



বাসর

হে বামন, কদাকার, কাদাকার গল›মাংস পিণ্ড,
    অবরুণ্ড মুণ্ড, আর বুকে চোখ, ভুঁড়ি-জোড়া হাসি ;
নাভিতে লটকানো, একটা লকেটের মতো, অবচ্ছিন্ন
    অণ্ড-ছাড়া অন্য কোনো প্রত্যঙ্গই নাই- জিহ্বা, আশী,

মায় গলনালি, বৃক্ক, কলজে, দিল, আঁতুড়ি-ভুতুড়ি,
    ফ্যাপসা-গুর্দা-তিল্লি-বট-পিত্তথলি ঝুলতেছে, যেথায়
পায়ের থাকার কথা ; মধ্যিখানে একজন থুত্থুড়ি
    বুড়ির অব্যক্ত মন্স্ ভেনেরিস, কোঁচকানো, ব্যথায়...

ও আমি বাসর-ঘরে ঘোমটা তুলে তোমাকে দেখলাম !
    আহ্ ! শুভদৃষ্টি !- আর, কারা ওরা করতেছে খিলখিল
ঝিলমিলের, ঘুলঘুলির ফাঁকেফোঁকে... আলাম-আলাম
    চন্দনের লাকড়ি-কাঁখে লাখে-লাখে মইজালি পিলপিল

খাটে- খাটিয়ায়- উঠে, ঢাকল মন্ত্রগাঢ় আমাদের-
    মুখাগ্নি হ’ল না তবু- মুখ নাই কারো আমাদের...



তীর্থের পথের ধারে

তোমার তুলনা খালি তুমি, তুমিই গো মা।
    পুতেরে হুতায়া তুমি কাপড় ধুইতে গেলা,
চিক্ষুরে চিক্ষুরে আমি ভাঙ্গিলাম গলা,
    তুমি দেখাইলা না আর মাতৃত্বের খোমা,
লইলা না আমারে কাঙ্খে। আরেক মহিলা
    চাপলিসে উঠায়া নিল, পাতার বস্তায়
ভইরা ফেলল। আমার মতো একই অবস্থায়
    গণ্ডায়-গণ্ডায় আণ্ডাবাচ্চা চাটল অবহেলা

তীর্থের পথের ধারে। হাত-পা-হারা ধড়ে
    খানকির মতো কাইজ্যা মুখে, সানকি টানাটানি,
আচমকা টুংটুং সিকি-আধলি যদি পড়ে
    মনে পড়ে সোনার হাতে সোনার কাঁকনখানি ;
মনের ভুলে ‘মা’ ডাকলে, হেরা মনে করে
    আহা রে বেচারা। আমরা ভাবি চুৎমারানি।




ডিরোজিও

ছবিটা বিবর্ণ, যেন তুমি ছিলে শুধু একটা নাম,
    নিপট ফিরিঙ্গি, তুমি মোগল ইংরেজ নও, তুমি
নওলি যৌবনে ত্যেজে গিয়েছিলে ধামাধরাধাম,
    তারই মধ্যে- একরাতের রেতে করেছিলে মরুভূমি

বাঙালির বাঙালিত্ব, হেনরি ভিভিয়ান, তার পুঁজি-
    তোমার ঔরসে বঙ্গে পয়দা হ’ল মাইকেল, বঙ্কিম,
গজাল রবীন্দ্রনাথ- আমাদের মধ্যবিত্ত রুচি...
    দু’বছর ? নাকি তার কিছু বেশি-কম ? কতদিন

বালখিল্য-পরিরম্ভে খুলেছিল বাংলা তার ঊরু ?
    ক’বছর গর্ভাবস্থা ? কী-কী ছিল সাধ তার ? কোন্
আশঙ্কায়, কালো-দুধে-ভরা, তার বুক দুরুদুরু
    করেছিল ?- আমরা চাই দেখতে সেই বিপ্রতীপ কোণ।

বিবর্ণ ছবিটা- তবু ভালবাসি- শিশু নিষ্পাপের-
    আর কাঁদি- জারজ সন্তান যারা জারজ বাপের...




ধৃতরাষ্ট্র

ক্ষমো, তপ্ত অন্ধকার, মাতৃগর্ভ মম, ক্ষমো, নিশা,
ক্ষমো, সাথি নীরন্ধ্র নির্বেদ, ওগো চিরপরিচিত
মুশকিল-আসান, শুদ্ধ নির্জ্ঞানের বৈদূর্য-মনীষা,
ক্ষমো এই ভূমিশয্যা, অপত্যের বিরহরচিত।
অদসের তমসায় অন্ধ-পশু অসুর অসূয়া
আজন্ম ক্ষুধায়, হায়, আপনার হাত-পা খেয়ে নিয়ে
অটুট গুঁটিতে তারই হয়েছে ফতুর কানা শুঁয়া
পুড়িয়ে নিজের ভূত-ভবিষ্যৎ দ্বন্দ্ব-জতুগৃহে।
বারেক উঘারি’ মম কৃষ্ণ যবনিকা, বিশ্বস্বামী,
কৌস্তুভ ঝলক তুমি দেখালে, দেখিল সভাজন;
এই অভাজন তা-ও লখিল না! অন্ধতম আমি
অন্ধলোকে!... বলিলা বিদুর তবে: উত্তিষ্ঠ, রাজন্!
যা পিছে তা মিছে, তুমি উলুবনে অযথা কেঁদো না,
ন তে তব ন তেষাং ত্বং তত্র কা পরিবেদনা?



দ্বিরাগমন


তোমার প্রদোষে আমি সেদিন করেছি সন্তরণ-
লাল আর নীল আর পরালাল পরানীল মোহে
আমি তো খেয়েছি ঢেউ মুহুর্মুহুঃ বিরহে ও দ্রোহে,
তোমার ভিতরে আমি করেছি নিজের আচরণ।
তুমি তারও চেয়ে তবু দূরে ছিলে, তোমাকে স্মরণ
আমার অসাধ্য ছিল- আমার বিরুদ্ধ ছিল গলা,
আমার অবাধ্য ছিল আমার নিজের বলা, চলা,
আমার অধার্য ছিল আমার রক্তের বিস্ফোরণ।
এবং রজনি এলো তোমার ভিতরে- বা মরণ।
তোমার রজনিগন্ধা অথবা তোমার হিমবাহ,
তোমার অপত্যস্নেহে শয়ান যতেক চিতাদাহ,
তারা খুব ক্লান্তিমায় ঊহ্য ক’রে দিল উচ্চারণ-
তোমার সকল তারা, লাল নীল পরালালনীল,
আমার চোখের দিকে ঝাঁপ দিল- হিংস্র আবাবিল।



পুলিপোলাও


এই ফাঁকা পথগুলি ভারি ভালো লাগে :
কুলকুল দুই কূল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ইছামতি নদী
যেন বয়। বার বার মনে হয়, আরবার যদি
ফিরে যেতে পারি আমি মরণের আগে!
যদি ফিরে যেতে পারি ফের,
ফিরে যেতে পারি আমি ও-ধূলিখেলায়,
ঐ গাঢ় স্বস্ত্যয়নে, স্বপ্নসাৎ গোধূলিবেলায়-
তাই এই ঘন রাতে এসব পথের
অনির্বচনীয়তার হাতে করি আত্মসমর্পণ।
এছাড়া কী আর আছে, এত কাছে, এই এত দূর?
কী আর রয়েছে এত রিরংসাবিধুর,
এমন রোমাঞ্চকর? এমন গোপন
কোথায় বা বাজে আর বাতাসে শানাই?
কেঁদে কেঁদে ফেরে হুহু, যা রয়েছে, র’য়ে গেছে, যা ছিল, যা নাই?


ওরা তোরে ভুলে গেছে, অথবা চেয়েছে তা-ই, ওদের স্মরণে
টলোমলো পায়ে, আহা, প্রথম-দাঁড়ানো তুই আর
তুলিস না ‘তা-তা’ ধ্বনি- অকাল মরণে
ননির পুত্তলি, তুই হয়েছিস এত গুরুভার!
যে ঐ নিবিড় ব্যূহ ভেদ ক’রে, তোর
একান্ত, নিজস্ব, ছোট্ট, দুর্গটিকে করেছে দখল,
তারে তুমি ক’রে দিয়ো আপনাতে অম্নি বিভোর-
তোর ছোট বোনটিরে- দিয়ো সে-সকল
ঈশিতার প্রতিভাস, আধো-হাসি-মুখে- আর, সে-মহান্ ভাষা,
যে-ভাষা হিরের মতো স্বচ্ছ, দ্যুতিময়,
ঘুমঘোরে ঝল্সে উঠে দূরতম নক্ষত্রের নীরব আলোয়
একাই যে একশ’ ছিল এক রাত, ত্রিলোকের জাগর-পালায়-
যে-কোনো চীনারও কানে ছিল তা প্রাঞ্জল- তবু আশা :
ও আমার বড় মেয়ে, যা-কিছু বলেছ তুমি, বলেছ বাংলায়।

১৪
বামাচারী আত্মাদের প্যান্ডেমোনিয়ামে
একদিন শরিক হয়েছি আমি শুধু নিয়তিকে
মেনে না-নে’য়ার ছলে। সঙ্গীতের শুদ্ধ সঙ্ঘারামে
ছিলাম আরেকদিন, আরেক পলায়নের দিকে
স্বপ্নকে চালনা ক’রে। তারপর দু’পথের মেলবিন্দুটিতে
দাঁড়িয়েছি, জীবনে প্রথমবার, মুখোমুখি সমূহ সত্যের-
তরল আলোর মতো, অখিলের অবধূতিকায়,
যে-সত্যের ঊর্ধ্বঋতি সরল শিখায়,
যে-সত্য প্রজায়মান জ্যোতিষ্কের মস্তিষ্কের শুভ্র নিদুটিতে,
অলকানন্দায়,- যার প্রতিভাস বিম্বিত মর্ত্যরে
বিশাল বীপ্সার পটে। যে-বিস্ময়ে “তারাভরা রাত”
সুরশ্রেষ্ঠ শিল্পীর তুলিকে
দিয়েছে অপরিমেয় শক্তির প্রঘাত-
যে-আলোক চিরযায়ী অমাময়ী মৃন্ময়ীর দিকে...

২১
কও তোতা, কাহিনি তোমার বাখানিয়া,
টক্কা টরে টরে টক্কা টক্কা টরে টরে
কেমনে আইলা তুমি আধখানা পোড়া পাখা নিয়া
উড়িতে উড়িতে আর পুড়িতে পুড়িতে এই কদলী নগরে?
আহা ও কিসের দাগ লেগে আছে ঠোঁটে
আরক্তিম? জ্যোৎস্নার ঝিলিক্ বুঝি চোখের কোনায়
এক কণা? অথচ তোমার কণ্ঠ বুজে গেছে ঝড়ের ঝাপটে,
কনীনিকা জ’মে গেছে সমুদ্র-নোনায়!
টক্কা টক্কা টরে টরে টক্কা টরে টরে
ক্যান্ বা আইলা, পাখি, কদলী নগরে?
কোন্ বা নমাজ তুমি করেছিলে কাজা,
নতুবা সাবাথে কোন্ করেছিলে আমিষভোজন,
যে, তোমারই  শিরে শুধু নেমে এল আকাশের সাজা,
তোমারই  জেনিথে শুধু ফুটো হ’য়ে গেল যে ওজোন?

২৩
এই পূতিগন্ধময় মৃতদেহ নিয়ে
আমি ভেসে এসেছি অনেক দূর, অনেক বন্দর।
আমিই বেহুলা, আর আমি লখিন্দর।
নিজেরে সুবিধামতো গাঙুড় বানিয়ে
নিজেরই মান্দাসে আমি চলেছি ভাসান।
এক ঘাট- দুই ঘাট- বত্রিশ ঘাটার
পরখ করেছি আমি শান :
অতঃপর ঠেকে গেছি, ফেঁসে গেছি, ঝরোকা-কাটার
এই চরে, এ-হাটায়- কারিগরগণ যেথা সারিবদ্ধ, স্তব্ধ অপেক্ষায়,
জুরাসিক যুগ থেকে; আমার প্রেক্ষায়
তারা ঠুকে ঢুকিয়েছে অদ্ভুত প্রিজম-
জীবন মরণ, তথা দুঃখ সুখ, সাদা কিংবা কালো
অগত্যা খশিয়া গিয়া, অন্য এক আগন্তুক আলো
পাঁজরের মাঝখানে খুঁড়েছে কী-গূঢ় জমজম...



ইচক কে যুবরাজ


এই শেষ রক্তবিন্দু ক্ষরণের অনুপল আগে,
অ্যাকিলিজ! অ্যাকিলিজ! একবার দেখে যা আমায়!
দ্যাখ্, তোর চির-ছায়া জন্মের মতন যায় যায়
প্রসার্পিনার তাঁবেয়! সত্য, সখা, তবু ভালো লাগে,
দেব আর দানবের এই অতিমানবীয় যাগে,
যেই কুরুক্ষেত্রে তুচ্ছ- এই পরাশক্তির সভায়-
অতীতের কালো আর আগামীর আলোর প্রভায়
অলখে মৌলিল যত ইন্দ্রধনু হৃদয়-সংরাগে
তারই কিছু অবদান রেখে যেতে আকাশের তলে
যে-আকাশে কোটি কৃষ্ণরন্ধ্র, শ্বেতবামনের ভিড়ে
বিরলে বিরাজে স্বাতী- মণিময় নয়নের জলে
যে করে বরণ তার অবরেণ্য নির্বাচিতটিরে-
আয় সখা, ঢাক্ তারে, লরেলে না, কেবলই মেপলে,
তোরই স্বর্ণবর্ম প’রে যে পড়েছে বৈতরণিতীরে!


হৃদয়ে সিঁদুর দিয়ে সধব হয়েছি আমি আজ!
নমো হে দয়িত মম- নারী বা পুরুষ, হও যা-ই,
যে-তুমি আমার সাথি, আমার চিরশঃ পার্শ্বযায়ী-
এসো তবে, শুরু হোক আমাদের যুগল মিরাজ!
হে সখা, খবরদার! খুব বেশি মাখামাখি নয়!
না মিলন না বিরহ- এম্নি এক গ্রামে রাখো বেঁধে
আমাদের দু’টি মন। যেন পাশাপাশি দু’টি গাছে
দু’টি পাতা, যেন একই ডালে ধ’রে আছে- এত কাছে!
কেবল হাওয়ার তোড়ে মাঝে মাঝে জানা যায়... বেদে
সূক্তে সূক্তে উক্ত কত এমতনই নিগূঢ় প্রণয়।
হে বঁধু, হে বিপরীত, আমরা দু’জন যতদিন
এ অন্যের উপগ্রহ, যতকাল এ ওর অয়নে
না চড়াচ্ছি যৌন ক্ষুধা, তদবধি দু’জোড়া নয়নে
ঐ বৈজয়ন্তীপুর ঝল্মলাবে সায়ং-রঙিন।



একাদশ রজনির গান

কে ঐ শুনাল মোরে রাজকুমারী আলাতিয়েলের পুণ্যনাম!
হ’তেও পাত্তেম হয়তো আমি তার অষ্টম প্রেমিক-
তবে কিনা, পবিত্র রোম-রাজ্য পতনের আগে ঠিক
অচ্ছোদপটল তুলে ফেলেছেন আমার বনাম।

পরন্তু পা’য় জোর নাই শুঁড়িটোলা থেকে সুরিনাম
দাব্ড়ে বেড়াবার, আহা। বস্তুতঃ একবার
মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা হয়েছিল নাঙ্গা আর তাতল পিচ-পথে
সূর্যের সহস্র চ’ক্ষে তামাটে ঝামাটে ম্যাকাবার

নেচে, পরিশেষে, ইসপের চার্বাক শৃগাল ব’নে, কোনোমতে
যেই-না পৌঁছেছি ছোটলোকির গুমোট গুমটি ডেন্-এ,
অম্নি- এক (নিস্ত্রিংশ) বিদূষক হিড়হিড়িয়ে আমাকে ইডেনে
টেনে নিতে গিয়ে নিয়ে ফেলল পরিতাপের আদিমতম ক্ষতে...

রু-ব-রু পেয়েই, ভুরু কুঁচকে চিল-চেঁচাই- শালা! কী-গর্তে ঢোকাচ্ছ?
- বাদবাকি বিবরণটুকু চেপে গেছেন বোকাচ্চো।



প্রস্তাবনা

খেউড় রেহাইহীন। রাত্রি কি থেমেছে আজ দূরে?
সুরের পসরা নিয়ে এদেশে এসেছে সুরদাস।
কখনও খাব না আর এরকম মুলা বারোমাস।
আর ছাতা প’ড়ে গেছে বর্ষার পশারে যত গুড়ে।
কখনও কি মুফতে পাই, নুন আনতে পান্তা ফুরালেও?
‘কলা খাই নি, কলা খাই নি’- চেঁচাই নি তো কোনোদিনও, তবে
সবারই যে হাত-পা-ঝাড়া, আমারই জেরবার শুধু ভবে!
অনন্তর মেঘনিদ্রা। সঙ্ঘারামে রম্ভা লাগে ফেউ।
সুর-তালে সিক্ত হও। গুঁতালে মেলে না কাব্যকণা,
অয়ি লো মানসহংসী! সধবা প্রাণেশ্বরী মম!
দিন থাকিতে নোয়াও গো, নোয়াও গো কালান্তক ফণা!
অমৃতের বিষবাষ্পে তলাতলে হেঁচে মরে যমও-
পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ তুলে দেও, চন্দ্রনিভাননা,
অতুল প্রসাদে আমি অধরাতি সারি নমোনমঃ।

 


কন্যকায়
(আমার তুন্তি-কে)

সীমন্তে বসন্ত তোর এলো নাকি, দুহিতা আমার?
কত পথ ত’রে এলি হামাগুড়ি দিয়ে! কোনোদিন
শুনি নি- এমন মৃদু- শাঁখার, শাঁখের অনুকার
নথের নহর তোর। আহা, স্বপ্ন, স্বপ্ন সমাসীন
জাতিস্মর এষণায়। এ-নিয়তি পাখির বিলাপ
অসৎ নৈর্ঋতে, আহা, আকাশের লাল আঁখিকোণে
শুভ্র ফড় খশিয়েছে অভ্রভেদী এক এপিটাফ-
শুদ্ধ-রোদে-নেয়ে-ওঠা ঘাসের মেয়েরা তাই  শোনে...
রাতভর নীল-রাংতা নীলিমায় নীলা-নীল ধূম
জড়িয়ে জড়িয়ে আঁকে, পৈতৃক সুখের অন্তরালে
চুনি-পাপ, আর পাপক্ষালনের তৈলতোয়া ঘুম,
লেবু-ফুল, চাঁদা টিপ, ভিজে রাত,- যে-রাত পোয়ালে
তোর বুকে দুধ আসে নক্ষত্রের ঘাস হ’তে, আর
স্বপ্নের সুদূরে চলে ননিচোরা মধু- মধুবার!