ছবি সংগৃহীত

সংবাদ রসায়ন: কোকোর মৃত্যু

Showquat Ali Benu
লেখক
প্রকাশিত: ২৭ জানুয়ারি ২০১৫, ১২:০৬
আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০১৫, ১২:০৬

শোকে মূহ্যমান খালেদা জিয়া। অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর। লোকসাহিত্যের এই প্রবাদটি অধিক অর্থবহ মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে গত দুইদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত ও টিভি চ্যানেলগুলোর প্রচারিত সংবাদ দেখে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। শনিবার দুপ���র সাড়ে ১২টার দিকে মালয়েশিয়ায় তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। কোকোর মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল তাঁর পরিবার এবং রাজনৈতিক মহল। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ মাত্রই যে কোনো মানুষের ইন্তেকালে শোকাহত হয়।আমিও এর ব্যতিক্রম নই। প্রতিটি মৃত্যুই কষ্টের। তবে গত তেইশ দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে তেত্রিশটি অগ্নিদগ্ধ মানুষের অস্বাভাবিক যন্ত্রনাময় মৃত্যু এবং অসংখ্য পোড়া মানুষের মৃত্যু-যন্ত্রণা ও আহাজারি খালেদা জিয়াকে কতটুকু কাতর করেছিলেন তা আমাদের কারোর পক্ষেই জানার সুযোগ হয়নি। কারণ সংবাদ মাধ্যমগুলোকে এই নিয়ে খালেদা জিয়ার শোকাহত মর্ম-বেদনার কোনো সংবাদ পরিবেশন করতেও দেখা যায়নি।এই প্রশ্নটি অনেকের কাছেই অবান্তর মনে হতেও পারে। তেত্রিশটি অগ্নিদগ্ধ মানুষের মৃত্যুর কারণে খালেদা জিয়া কাতর না হলেও পুত্র শোকে তিনি পাথর হয়ে সংবাদ শিরোনামে স্থান দখল করেছেন। এইটিও স্বাভাবিক। পুত্র শোকে যে কোনো মায়েরই এমনটি হওয়ার কথা। পারিবারিক প্রসিদ্ধির কারণে জিয়া পরিবারের যে কোনো ঘটনাই সংবাদ। বিয়ে-সাদী, কেনাকেটা, মাথা ব্যাথা, জ্বর-সর্দি-কাশি সব কিছুই সংবাদে পরিনত হয়। আরাফাত রহমান কোকো এর আগেও সংবাদে শিরোনাম হয়েছেন। সেলিব্রেটিদের ব্যক্তি জীবনে যখন যা ঘটে তা নিয়েই চলে জল্পনা-কল্পনা। সংবাদের গুরুত্ব বিবেচনায় এবং খবরটির চরিত্রানুযায়ী কোকোর মৃত্যুর সংবাদ প্রচারে যা ঘটেছে এটাই স্বাভাবিক। কারণ সংবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রসিদ্ধি (Prominence) এইখানে সংবাদের গুরুত্ব হিসেবে কাজ করেছে। একটিমাত্র খবর এবং একই খবরের ভিতরের আরো অনেক খবরকে ঘিরে কেন এই সংবাদ ট্রিটমেন্ট? এই প্রশ্নের তাত্ত্বিক জবাব হলো 'সংবাদ রসায়ন'। সবকিছুই সংবাদ। তবে সব সময় নয়। একই বিষয় সময়ভেদে কখনও কখনও বিষয়টি অন্য সময়ের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর তখনই সেটি হয় সংবাদ। অপ্রত্যাশিত কোন কিছু যা নিয়ে জনগণ আলাপ-আলোচনা করতে ভালবাসে, বিষয়টিতে জনগনের আগ্রহ জমে তাই সংবাদ। সংবাদ হচ্ছে কিছু আগ্রহোদ্দীপক ও গুরুত্বসম্পন্ন ঘটনা বা বাস্তব অবস্থার বিবরণী যা সমাজ গোষ্ঠীর বিরাট অংশকে আগ্রহী করে তোলে বা পাঠককে আকৃষ্ট করে থাকে। রাম-শ্যাম, যদু-মধুর স্বাভাবিক মৃত্যু ‘সংবাদ’ নয়। কোকোর স্বাভাবিক মৃত্যুও 'সংবাদ' কারণ জিয়া পরিবারের প্রসিদ্ধি এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোকোর মৃত্যুর বিষয়টি খালেদা জিয়ার মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার সাথে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত। অধিকাংশ সংবাদই তৈরি হয় একাধিক সংবাদ উপাদানের সংমিশ্রণে। এমন সংবাদের উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যায় যেখানে একটি মাত্র উপাদান দিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। কোকোর মৃত্যুর সংবাদটিও নিছক মৃত্যুজনিত কারণেই সংবাদ হিসেবে গুরুত্ব পায়নি। জিয়া পরিবারের কনিষ্ট সন্তানের স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাটিও বেশ কয়েকটি বিশেষ মোক্ষম উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত যেই কারণে প্রিন্ট মিডিয়ার প্রথম পাতায় এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদে পরিণত হয়েছে। সংবাদের একটি উপাদানের সাথে আর একটি উপাদান যুক্ত হয়ে যখন ওই সংবাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়ে যায় তখন সংবাদটি একটি নতুন মাত্রায় শক্তি লাভ করে। সংবাদের এই নতুন মাত্রার শক্তি লাভের প্রক্রিয়াকে বলা হয় সংবাদ-রসায়ন। রসায়ন শাস্রে যে বিষয়টিকে বলা হয় পদার্থের ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঠিক তেমনি সাংবাদিকতায় সংবাদের একটি উপাদানের সাথে আরেকটি উপাদান সংযুক্ত হয়ে সংবাদেও রাসায়নিক এই বিক্রিয়ার মতো অনুরূপ ঘটনা ঘটে থাকে। একটি স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা কেন সংবাদ হিসেবে মিডিয়া জুড়ে আলোচিত? সংবাদ সৃষ্টিতে সংবাদের যে বিশেষ মোক্ষম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো একটি ঘটনাকে নতুন মাত্রায় শক্তি যুগিয়ে আলোড়িত করে থাকে কোকোর স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাটিও সেই মাত্রায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।কোকোর মৃত্যুর সংবাদের উপাদানগুলো হলো: এক। প্রসিদ্ধি (Prominence)/জিয়া পরিবার: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জিয়া পরিবারের গুরুত্ব- বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক। গুরুত্বের দিক থেকে জিয়া পরিবার এবং তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে কোকোর স্বাভাবিক মৃত্যুও সংবাদ হিসেবে অতিমাত্রায় গুরুত্ব পেয়েছে। দুই। বিরোধ (Conflict)/রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব: সমাজে দ্বন্দ্বমূলক বা বিরোধমূলক যে কোনো বিতর্ক থাকলে ওই ঘটনা সব সময়ই সংবাদ হিসেবে জীবন্ত থাকে। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দুটি রাজনৈতিক দলের দীর্ঘদিনের দ্বন্ধ সমাজ গোষ্ঠীর বিরাট অংশকে আগ্রহী করে রেখেছে। একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়া, তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা, শোক জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে যাওয়া, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা না হওয়া, রাতে ‘ঘুম থেকে জেগে উঠে’ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেয়া এই সবই হলো দুইটি রাজনৈতিক পরিবারের বিরোধ কিংবা দ্বন্ধের খেসারত। তিন। মানবিক আগ্রহ (Human Interest)/কোকোর উত্থান-পতন: জিয়া পরিবারের কনিষ্ট সন্তান কোকোর রাজনৈতিক আগ্রহ কিংবা রাজনৈতিক উচ্চ-বিলাসিতা না থাকলেও নানা কারণে ওয়ান-ইলাভেন এর আগে ও পরে গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়।ওয়ান-ইলাভেন এর সময় গ্রেফতার,শারীরিক নির্যাতন, দেশের বাইরে চলে যাওয়া, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হওয়া এবং আদালত কর্তৃক শাস্তি পাওয়া এই সকল কারণে কোকোর প্রতি গণমানুষের আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। চার। নৈকট্য (Proximity)/অকাট্য ভালবাসা: আপোষহীন দেশনেত্রী খ্যাত খালেদা জিয়া তিনবার প্রধান মন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে সংসদে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জিয়া পরিবারের প্রতি দেশের মানুষের অকাট্য ভালবাসা এবং তাঁরই সূত্র ধরে কনিষ্ট ছেলে কোকোর প্রতিও রাজনৈতিক ভালবাসা জন্মেছে এই দেশের মানুষের মধ্যে। সংবাদের গুরুত্ব হিসেবে জিয়া পরিবারের প্রসিদ্ধি, রাজনৈতিক বিরোধ, কোকোর প্রতি মানুষের আগ্রহ এবং ভালবাসা এইসব উপাদানের যৌথ সংমিশ্রণেই স্বভাবিক মৃত্যুর ঘটনাও সওয়ার হয়েছে মিডিয়ার উপর। [এই বিভাগে প্রকাশিত মতামতের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে]