
ছবি সংগৃহীত
রমজানে জিবরাইলের [আ.] সাথে রাসুল [সা.] কোরআন অনুশীলন করতেন!
আপডেট: ৩০ জুন ২০১৫, ০৪:১৪
কোরানের প্রতি গুরুত্বারোপ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কুঞ্জিকা। অপরের সাথে কোরআন বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা কোরানের গভীর জ্ঞান, মর্ম উপলব্ধির সহজ মাধ্যম। পারস্পরিক কোরআন বিষয়ক আলোচনা সততা ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা সদৃশ। রমজানে কোরআন শিক্ষায় রাসুলের সহপাঠী হওয়ার জন্য জিবরাইল আ: আল্লাহ কর্তৃক নিয়োজিত ছিলেন। এ বিষয়ে হাদিসে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়— ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, জিবরাইল আ: রমজানের প্রতি রাতে রাসুলের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং ফজর অবধি তার সাথে অবস্থান করতেন। রাসুল তাকে কোরআন শোনাতেন। [বোখারি : ১৯০২।] আরো এসেছে, রাসুল তার প্রিয়তমা কন্যা ফাতেমাকে গোপনে জানালেন যে, জিবরাইল প্রতি বছর আমাকে একবার কোরআন শোনাতেন এবং শুনতেন, এ বছর তিনি দু বার আমাকে শুনিয়েছেন-শুনেছেন। একে আমি আমার সময় সমাগত হওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করি। [বেখারি : ৩৬২৪।] ইবনে হাজার বলেন : জিবরাইল প্রতি বছর রাসুলের সাথে সাক্ষাৎ করে এক রমজান হতে অন্য রমজান অবধি যা নাজিল হয়েছে, তা শোনাতেন এবং শুনতেন। যে বছর রাসুলের অন্তর্ধান হয়, সে বছর তিনি দু বার শোনান ও শোনেন। [ফাতহুল বারি : খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৪২।] হাদিসগুলো একে অপরের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের নিদর্শন। রমজানে উত্তম সাহচর্য নির্ধারণ এ কারণেই আবশ্যক ; উত্তম সাহচর্যের ফলে সময়ের সর্বোত্তম সুফল লাভ হবে—সন্দেহ নেই। কুসংসর্গের ফলে এ বরকতময় মাসেও অনেকের সময় পাপের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে, এমন দৃষ্টান্ত আমাদের নিকট বিরল নয়। এক্ষেত্রে, সুতরাং, বান্দার জন্য অধিক তাকওয়া অবলম্বন জরুরি। মানুষ যাকে বন্ধু ও আপনজন হিসেবে গ্রহণ করে, অভ্যাস-আচরণ ও ধর্মাচারে প্রবলভাবে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়, এ কারণে বন্ধু নির্বাচনে অত্যন্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কোরআন শিক্ষা, দিবসের তুলনায় রাতে কোরআন তেলাওয়াতের অধিক ফজিলত, [তবে, কেউ যদি মনে করে যে, দিবসে কোরআন তেলাওয়াত তার জন্য অধিক উপকারি, তাহলে তাই তার জন্য অধিক ফজিলতপূর্ণ।] রমজানে কোরআন তেলাওয়াত বেশি পুণ্যময় ও কল্যাণকর হওয়া, উত্তম সাহচর্যের ফলে আত্মিক উত্তম ফলশ্রুতি লাভ—ইত্যাদি বিষয়ে উক্ত হাদিস একটি প্রামাণ্য দলিল। ইবনে হাজার বলেন : তেলাওয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য আত্মিক উপস্থিতি ও উপলব্ধি। [ফাতহুল বারি : খন্ড : ৯, পৃষ্ঠা : ৪৫।] ইবনে বাত্তাল বলেন : রাসুলের এ কোরআন শিক্ষা ও অনুশীলনের একমাত্র কারণ ছিল পরকালের আকাঙ্ক্ষা ও ব্যাকুল ভাবনার জাগরণ এবং পার্থিব বিষয়ে অনীহার সৃষ্টি করা। [ইবনে বাত্তাল : শরহে বোখারি : খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ১৩।] অত্যন্ত আনন্দ ও সুখের বিষয়, বর্তমান সময়ে রমজানে একবার বা দু বার কোরআন খতমের ব্যাপক আগ্রহ মানুষের মাঝে দেখা যায়। সন্দেহ নেই, এ হবে মানুষের জন্য ব্যাপক কল্যাণবাহী। তবে, তারাবীহে যে তেলাওয়াত করা হয়, তেলাওয়াত ও সুর মাধুর্যের নানা কৌশলের প্রতি লক্ষ্য রাখার ফলে মর্ম উপলব্ধি ও গভীর চিন্তার প্রয়োগ হয় না। আললাহ পবিত্র কোরানে ইরশাদ করেছেন— كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُوا الْأَلْبَابِ ص: 29. এ এমন এক কিতাব—বরকতময়—যা আপনার নিকট অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা এর আয়াতগুলোয় গভীর চিন্তা করে এবং জ্ঞানীগণ উপদেশ গ্রহণ করে। [সূরা সোয়াদ : আয়াত ২৯।] সন্দেহ নেই, এ সম্মানিত সময়ের সবটুকু কল্যাণ নিংড়ে নেয়া সকলের কর্তব্য। সালফে সালিহীন হতে প্রমাণিত, এ সময়ে তারা সালাত ও অন্যান্য উপলক্ষে দীর্ঘক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করতেন—এমনকি, ইমাম যুহরি বলেন : রমজান হচ্ছে কোরআন তেলাওয়াত ও আহার বিতরণের মাস ; [ইবনে আব্দুল বার : আত তামহীদ : খন্ড : ৬, পৃষ্ঠা : ১১১।] রমজান মাস আরম্ভ হলে ইমাম মালেক হাদিস অধ্যয়ন ও আহলে ইলমের সাথে ইলমি আলোচনা ও সভা-সমাবেশ পরিত্যাগ করে কোরআন তেলাওয়াতে নিমগ্ন হতেন। [ইবনে রজব : লাতায়েফুল মাআরেফ : পৃষ্ঠা : ১৮৩।] তাদের অধিকাংশই, বরং, স্বল্প সময় ব্যয়ে কোরআন খতম করতেন—দশ, সাত বা কেউ কেউ মাত্র তিন দিনে। [ইবনে রজব : লাতায়েফুল মাআরেফ : পৃষ্ঠা : ১৮৩।] উম্মতের মহান ইমামদের যারা বছরের পুরোটা সময় সতত নিরত থাকতেন কোরানের আয়াতগুলো বুঝা ও মর্ম উপলব্ধিতে, তাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলা যায়, এটি খুবই সম্ভব ; কিন্তু যারা কেবল রমজান মাসেই কোরআন তেলাওয়াতের কথা স্মরণ করে, তাদের পক্ষে এ কখনোই সম্ভব হতে পারে না। রাসুল এক হাদিসে বলেছেন— لا يفقه من قرأ القرآن في أقل من ثلاث তিন দিনের কমে (পূর্ণ) কোরআন কেউ পাঠ করলে তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না। [ইবনে হিববান : ৭৫৮, হাদিসটি সহি।] কোরানের উদ্ধৃতিগুলোর সত্যায়ন ও আহকামের পূর্ণ আনুগত্যের ভিত্তিতেই কোরআন তেলাওয়াত কাম্য। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ বলেন:— إن القرآن شافع مشفع وماحل مصدق، فمن جعله أمامه قاده إلى الجنة، ومن جعله خلفه ساقه إلى النار কোরআন নিশ্চয় সুপারিশকারী, তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে, সে আল্লাহর কাছে হবে সত্যায়িত-গৃহিত আবেদনকারী, যে কোরআনকে স্থাপন করবে সম্মুখে, কোরআন তাকে জান্নাতের দিশা দেবে, আর যে স্থাপন করবে পশ্চাতে, কোরআন তাকে টেনে নিয়ে যাবে জাহান্নামে। [আব্দুর রাজ্জাক : ৬০১০।] কোরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে এটিই ছিল রাসুলের সুমহান পদ্ধতি। আবু আব্দুর রহমান সালামি বলেন : কোরানের মহান পাঠকগণ—যেমন উসমান বিন আফ্ফান, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ ও অন্যান্যগণ, আমাদের জানিয়েছেন, রাসুলের নিকট হতে তারা দশটি আয়াত লাভ করার পর তার মর্ম-কর্ম বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভ ব্যতীত এগিয়ে যেতেন না। তারা বলেছেন : আমরা একই সাথে কোরআন, তার ইলম ও আমলের জ্ঞান অর্জন করেছি। আল্লামা সুয়ূতী বলেন : এ কারণেই তারা একটি সূরা মুখস্থ করার জন্য সময় নিতেন। [সূয়ূতী : ইতকান : খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৪৬৮।] কোরআন তেলাওয়াতকারীর, সুতরাং, কর্তব্য হল : তার কর্ম ও কথনে সঠিক ও সৎ পথের অনুসারী হওয়া। ইবনে মাসঊদ রা. বলেন:— ينبغي لحامل القرآن أن يُعرف بليله إذ الناس نائمون، و بنهاره إذ الناس يفطرون، وبحزنه إذ الناس يفرحون، و ببكائه إذ الناس يختالون. কোরানের বাহকের উচিত রাতে কোরানে মগ্ন হওয়া—যখন মানুষ নিদ্রায় মগ্ন হয় ; এবং দিনে—যখন মানুষ পানাহারে লিপ্ত হয়, এবং দু:খে—যখন মানুষ আনন্দে উদ্বেল হয় ; এবং কান্নার সময়—যখন মানুষ অহংকারে স্ফীত হয়। [বাইহাকি : শুআবুল ঈমান : ১৮০৭।] আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. বলেন : কোরআন বিষয়ে সমালোচক ও মূর্খদের সংসর্গ যাপন কোরানের বাহকের জন্য উচিত নয়। বরং, সে হবে ক্ষমাশীল, ঔদার্যময়। [কুরতবি, আল জামে লি আহকামিল কোরআন : খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫৩।] হাসান বলেন :— إنكم اتخذتم قراءة القرآن مراحل، وجعلتم الليل جَمَلا فأنتم تركبونه فتقطعون به مراحله، وإن من كان قبلكم رأوه رسائل من ربهم، فكانوا يتدبرونها بالليل وينفذونها بالنهار. তোমরা কোরআন শিক্ষাকে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে নিয়েছ। রাতে তোমরা কোরআন শিক্ষায় অতিবাহিত কর। আর তোমাদের পূর্বসূরীগণ কোরআনকে মনে করতেন প্রতিপালকের পক্ষ হতে প্রেরিত বার্তা স্বরূপ। রাতে তারা এর শিক্ষায় মগ্ন হতেন, দিনে প্রয়োগ করতেন। [গাজ্জালী : ইহয়াউ উলুমিদ্দীন : খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৭৫।] যাদেরকে আল্লাহ কোরআন শিক্ষায় ভূষিত করেছেন, দান করেছেন এ মহান নেয়ামত, তারাই যখন ছিলেন এমন ব্যাকুল ও কোরআন শিক্ষার অতিশয় আগ্রহে মগ্ন, সুতরাং, আমরা কেন, কি কারণে পিছিয়ে যাব ? কোরানে উক্ত মহান ব্যক্তিদের উল্লেখ করে ইরশাদ করা হয়েছে— إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآَنَهُ فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآَنَهُ. এটা সংরক্ষণ ও পাঠ করার দায়িত্ব আমার। যখন আমি তা পাঠ করি, তখন তুমি সে পাঠের অনুসরণ কর। অত:পর তা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব আমারই। [সূরা কেয়ামত : আয়াত : ১৭, ১৮।] কোরানের এ আয়াত ও বর্ণনাগুলো নিশ্চয় আমাদের নতুন উদ্যমে কোরআন পাঠে আত্মনিয়োগ করার পথে আগ্রহী করে তুলবে ! কোরানের মর্ম ও উপলব্ধি, জ্ঞান ও হেদায়েত আমাদের আত্মাকে করবে আরো প্রসারিত-প্রশস্ত, পার্থিব ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক ও কল্যাণকামী। কোরআন শিক্ষা ও অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সকলের সাথে সহপাঠ, সম্মিলিত অনুশীলন না একাকী তেলাওয়াত উত্তম ?—এ ব্যাপারে নানা মত থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি পাঠক ও তেলাওয়াতকারীর মানসিকতা ও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। সকলের সাথে সমবেত হয়ে সহপাঠ বা অনুশীলন যদি তেলাওয়াতকারীর নিকট উত্তম ও অধিক একাগ্রতা-বিনয় উদ্রেককারী মনে হয়, তবে তাই উত্তম, অন্যথায়, তার মানসিকতা অনুসারে একাকী-নির্জনতা বেছে নিবে, মগ্ন হবে ঐকান্তিক নীরবতায়। [ইবনে উসাইমিন : মাজমুঊ ফাতাওয়া : খন্ড : ২০, পৃষ্ঠা : ৭৮।] রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহানুভবতা, সকলের সাথে সমান এহসানপ্রবণ আচরণ, বিনয়, যুহুদ, অপরকে প্রাধান্য প্রদান—ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোরানের সহপাঠ কীভাবে ক্রিয়া করত, আগামীতে আমরা তা আলোচনা করব। কোরানের প্রতি সর্বস্ব নিবেদন ও আকুতি দাওয়াত ইলাল্লাহর জন্য খুবই সহায়ক, আনুগত্য ও এবাদতে বিপুলতা আনয়নকারী এবং সৎকাজের উদগাতা। এ ক্ষেত্রে অধিক অগ্রগামী ব্যক্তি এ সকল সৎকর্মের মাধ্যমে নিজেকে ভূষিত করতে সক্ষম হবে সন্দেহ নেই। বর্তমান মুসলিম সমাজের দূরাবস্থার সচেতন যে কোন সমাজ-পাঠকই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন : উম্মতের অধিকাংশ দূরবস্থার সূচনা কোরানের বর্জনের সূত্র ধরে। কোরআনকে হেলা করেছে বলেই জাতি ও উম্মত হিসেবে মুসলিম উম্মাহ আজ সবার চোখে, যাবতীয় সক্রিয় ক্ষেত্রে হেলার পাত্র। কোরানের সামাজিক পাঠ দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে ক্রমশ তাদের অস্তিত্বের ভীত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বলয়। কোরানের পূর্ণ অনুসরণ-অনুবর্তন ব্যতীত এই ‘তীহ’ হতে আমাদের মুক্তি নেই, অনবরত তাতেই আমাদের ঘুরপাক খেতে হবে দীর্ঘ লাঞ্ছিত-কাল ধরে। কোরআন তেলাওয়াত, গবেষণা, সর্বাত্মক আমল ও কোরানের শাসন প্রণয়ন—ইত্যাদি হবে আমাদের এ পথ উত্তরণের স্তর ও পর্ব। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। মূল : ফায়সাল বিন আলী আল বাদানী অনুবাদ : কাউসার বিন খালেদ সম্পাদনা : ড. মাওলানা মুহাম্মাদ শামসুল হক সিদ্দিক গ্রন্থনা : মাওলানা মিরাজ রহমান