ছবি সংগৃহীত

মায়ের স্মৃতি

মহিবুল এজদানি খান
লেখক
প্রকাশিত: ০১ আগস্ট ২০১৫, ১০:০২
আপডেট: ০১ আগস্ট ২০১৫, ১০:০২

মায়ের সাথে লেখক ‘মা’ এক বিশাল সর্বজনীন নাম, ধরনীর সবচেয়ে মধুরতম শব্দ! ছোট্ট একটি শব্দ হলেও একটি জীবন সৃষ্টির জন্য তার অবদান অতুলনীয়। এই মায়ের ভালবাসাকে কখনো মুল্য দিয়ে খন্ডন করা যায় না। মায়ের ভালোবাসাকে শুধু মুল্য কেন এই বিশ্বে এমন কিছুই নেই যার সাথে তুলনার মাপকাঠিতে নির্ণয় করা সম্ভব। মা-হলেন সন্তানের একমাত্র মমতার সুশীতল স্নিগ্ধ ছায়া। যে মানুষটি তার জীবনকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের আগলে রেখে লালন পালন করেছেন, আমাদের বড় করে তুলেছেন, আমাদের নিয়ে সবসময় স্বপ্ন দেখেছেন, শুভ কামনা করেছেন তিনি হলেন মা। কুড়িগ্রামে জন্ম নিয়ে বড় হয়েছি পুটিয়া, বরিশাল, বীরগঞ্জ, পঞ্চগড়, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, চট্টগ্রাম ও সবশেষে ঢাকা। বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। যার কারণে ঘুরে ফিরে বড় হতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বড় হয়ে উঠা এই জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে মায়ের নিরাপদ আশ্রয়ের কোনো অভাব পাইনি কখনো। আমার সেই মায়ার মা আজ আমাদের থেকে অনেক দুরে চলে গেছেন। ফিরে না আসার দেশে চলে গেছেন। সেখান থেকে আর কখনো তিনি ফিরে আসবেন না। তাঁর স্নেহের শীতল-স্নিগ্ধ মমতা দিয়ে শাড়ির আঁচলে আর কখনো মুখমণ্ডল মুছে দিবেন না। জীবন চলার পথে সকল ক্লান্তি, সমস্যা আর চিন্তার সবকিছুই মায়ের স্নেহ ভরা স্পর্শে একদিন যে সুখ ও শান্তি ফিরে পেতাম আজ আমি তা থেকে বঞ্চিত। মা হলেন পরিবারের একটি শক্ত স্তম্ব, একটি কেন্দ্র, একটি সমাধান, একটি সংসারের চাবিকাঠি। মাকে আমরা যতই দুঃখ দেই না কেন তবু তিনি কোলে টেনে নেন তার স্নেহময়ী মায়ার আবরণে। মার ভালবাসা পবিত্র, চিরন্তন, ও শাশ্বত। মা’কে হারিয়েছি ২১ আগস্ট ২০১৪। দেখতে দেখতে একটি বছর পার হয়ে যাচ্ছে। অথচ এখনো আমার কাছে মনে হয় আমার মায়ার মা আমার কাছেই আছেন, আমার পাশেই আছেন। স্বশরীরে না হলেও তিনি আছেন আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে। এখনো কথা বলেন টেলিফোনে। কিরে কবে আসবি বাংলাদেশে? মা কি কখনো আবার হারিয়ে যায়? এইতো সেদিন স্বপ্নে এসে আমাকে দেখা দিয়ে বললেন, আমার খুব কষ্ট ওর রে, পেটো বিশ করের (আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, পেটে ব্যথা করছে)। ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আল্লাহর কাছে দোয়া করে বললাম, হে আল্লাহ তুমি আমার মাকে শান্তি দাও, ক্ষমা করে দাও। মা আছেন, মা থাকবেন। মায়ের কথা, মায়ের উপদেশ, মায়ের নির্দেশ সন্তানের চলার পথের পাথেয়। মায়ের মমতা আজ ছায়ার মত আমার জীবনের সাথে মিশে আছে। মায়ের ঋণ কখনো শোধ করা যায় না। মায়ের নির্দেশ অমান্য করে এমন সাহস কি কারো আছে? নিশ্চই না। তবুও স্বার্থের টানে অনেকে করে বসে ভুল। মায়ের বলে যাওয়া নির্দেশ পালনে অমান্য হয়। আর এই ভুলের মাশুল নিজের অজান্তেই দিতে হয় জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত। ভোগ করতে হয় চরম শাস্তি। ইতিহাস বলে, ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক সংসার জীবন শুধুমাত্র মায়ের মনে দু:খ দেওয়ার কারণে। যাদের হৃদয়, মাতৃহৃদয় কিংবা মায়ের ভালবাসা বলতে কিছুই নেই তারাই করে বসেন এমন ভুল। জীবিত মায়ের চেয়ে ফিরে না আসা জগতের মা আরো অনেক শক্তিশালী। তিনি আজ কাছে না থাকলেও দূর থেকে নিশ্চয়ই সবকিছুই দেখছেন। কথায় বলে, বিশ্বাসে আনে ধন তর্কে বহুদূর। সুতরাং মায়ের নির্দেশ অমান্য করে এমন সাধ্য কার! আমরা পাঁচ ভাই তিন বোন। একই মায়ের গর্ভে আটটি সন্তান। আমাদের এই বিশাল সংসারকে আগলে ধরে রেখেছিলেন মা। ষাট দশকের কথা। সকালে মা নাশতা খেতে দিতেন। কোনদিন মুড়ি মুড়কি, কোনদিন আটার রুটি সাথে নালী গুর আর চা। এতগুলো ভাই বোনকে সামলে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের মধ্যে অন্যদের চেয়ে মা একটু বেশিই আদর করতেন মেঝো ভাইকে। দুষ্ট থাকার কারণে বাবা তাকে একটু বেশি মারধর করতেন। এই কারণেই হয়তো সব ভাইবোন মিলে খাওয়ার সময় মা আদর করে মেঝো ভাইয়ের প্লেটে একটু বেশি দিতেন। এনিয়ে আমরা কখনো কোনো কথা না বললেও মনে মনে খারাপ লাগতো। বিকেল বেলা বাসায় ফিরে এসে রাতের খাবারটা আগে থেকেই মা রেধে রাখতেন। ছোটবেলা আমাদের সকলেরই দিন কাটতো পায়ে হেঁটে, দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলা আর পড়াশোনা করে। একটি বাই সাইকেল পর্যন্ত কিনে দেওয়ার আর্থিক ক্ষমতা ছিল না আমার বাবার। কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ পুলিশ কর্মকর্তা। অন্যদিকে মায়ের আন্তরিকতা ও স্নেহ মমতায় আমাদের কখনো কোনো কিছুরই অভাব অনুভূত হয়নি। আমার সেই মায়ার মা বেঁচে ছিলেন ৮৪ বছর। ভালোবাসা আর দয়ার এক স্বর্গীয় প্রতিচ্ছবি ছিলেন আমার মা। আমার পৃথিবী শুধু তোমাকে জানত মা! বিদেশ থেকে গিয়ে বিছানায় তোমার পাশে গল্প শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পরতাম। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি তুমি তখনো জেগে আছো। তোমার এই জেগে থাকা দেখে আমি আর ঘুমুতে পারতাম না। তুমি শুরু করতে গল্প। অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে। তোমার কথা শুনতে শুনতে একসময় ঘুম এসে যেতো। তখন তুমি বলতে, কি তা রে তুই গুমাই গেসোস নি (কিরে তুই ঘুমিয়ে পড়লি নাকি)? না আম্মা আমি হূনিয়ার তোমার কতা (না মা আমি শুনছি তোমার কথা)। আবার শুরু হলো তোমার কথা। একসময় তুমি নিজে থেকেই বুঝতে পারলে ছেলে আমার ঘুমিয়ে যাচ্ছে। তখন বলতে, অনে গুমাই যা (এখন ঘুমিয়ে পর)। আমি ঘুমিয়ে পরতাম। তোমার দৃষ্টির আড়ালে আমার চোখে জল গড়িয়ে পড়তো। তুমি জানতে ছেলের কষ্ট মা। তোমার আদর মাখা হাত ঐসময় আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিত। তোমার ভালোবাসা, তোমার স্নেহ, তোমার বিশ্বাস আমাকে শক্তি ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে মা। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে মা বাবাকে ছেড়ে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই ঢাকার সোবহানবাগ কলোনির বাসা থেকে রাজনৈতিক সমস্যার কারণে বিদেশ পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। যাওয়ার সময় দেখেছিলাম মার কত চিন্তা। কেঁদে কেঁদে বললেন, আল্লা আছইন, কুনো চিন্তা করিস না (আল্লাহ আছে, কোনো চিন্তা করিস না)। বিদায়ের সময় দেখেছি আমার চিন্তিত মা কীভাবে বারান্দা থেকে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। মায়ের পাশে দাড়িয়ে আছে বাবা ও ভাই বোন। ইতোমধ্যে আমার দুই ভাই ও এক বোন লন্ডনে পাড়ি দিয়েছিলেন। আমি তাদের চতুর্থ সন্তান এখন বিদেশ যাওয়ার পথে। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে মা বাবার ধৈর্য ও সহ্য ক্ষমতা কিছুটা হলেও শক্ত হয়েছে বলতে হয়। মা তো মা’ই। সন্তানের বিচ্ছিন্নতায় কষ্ট তো লাগবেই। সেদিন দেখেছিলাম কিভাবে মায়ের মলিন মুখটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে বাঁধ ভাঙা জল। মায়ের মুখের দিকে তাকাতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। আমারও বুক ফেটে কান্না আসে। জীবনের তাগিদে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেদিন আমার মায়ার মাকে ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলাম অনেকটা স্বার্থপরের মতো। সেদিনের মায়ের কান্নার শব্দটা এখনো আমার কানে বাজছে। আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, আমি তোমাকে কাঁদিয়েছি মা। মাঝে কেটে গেছে অনেকটা বছর। আজও ভুলিনি তোমার সেই কষ্টের কথা। আমি বুঝি তোমার কষ্ট। ছোট থেকেই তোমাকে অনেক কষ্ট করতে দেখেছি। একজন সৎ পুলিশ অফিসারের স্ত্রী হিসেবে অনেক কষ্ট করে একা সামলে নিয়েছিলে তুমি আমাদের বিশাল সংসার। তোমার অনেক স্বাদ আল্লাদকে দিয়েছিলে বিসর্জন। ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ হয়নি একটি ভালো শাড়ি পড়ার। চিন্তা করেছো সংসার চলবে তাহলে কি করে। আমার সেই আদরের মা আজ চলে গেছে ফিরে না আসার দেশে। কোনো সন্তান কখনোও তার স্নেহময়ী মাকে হারাতে চাইবে না। চাইবে কি? জীবন মরণ সবকিছুই আল্লাহর হাতে। এখানে কারো কিছুই করার নেই। আমাদের সকলকেই একদিন এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হবে। আমার মায়ার মা তাই গত ২১ আগস্ট ২০১৪ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আজ শুধু তোমাকে মনে করা, তোমার জন্য দোয়া করা, তোমার আদেশ উপদেশকে মেনে চলাই হবে আমার চলার পথের পাথেয়। অনেকে বলেন, মায়ের জন্য সন্তানের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। আজ এই মুহুর্তে আল্লাহর কাছে দোয়া করি, হে আল্লাহ, তুমি আমার মাকে ক্ষমা করো, তাকে শান্তি দেও, তার উপর বেহেস্ত নসিব করো। আমি তোমাকে ভালোবাসি মা। মাগো সত্যি আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) স্পষ্টভাবে ঘোষনা করেছেন, মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেস্ত। জানিনা সেই বেহেস্তে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হবে কি না। তোমাকে হারিয়ে আজ আমি বড় অসহায় রে মা। আজ আমার অভিযোগ ও আবদার করার আর কেউ রইলো না। তুমি আমাকে ক্ষমা কর মা। লেখক: সাবেক নির্বাচিত কাউন্সিলর স্টকহম সিটি কাউন্সিল ও স্টকহম কাউন্টি কাউন্সিল