বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার দিক দিয়ে অনেক উন্নত ছিল প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা। কিন্তু সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতার সাথে তাদের একটি বিশেষ অমিল দেখা যায় আর তা হলো, লোহার ব্যবহার। মিশরীয় সভ্যতার নিদর্শনগুলো থেকে দেখা যায়, লোহার সাথে তারা পরিচিত হলেও এটি তারা ব্যবহার করত ব্রোঞ্জের চাইতে অনেক কম। এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, লোহাকে তারা অশুদ্ধ ও অপবিত্র মনে করত। মিশরীয় পুরাকাহিনীর অশুভ আত্মা সেথ এর সাথে এর যোগ আছে মনে করেই লোহাকে খারাপ চোখে দেখা হত। কিন্তু ১৯১১ সালে পরিচালিত এক খননকার্যে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালের মিশরীয় সমাধিতে পাওয়া যায় ৯ টি লোহার তৈরি পুঁতির মালা, যা সমাধিস্থ ব্যক্তিদের শরীরে পেঁচানো ছিল। ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদদের মোটে, এল গারজেহ নামের এই এলাকায় পাওয়া এই লোহার নিদর্শন তৈরি হয়েছে উল্কাপিণ্ড থেকে পাওয়া লৌহ আকরিক থেকে। এই মালাগুলোতে লোহার পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে ল্যাপিস লাজুলি, অ্যাগেট এবং স্বর্ণের মত বিভিন্ন দামি এবং দুর্লভ উপাদান। এই নিদর্শনগুলো রাখা আছে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এর পেট্রি মিউজিয়াম এ।

উল্কাপিণ্ড থেকে পাওয়া লোহার আকরিক আর পৃথিবীতে পাওয়া লোহার আকরিকের মাঝে রয়েছে কাঠামোগত এবং উপাদানগত পার্থক্য। এটি পরীক্ষা করার জন্য ব্যবহার করা হয় প্রম্পট গ্যামা নিউট্রন অ্যাক্টিভেশন অ্যানালাইসিস (PGAA) নামে একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে নিদর্শনের নমুনাটিকে কম শক্তির নিউট্রনের রশ্মির নিচে রাখা হয়। নমুনার উপাদানগুলো এই রশ্মি শোষণ করে এবং প্রতিক্রিয়ায় গামা রশ্মি বিচ্ছুরণ করে। এই গ্যামা রশ্মির ধরণ থেকে বোঝা যায় এটিতে কি উপাদান আছে। গবেষক দলটি এ প্রক্রিয়ায় নমুনার মাঝে খুঁজে পায় নিকেল, ফসফরাস, কোবাল্ট এবং জেরানিয়াম যা থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এই নমুনাগুলো তৈরিতে পৃথিবীর লৌহ আকরিক ব্যবহার করা হয়নি, কারণ পৃথিবীতে পাওয়া লৌহ আকরিকে কখনোই জেরানিয়াম থাকে না। এই নমুনাগুলোর ওপর গবেষণা চলছিল ১৯২০ সাল থেকেই কিন্তু এর আগ পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হয়নি এগুলো সত্যিই পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে কি না। এবার তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হল।
এর পাশাপাশি এক্স-রে স্ক্যান করে দেখা গেছে এই লোহার পুঁতিগুলোকে তৈরি করার জন্য বারবার আগুনে উত্তপ্ত করা এবং হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়েছিল। এই প্রক্রিয়াটি সে সময়ে প্রচলিত প্রক্রিয়া, অর্থাৎ পাথরে খোদাই করে ফুটো তৈরি করার পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। উল্কাপিণ্ডের লৌহ আকরিক নিয়ে কাজ করা খুবই কঠিন এবং এটি দিয়ে অলঙ্কার তৈরি করায় বোঝা যায় সে প্রাচীন সময়েও মিশরীয়দের প্রযুক্তি ছিল অসামান্য।