
ছবি সংগৃহীত
সামেরি কে এবং অবাধ্যতার জন্য হজরত মুসা [আ.] তাকে কী শাস্তি দিয়েছিলেন?
আপডেট: ১২ আগস্ট ২০১৫, ০১:৩৫
আল্লাহর নবি হজরত মুসা [আ.] তুর পর্বতে আল্লাহর প্রত্যাদেশ আনতে গেলে সিনাই পর্বতে অপেক্ষমাণ ইসরাইলিদের মধ্য থেকে ‘সামেরি’ নামের এক ধূর্তলোক জিবরাইলের পদছাপের কিছু মাটির মিশ্রণে একটি স্বর্ণের বাছুর তৈরি করে। বাছুর বানিয়ে সেটাকে সে বনি ইসরাইলের উপাস্য বলে ঘোষণা দেয় এবং তার ঘোষণায় বনি ইসরাইল সম্প্রদায় মুসার অবর্তমানে সেই গো-বাছুরের পূজা শুরু করে। মুসা [আ.] তুর পর্বত থেকে তার সম্প্রদায়ের অবস্থানস্থল সিনাই পর্বতে ফিরে যখন এমন গো-বাছুরের পূজা-অর্চনা দেখতে পান তখন তিনি রাগে ফেটে পড়েন। প্রথমেই তিনি তার সম্প্রদায়কে লক্ষ করে বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতিপালক কি এক উত্তম প্রতিশ্রুতি দেননি? তার প্রতিশ্রুতির কাল কি বিলম্বিত হয়েছে, না তোমরা চেয়েছো তোমাদের উপর আল্লাহর গজব পড়ুক, আর সে জন্যেই কি আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে?’ (সুরা ত্বহা, আয়াত ৮৬) এরপর তিনি তার ভাই হারুন [আ.]-কে ডাকলেন, যাকে তিনি বনি ইসরাইলিদের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মুসা [আ.]-এর কাছে এলেন। মুসা [আ.] ইসরাইলিদের এমন দুর্ভাগ্যজনক আচরণে এতোটাই রুষ্ট হয়েছিলেন যে, নিজ ভাই হারুন [আ.]-এর দাড়ি ধরে তাকে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। হারুন [আ.] বলতে লাগলেন, ‘তারপর সে ফলকগুলো ছুঁড়ে ফেললো। সে তার ভাইয়ের চুল ধরে নিজের দিকে টানতে লাগলো। ভাই বললো, ‘হে আমার সহোদর ভাই! লোকেরা তো দুর্বল মনে করে আমাকে প্রায় খুন করে ফেলেছিলো আর কি! তুমি আমার সাথে এমন করো না যেন শত্রুরা আনন্দিত হয়। আর আমাকে সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করো না।’ (সুরা আরাফ,আয়াত ১৫০) এ সময় এমন অবাধ্যকাজের মূলহোতা সামেরিকে ধরে আনা হলো। সামেরি কে ছিলো- এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে কাসাসুল কুরআন, কাসাসুল আম্বিয়া বিভিন্ন ইসরাইলি ধর্মীয় গ্রন্থে তার ব্যাপারে যৎসামান্য বিবৃত হয়েছে। সামেরি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলো তখন ইসরাইলিদের পুত্রসন্তান হত্যা করার ব্যাপারে ফেরাউনের আদেশ বলবৎ ছিলো। নিজের চোখের সামনে সিপাহিদের হাতে স্বীয় পুত্রের মৃত্যুদৃশ্য দেখার ভয়ে তার জননী তাকে জঙ্গলের একটি গর্তে রেখে উপর থেকে ঢেকে দিয়ে এসেছিলেন। এ সময় আল্লাহর নির্দেশে জিবরাইল [আ.] তাকে দেখাশোনা করেছিলো। কাসাসুল কুরআন গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, এ কারণেই হয়তোবা পরবর্তীতে সে অন্য সবার মাঝে থেকেও জিবরাইলকে দেখেই তাকে চিনে ফেলেছিলো। সাগর পাড়ি দেবার পর সিনাই পর্বতের কাছাকাছি পৌঁছলে মুসা [আ.]-কে ব্যবস্থা আনতে তুর পর্বতে গমনের আদেশ শোনানোর জন্যে জিবরাইল [আ.] অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে যখন এসেছিলেন তখন সে তার অশ্বের পদছাপ থেকে কিছু মাটি সংগ্রহ করে রেখেছিলো। কেননা সে দেখেছিলো, এই অলৌকিক অশ্ব যেখানেই পা রাখে সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে ঘাস উৎপন্ন হয়ে যায়। যা হোক, তাকে যখন এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলো তখন সে বললো,সে বললো, ‘আমি যা দেখেছিলাম ওরা তা দেখেনি। তারপর আমি প্রেরিতপুরুষের পায়ের চিহ্ন থেকে এক মুঠো (ধূলো) নিয়েছিলাম ও তা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম, আর আমার আত্মা আমাকে প্ররোচিত করেছিলো এভাবেই।’ (সুরা ত্বহা, আয়াত ৯৬) মুসা [আ.] সবার বক্তব্য শোনার পর তার উম্মতের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ প্রত্যাদেশ দিলেন। মুসা তার নিজের সম্প্রদায়কে বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! গো-বৎসকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে তোমরা নিজেদের ওপর ঘোর অত্যাচার করেছো, সুতরাং তোমরা সৃষ্টিকর্তার দিকে ফিরে যাও, আর তোমাদের আত্মাকে পরস্পর সংহার করো। তোমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে এই হবে কল্যাণকর। তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাপরবশ হবেন, তিনি তো ক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ৫৪) আল্লাহ তাদের শাস্তি দিলেন, যারা স্বর্ণবাছুরের পূজা করেছে তারা পরস্পরকে হত্যা করে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে। সামনে অন্য কোনো পথ খোলা না থাকায় অবশেষে এই কঠোর আদেশ ইসরাইলিরা মেনে নিলো এবং একে অপরকে হত্যা করতে শুরু করলো। এভাবে ৭০ ব্যক্তি নিহত হলে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমার সু-সংবাদ দেন আর যারা নিহত হলো তারা শহিদ হিসেবে গণ্য হলো। এই পাপকাজের ইন্ধনদাতা সামেরিকে নবি মুসা হত্যা করতে চাইলেন। কিন্তু জিবরাইল তাকে তা করতে নিষেধ করলেন তার অতীত কর্মের কারণে। কেননা মিসরে বনি ইসরাইলিদের দেশত্যাগে সংগঠিত করতে সে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিলো। সামেরির জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হলো ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। এ দিনের পর থেকে সামেরি এক ঘৃণ্য জ্বরে আক্রান্ত হলো এবং মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সে এই জ্বরে আক্রান্ত ছিলো। এই জ্বরের প্রভাব এমন হতো যে, মনে হতো তার শরীরে আগুন লেগে গেছে। সারা শরীর আগুনের মতো দাউদাউ করে জ্বলতো। যে কেউ তাকে স্পর্শ্ব করতো সে-ই ওই জ্বরে আক্রান্ত হতো এবং সামেরির জ্বলুনি দ্বিগুণ হয়ে যেতো। এ কারণে সে সকলকে তার কাছ থেকে দূরে থাকতে অনুরোধ করতো। শেষপর্যন্ত সে লোকসমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয় এবং অতি অসহায় অবস্থায় বিজনবনে মৃত্যুবরণ করে। [আল কুরআনে সুরা বাকারার ৫২-৫৪, সুরা আরাফের ১৪৯-১৫৪, সুরা ত্বহার ৮৬-৯৮ নং আয়াতে এ বিষয়ে আলোচনা এসেছে। সমস্ত তাফসিরগ্রন্থেই বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।] হাফেজ মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর [হাফেজ মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর অনুসন্ধানী তরুণ লেখক। ধর্মদর্শন, ইতিহাস, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় মিথ, ইতিহাসের আড়ালের ইতিহাস নিয়ে কাজ করে থাকেন। ইতোমধ্যেই ইতিহাসভিত্তিক তার লেখা বেশকিছু বই প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে আরও কিছু গ্রন্থ। ইতিহাসের জানালা তার রচিত একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ। সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ২০০৮ সালে জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া থেকে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করেন। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স সম্পন্ন করেছেন দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে সহযোগী সম্পাদক ছিলেন সাপ্তাহিক লিখনীতে। বর্তমানে তিনি ফ্রিল্যান্সিং লেখালেখিতেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।]