প্রচ্ছদ: সোহানুর রহমান অনন্ত, প্রকাশক: রাজিয়া রহমান জলি, জাগৃতি প্রকাশনী

জামান সাহেবের স্ত্রী: পর্ব ৬

রুমানা বৈশাখী
বিভাগীয় প্রধান (প্রিয় লাইফ)
প্রকাশিত: ২২ মে ২০১৮, ১৭:৪৪
আপডেট: ২২ মে ২০১৮, ১৭:৪৪

কাহিনি সংক্ষেপ 

তার নিজের কোনো নাম ছিল না, ছিল কেবল একটি পরিচয়। তিনি জামান সাহেবের স্ত্রী। এই পরিচয়ে তার কোনো আপত্তিও ছিল না কোনোদিন।

তারপর একদিন গভীর রাতে জামান সাহেব ঘরে নিয়ে এলেন আরও একজন বউ...

ক্ষোভে কিংবা অভিমানে, 
ক্রোধে কিংবা অপমানে, 
একই ছাদের নিচে থেকেও প্রিয় পুরুষটির সাথে সেই নারী তৈরি করে নিলেন এক জীবনের ব্যবধান। একমাত্র পরিচয়খানাও তাই গেল হারিয়ে, সে রাতেই। শুনতে পাওয়া যায়, জীবনে আর কোনোদিন জামান সাহেব তাকে দেখতে পাননি। চোখের দেখাও না।

এই গল্প, তীব্র অভিমানে আজীবন অবগুণ্ঠনের আড়ালে থাকা একজন নারীর, প্রিয় মানুষটিকে যিনি দিয়েছিলেন খুব কঠিন শাস্তি।

এই গল্প সম্পর্কের জটিল সমীকরণে জড়িয়ে যাওয়া একজন পুরুষের, যিনি আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন ভালোবাসার পাপ।

তারপর একদিন... 
বহু বছরের ব্যবধান পাড়ি দিয়ে জীবন তাদেরকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল আবারও মুখোমুখি।

এই গল্প অপমান, প্রতারণা, বঞ্চনার।
এই গল্প পাপ, স্মৃতি ও ভালোবাসার।
এই গল্প বহুকাল বাদে দুজন মানব-মানবীর প্রথম দেখার।
এই গল্প তীব্র অভিমানে জীবন পার করে দেওয়ার।

কিংবা- 
একজন তরুণী গৃহবধূর। 
তারও নিজের কোনো নাম ছিল না, কিংবা হারিয়ে গিয়েছিল সংসারের গর্ভে।

তিনি কিংবা তারা... জামান সাহেবের স্ত্রী।

(‘জামান সাহেবের স্ত্রী’একটি উপন্যাস। চলতি বছরের জুন মাসে প্রকাশিত হবে গ্রন্থ আকারে, প্রকাশ করবে জাগৃতি প্রকাশনী। প্রিয়.কমের পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে উপন্যাসটি। পাঠকের সাড়া পেয়ে নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ থাকছে পঞ্চম পর্ব। - রুমানা বৈশাখী) 

৬. টানা বারান্দার একদম শেষ মাথার ঘরটা তিয়াসের। আসিফুজ্জামান তিয়াশ, জামান সাহেবের ছোট পুত্র। কিংবা...একমাত্র সন্তান! এ বাড়িতে যার পরিচয় বাবার নামের সাথে মিলিয়ে- ‘ছোট জামান!’

একটু বখাটে, অনেকটা একরোখা, খানিকটা যেন উচ্ছৃঙ্খল এক তরুণ। পিতার মতন দীর্ঘকায়, সুঠামদেহী। মায়ের মতো চঞ্চল, উচ্ছ্বল। এই জন্যই বুঝি লেখাপড়াটা ভালো করে শেখা হয়নি, শেখার ইচ্ছাও বিশেষ নেই বলেই মনে হয়। বাবার চালের আড়তগুলো দেখাশোনা করে আর মোটরবাইক দাপিয়ে দিন কাটে ছেলের। নবনীর যখন মন কাঁদে মামার বাড়ির জন্য কিংবা লাইব্রেরি থেকে বই বদলের প্রয়োজন হয়, তখন সেই মোটরবাইকে চাপিয়েই নিয়ে যায় আগ বাড়িয়ে।

সাথে সাথে ঘোরে, পাশে পাশে হাঁটে, আগে আগে চলে।

অকারণের কানের দুল বাছতে সাহায্য করে ভীষণ উৎসাহ নিয়ে, দোকানির সাথে ঘন্টাব্যাপী সস্তা কাচের চুড়ির দরদাম করে নিজ থেকেই, কটকটে রঙের ভিড়ে মিষ্টি গোলাপি একখানা তাঁতের শাড়ির জন্য প্রতিটি দোকান চষে ফেলে পায়ে হেঁটে হেঁটে।

তারপর...

সকল বাহানা ফুরিয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত কুলফি বরফ কিনে দেয়। ঘন মালাই আর দুধের সর জমিয়ে তৈরি করা ছোট ছোট কুলফি বরফ। ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় একটি দুটি কিসমিস, নাকে লাগে গোলাপ জলের হালকা ঘ্রাণ। খাবার নয়, যেন এক টুকরা শৈশব কিনে হাতে গুঁজে দেয় তিয়াশ। মামা যেমন দিতেন, বৈশাখী মেলায় ঘোরার ফাঁকে দুই টাকা দামের কুলফি বরফ। ঝাঁ ঝাঁ রোদ মাথায় নিয়ে মামার হাতের সেই দুই টাকার কুলফিকে অমৃত মনে হতো।

অদ্ভুত এক ছেলের মোটরবাইকের পেছনে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এই কুলফি বরফকেও নবনীর অমৃত মনে হয়! জানে অন্যায়। তবু মনে হয়। কেন মনে হয়, সেটাও নবনী জানে না।

কখনো ভর সন্ধ্যায়, আলতা বানু যখন বৈঠক ঘরে প্রতিবেশী বান্ধবীদের সাথে শখের তাস পেটান, তখন চুপি চুপি অদ্ভুত ছেলেটা ছাদে আসে গল্প করতে। হাওর ছুঁয়ে উড়ে আসে সোঁদা গন্ধমাখা বাতাস। বুকে বুক ভরে টেনে নেয়, আবছায়া অন্ধকারে জ্বল জ্বল করে অতল গভীর চোখ দুটি। নবনীর মনে হয় সন্ধ্যার আকাশে প্রথম নক্ষত্র বুঝি সেই দুটি চোখ। আর কেউ নেই, আর কিচ্ছু নেই। আধো অন্ধকার আকাশজুড়ে কেবল দুটি ঝলমলে নক্ষত্র।

হাত বাড়ায় সে।

ভরসার হাত। আস্থার। সহমর্মিতার। আনাড়ি হাতে গিটার বাজানো সুরেলা হাত।

নবনীর মতো সাদামটা কোনো মেয়ে এটুকুই তো খোঁজে জীবনের কাছ থেকে, এটুকুই তো দাবি করে। স্বচ্ছ জলের মতন কোনো পুরুষ, যার চোখের তারায় নিজের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। কোনো বিভ্রান্তি নেই, কোনো চটকদার আলোর ঝলকানি নেই। চোখের শান্ত জলের মাঝে তীক্ষ্ণ একটা প্রতিচ্ছবি কেবল।

তিয়াশের চোখে দেখা যায় কি...নবনীর প্রতিচ্ছবি?

জানে না, জানে না...নবনী কিচ্ছু জানে না!

সম্পর্কে তো দেবর হয়, কিন্তু সমবয়সী সে। আর সমবয়সী বলেই হয়তো বন্ধু। এই বাড়ির সোনার খাঁচায় বন্দী জীবনটার একমাত্র বন্ধু...
কিংবা একটুখানি বেশি। একটুখানি!

ঠিক কতখানি বেশি, সেটা অবশ্য নবনীর জানা নেই। জগতের সকল কিছু তো আর ওজনের নিক্তিতে মেপে ফেলা যায় না। কিছু জিনিস থাকে, যাদের ভর কেবল হৃদয় পরিমাপ করতে পারে। যন্ত্রের সাধ্য কই, সেই গভীরতার নির্ণয়ের হিসেব- নিকেশ কষে।

আবছায়া আলো মিলিয়ে গিয়ে গাঢ় সন্ধ্যা নামে পৃথিবীর শরীরে। বুকের মাঝে অকারণেই হু হু করা সন্ধ্যা। একটি-দুটি জোনাকি উড়ে উড়ে যায় অলস গতিতে, বৈঠকখানা থেকে ভেসে আসে চায়ের কাপের টুংটাং আওয়াজ। বাতাস বয়ে নিয়ে আসে হেঁশেল ঘরে ডালে ফোড়ন দেবার ঘ্রাণ। আম গাছের ডালে শিষ কেটে ছুঁটে চলে যায় বাতাস, দূরে কোথাও একখানা ঘুঘু অসময়ে ডেকে ওঠে...

অদ্ভুত ছেলেটির নক্ষত্র জ্বলা চোখ দুটি দেখতে দেখতে হাসে নবনী।

এইসব ভালো।

এইসব ভালো আর সুন্দর। এই সবকিছুই সুন্দর, পবিত্র, শান্ত। শীতের রাতে নরম কাঁথার নিচে আলগোছে শুয়ে থাকার মতন উষ্ণ। সকালের নরম রোদে ভেজা চুল শুকোনোর মতন আরামদায়ক। হেমন্তের রাতে হিম হিম হাওয়ার স্পর্শের মতন শিহরণ জাগানো।

এইসব ভালো। স্বস্তির।

যেমন স্বস্তি জগতের সকল কিছুকে ভুলে গিয়ে ভালো থাকতে শেখায়, ততটুকু স্বস্তির। যতটা সুখে বুকের মাঝে একটি দুটি প্রজাপতি ওড়ে, ততটুকু সুখেরও।

নবনী তাই আগে বাড়তে চায় না কখনো, সম্পর্কের নাম খুঁজতে যায় না। নাম খোঁজার ডামাডোলে প্রায়ই সম্পর্কগুলো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, ভালোবাসা হারিয়ে গিয়ে তখন কেবল নামটাই রয়ে যায়। নবনী তাই নাম চায় না। নবনী তাই পরিচয় চায় না। নবনী তাই কিচ্ছু চায় না, আর ঘুণে ধরা জীবনের দানবাক্স থেকে।

নবনী শুধু চায়...

এই মুহূর্তগুলি থাকুক। অনন্তকাল থাকুক।

অনন্ত...অনন্ত কাল!

(চলবে...)

আগের পর্বগুলো পড়তে চাইলে

জামান সাহেবের স্ত্রী পর্ব- ১

জামান সাহেবের স্ত্রী পর্ব-২ 

জামান সাহেবের স্ত্রী পর্ব-৩

জামান সাহেবের স্ত্রী পর্ব-৪ 

জামান সাহেবের স্ত্রী পর্ব-৫

 

প্রিয় সাহিত্য/আজহার