ছবি সংগৃহীত

মোস্তাফা জব্বারের অজানা অধ্যায়

এম. রেজাউল করিম
প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৫ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৩৮
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৩৮

মোস্তাফা জব্বার। ছবিঃ সংগৃহীত।

(প্রিয়.কম) দেশের অন্যতম তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও বর্তমানে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস ( বেসিস ) এর বর্তমান সভাপতি মোস্তফা জব্বার। অনেকেই ভুল করে তাকে জব্বার ভাই বলেও ডাকেন। নাম ঠিক থাকলেও 'ভুল' বলার কারণ হচ্ছে জব্বার তার বাবার নাম। এই নামের পেছনেও আছে লম্বা একটি ইতিহাস। সম্প্রতি প্রিয়.কমের সাথে আলাপকালে নাম নিয়ে মজার ইতিহাস জানিয়েছেন তিনি নিজেই।

মোস্তাফা জব্বার বলেন, গ্রামের প্রথা অনুযায়ী মেয়ের প্রথম সন্তান তার মায়ের বাড়িতেই জন্মগ্রহন করেন। সেই সূত্রেই আমার জন্ম নানাবাড়িতে। নানা নাম রাখলেন আবু বকর সিদ্দিক। জন্ম তারিখ ১২ হওয়ায় নানী মিলিয়ে নিলেন ১২ই রবিউল আউয়ালের সাথে। তিনি নাম রাখলেন মোস্তাফা। এরপর দাদার বাড়ীতে গিয়ে যোগ হলো গোলাম। সার্টিফিকেটে নাম হলো মোঃ গোলাম মোস্তাফা। 

নাম বিভ্রান্তি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। একই ক্লাসে তিন জন মোস্তফা, একজন মোহাম্মদ মোস্তাফা, মোস্তাফা আহমেদ এবং গোলাম মোস্তফা। তার মধ্যে আবার দুইজনই লেখালেখি করতেন। আরেকটা সমস্যা হলো তখন বাঙ্গালী কবি গোলাম মোস্তাফারও প্রচুর লেখা পত্রিকাতে ছাপা হতো। নিজের একটি পরিচয় বানাতে এই সময়ে নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। দাদার বংশের তালুকদার আর বাবার নাম থেকে জব্বার, হয়ে যান তালুকদার মোস্তাফা জব্বার। এই নামেই প্রচুর লেখালেখি করেন তিনি।

আবার ঝামেলা বাধে রাজনীতি'র মাঠে। বাম সমর্থক হওয়ায় জমিদার প্রথার বিরুদ্ধে চলে যায় তার মন। বাদ দেন নামের প্রথম অংশ, এবার নামকরণ হয় মোস্তাফা জব্বার। এরপর থেকে এই নামেই পরিচিত হতে থাকেন তিনি, এমনকি তার পাসপোর্টেও আর যায়গা পায়নি সার্টিকেটের সেই মোঃ গোলাম মোস্তাফা নামটি।

প্রতিবেদকের সাথে কথা বলছেন মোস্তাফা জব্বার। ছবিঃ প্রিয়.কম।

পরিবার

১৯৪৯ সালের ১২ই আগষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থানার চর চারতলা গ্রামের নানার বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন মোস্তাফা জব্বার। পৈত্রিক সম্পত্তি পাওয়ায় বাবা আব্দুল জব্বার তালুকদার পাটের ব্যবসার পাশাপাশি একজন পুরোদস্তর কৃষক ছিলেন। মা রাবেয়া খাতুন গৃহিনী। বলে রাখা ভালো, মোস্তাফা জব্বারের বাবা দুটি বিবাহ করেছিলেন এবং তিনি দ্বিতীয় পরিবারের সন্তান। বাবার প্রথম সংসারে ১ বোন ছিলো আর দ্বিতীয় সংসারে ৩ ভাই ২ বোন। নিজের পরিবারে বড় মোস্তাফা জব্বার।

মেঝ ভাই কিবরিয়া জব্বার নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুরী থানা উপজেলা আওয়ামিলীগের সভাপতি। সেঝ ভাই এফবিসিসিআই এর সাবেক পরিচালক ও আনন্দ প্রিন্টার্সের মালিক রাব্বানী জব্বার। বোন নিলুফার বেগম গৃহিনী। তাঁর স্বামী নেত্রকোণা জেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। আরেক বোন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। 

দাম্পত্য জীবনে দুটি বিয়ে করেছেন মোস্তাফা জব্বার। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী রোকসানা সুলতানাকে বিয়ে করেন তিনি। রোকসানা সুলতানা হচ্ছেন বেসরকারি সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের পরিচালক। এই সংসারে তাদের দুই কণ্যা সন্তানের জন্ম হয়। বড় মেয়ে সাবরিনা শারমিন পেশায় চিকিৎসক এবং ছোটমেয়ে সুনন্দা শারমিন তন্বী একজন স্থাপত্যশিল্পী। এই মেয়ের নামেই জনপ্রিয় বাংলা ফন্ট সুতন্বী এমজি নির্মাণ করেন মোস্তাফা জব্বার।

১৯৮৯ সালে নারী মুক্তিযোদ্ধা আমেনা সুলতানা বকুলের দ্বিতীয় সংসার পাতেন মোস্তাফা জব্বার। এই পরিবারের একমাত্র সন্তান বিজয় জব্বার। যার নামে সব সফটওয়্যার তৈরি। বিজয় মালোয়শিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সাইন্সে গ্র্যাজুয়েশন করছেন। 

শিক্ষাজীবন

দাদার প্রতিষ্ঠিত চর চারতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনার মাধ্যমে মোস্তাফা জব্বারের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। হাওর এলাকায় বাসস্থান হওয়ায় ধারে কাছে কোন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো। গ্রাম থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জে এএবিসি হাই হকুল থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক এবং  ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে উচ মাধ্যমিক পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন। নিয়মানুযায়ী ১৯৭১ সালে পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের কারণে পরে সেটি বাতিল হওয়ায় পরের বছর ১৯৭২ সালে তিনি স্নাতক পাশ করেন। এরপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।

কর্মজীবন

১৯৬৯ সালে রেডিওতে একটি যুব অনুষ্ঠানে গিয়ে আনুমানিক ১০ টাকা আয় হয়েছিলো। এটাই তার জীবনের প্রথম আয় ছিলো। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে সাপ্তাহিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় সাংবাদিক পেশাদার কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তখন বেতন ছিলো মাত্র ১০০ টাকা। এরপর সাপ্তাহিক থেকে পত্রিকাটি দৈনিক হয়। ৭৫'র জানুয়ারী পর্যন্ত পত্রিকাটিতে তিনি কর্মরত ছিলেন। গণকণ্ঠ বন্ধ হয়ে যাবার পর তিনি ট্রাভেল এজেন্সি, প্রকাশনাসহ আরো কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায় যুক্ত হন। 

এরপর ১৯৮৭ সালের কম্পিউটার ব্যবসায় যোগ দেন মোস্তাফা জব্বার। তখন মেকিন্টোস কম্পিউটারই ছিলো একমাত্র ভরসা। একই বছরের মে মাসে দেশে প্রথম কম্পিউটারে কম্পোজ করা বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা আনন্দপত্র প্রকাশ করেন তিনি। এরপর থেকেই চিন্তা করেন কিভাবে বাংলা ভাষাকে কম্পিউটারে আরো সহজলভ্য এবং জনপ্রিয় করতে উদ্যোগ নেন তিনি। সে ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর মেকিন্টোস কম্পিউটারের জন্য প্রকাশ হয় বিজয় বাংলা কীবোর্ড ও সফটওয়্যার। পরে ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশ করেন উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম সংস্করন। এছাড়াও ডিজিটাল বাংলা নিউজ সার্ভিস 'আনন্দপত্র বাংলা সংবাদ' বা আবাসের চেয়ারম্যান ও সম্পাদক তিনি।

 

একজন সংগঠক 

বর্তমানে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করলেও এর প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি ও পরিচালক হিসেবেও ছিলেন মোস্তাফা জব্বার।  ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য চর্চা, সাংবাদিকতা, নাট্য আব্দোলন এসবের সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তার লেখা বাংলাদেশের প্রথম গণনাট্য এক নদী রক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে (বর্তমান টিএসসি) মঞ্চস্থ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে মোস্তাফা জব্বার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের পক্ষে নির্বাচন করে সূর্যসেন হলের নাট্য ও প্রমোদ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর একই বছর তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নির্বাচিত হন।

তিনি ইতিপূর্বে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির নির্বাহী পরিষদের সদস্য, কোষাধ্যক্ষ ও সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮-০৯ সময়কালে তিনি দ্বিতীয় এবং ২০১০-১১ সালে তিনি তৃতীয় বারের মতো বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এবং পরবর্তী মেয়াদেও তিনি এই সমিতির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কপিরাইট বোর্ড এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের কাউন্সিল সদস্য। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সসহ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক অনেক কমিটির সদস্য তিনি।

লেখক মোস্তাফা জব্বার

কম্পিউটার বিষয়ে অনেকগুলো বই বিভিন্ন পত্রিকায় ব্যাপকভাবে লেখালেখি করেছেন মোস্তাফা জব্বার। নবম ও দশম শ্রেণীর কম্পিউটার বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক মাধ্যমিক কম্পিউটার শিক্ষা বইটির লেখক তিনি। এছাড়াও তার লেখা ‘কম্পিউটার ও ইনফরমেশন টেকনোলজি’ এবং ‘একাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম’ স্নাতক পর্যায়ের পাঠ্য বই। উচ্চ মাধ্যমিক কম্পিউটার শিক্ষা, দুই খণ্ডের প্রাথমিক কম্পিউটার শিক্ষা, মাল্টিমিডিয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ ছাড়াও তার লেখা কম্পিউটারে প্রকাশনা, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, মাইক্রোসফট এক্সেল ও তার সম্পাদিত কম্পিউটার অভিধান ব্যাপকভাবে প্রচলিত কম্পিউটার বিষয়ক বই। তার প্রথম উপন্যাস নক্ষত্রের অঙ্গার ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে। সুবর্ণে শেকড় নামে আরেকটি উপন্যাস তিনি লিখছেন। এছাড়াও কম্পিউটার কথকতা, ডিজিটাল বাংলা, একুশ শতকের বাংলা, বাঙ্গালী ও বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং একাত্তর ও আমার যুদ্ধ তার লেখা বইগুলোর অন্যতম। 

সম্মাননা ও পদক

তথপ্রযুক্তিতে বিশেষ অবদান রাখা ও বিজয় বাংলা কীবোর্ড ও সফটওয়্যার আবিষ্কার করার জন্য তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেরা সফটওয়্যারের পুরষ্কার, পশ্চিমবঙ্গের কমপাস কম্পিউটার মেলার সেরা কমদামী সফটওয়্যারের পুরষ্কার, দৈনিক উত্তরবাংলা পুরষ্কার, পিআইবির সোহেল সামাদ পুরষ্কার, সিটিআইটি আজীবন সম্মাননা ও আইটি এ্যাওয়ার্ড, বেসিস আজীবন সম্মাননা পুরষ্কার ও বেস্টওয়ে ভাষা-সংস্কৃতি পুরষ্কারসহ ১৬টি পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন।

প্রিয় তালিকা

নিজের জীবনের প্রিয় সম্পর্কে মোস্তাফা জব্বার জানান, তার প্রিয় ব্যক্তি বাবা আব্দুল জব্বার, প্রিয় শিক্ষক মাস্টার শহীদুল ইসলাম, প্রিয় খাবার টাকি মাছের ভর্তা, প্রিয় স্থান হাওর এবং পাহাড়ি এলাকা। তিনি সাধারনত অফ হোয়াইট রং পছন্দ করেন, তবে সবসময় মাথায় থাকে লাল-সবুজের মিশ্রণ। এছাড়াও হাওর এলাকায় বড় হওয়ার কারণে পছন্দের তালিকায় অন্যতম স্থানে আছে নীল। 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা 

এই বিষয়ে মোস্তাফা জব্বার বলেন, “ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে যেই স্বপ্ন দেখেছিলাম তা বাস্তবায়ন করে যেতে চাই। যার মধ্যে ডিজিটাল সরকার ও শিক্ষা ব্যবস্থা অন্যতম। ইতিমধ্যেই আমি একটি পাইলট প্রক্লপ শেষ করেছি যেখানে তৃতীয় শ্রেনী পর্যন্ত বইবিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছি। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের সকল শিক্ষার্থীর হাতে যদি ১টি ডিজিটাল ডিভাইস দেয়া যায়। তাহলে তারা সেই ডিভাইসের মাধ্যমে ডিজিটালভাবে শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারবে।”

সম্পাদনা: কুদরত উল্লাহ