ছবি সংগৃহীত

MyFreeLife: ফ্রিল্যান্সিং সহজ নয়; এর জন্য কঠোর পরিশ্রমী এবং ধৈর্য্যশীল হওয়া বাঞ্চনীয়

anwar01740
লেখক
প্রকাশিত: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, ২২:১৮
আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, ২২:১৮

আমার ফ্রিল্যান্সিং জীবন এই কথাটি মনে মনে যখন ভাবি তখন চোখের সামনে অনেক পুরোনো কথা ভেসে আসে। অন্তরের জমানো ব্যাথা চোখের কোনায় অশ্রু আকারে ফুসে বেরিয়ে আসতে চায়। ভেবেছিলাম কথাগুলো তেমন কাউকে শেয়ার করবো না, কিন্তু আজ আর পারলাম না। তার কারন- হয়তবা আমার জীবনকথা পড়ে কারো না কারো উপকারে আসতে পারে!!! আমার বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং পেশায় ছিলেন পুলিশ। আমার বাবার মুখে অনেক গল্প শুনেছি বিশেষ করে তার জীবন এর যুদ্ধের। ৩ ভাই বোন মৃত্যুর পর আমি জন্মগ্রহন করি ১৯৭৯ সালে ১৮ ই জানুয়ারী। ঠিক এই তারিখে আমার দাদাজান ১৯৭২ সালে ইন্তেকাল করেন। তাই, আমি অনেক আদরের সন্তান আমার বাবা মার কাছে। আমার কোন কিছু আবদার, ইচ্ছা আমার বাবা মা পূরণ করতে অপারোগ হন নাই। আমার পরে আরো ২ টি ভাই আছে অথচ আমার প্রতি তাদের যথেষ্ঠ টেক কেয়ার ছিল। কখনো কোন ভারি কাজ আমাকে করতে দিত না। এমনকি কখনো কোনদিন ১টি রাত ফ্যামিলি ছাড়া আমি থাকতে পারি নাই। হঠাৎ, কি কারনে জানি না আমি কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছিলাম আমার বাবা ও আম্মার মধ্যে সাংসারিক কিছু ঝামেলা তৈরি হয় এবং আমার আব্বা অন্যত্র ট্রান্সফার নিয়ে চলে যান। তার পর থেকে আমার বাবার সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ হয় না। আমি তখন এস.এস.সি ফাইনাল ইয়ারের সাইন্সের এর ছাত্র। ১৯৯৫ ২০ই এপ্রিল, আমার ফাইনাল পরিক্ষা। ১০ই এপ্রিল ১৯৯৫ এই তারিখে আমার বাবার লেখা একটি চিঠি আসে আমার উদ্দেশ্যে। সেখানে আমাকে বলেছিল যে, “তুমি অনেক বড় হয়েছে। তুমি তোমার ছোট ভাই গুলোকে ভালমতো দেখ এবং তোমার আম্মুকে কখনো কোনদিন দু:খ্য দিয় না। আর আমার কাছে থেকে তোমরা কোন কিছু আশা করোনা। তোমার থেকে আমি অনেক ছোট বয়সে যুদ্ধে যায় এবং যুদ্ধের পর পুরো সংসার আমার কাধে এসে পড়ে। তুমি আমার সন্তান, নিশ্চয় তুমি তোমার জীবন যুদ্ধে জয়ী হবে।‍‍” আমি সেই মুহর্তে বুঝতে পারলাম আমার বাবা আর কখনো ফিরবে না। সে চরম জেদি একজন লোক ছিলেন। আর কয়েকদিন পর আমার জীবনের প্রথম সাফল্যে শিখরে উঠার পরিক্ষা আর এই মুহুর্তে আমার বাবার অপারোগতা। আমার সামনে মনে হলো বিশাল একটি পাহাড় আমার কাধে চেপে বসল। আমাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন আমার বাবা। আম্মুর ১টি কিডনি নষ্ট সে তেমন সংসারের কাজ ভাল মতো করতে পারতো না। ছোট ভাই গুলো ক্লাস ফাইব এ পড়তো। তারা নিতান্তই খুব ছোট। এখন আমি কিভাবে আমাদের সংসার পরিচালনা করবো? কিভাবে ছোট ভাইদের লেখাপড়া করাবো? কি দিয়ে আম্মুর ঔষধ কিনবো? এই সকল প্রশ্নগুলো আমাকে ধুনুকের মতো আমার মনকে আঘাত হানতে থাকে। সবসময় কি করে সংসার চালাবো তাই ভাবেত ভাবেত আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। মনে মনে শুধু ভাবতাম আর ভাবতাম, আমি তো তেমন কোন কাজও জানিনা যে কাজ করে আমি আমার সংসার পরিচালনা করবো এমনকি, আমি তো আমার শহরের রাস্তাঘাট ভালোমতো চিনিনা যে কোথাও চাকরি করবো অথবা কাজ করবো। এই সব চিন্তাভাবনা নিয়ে ফাইনাল পরিক্ষা শেষ করলাম। প্রথমে আত্বীয় স্বজনদের কাছে কাজ পাওয়ার সহযোগিতা চাইলাম, অর্থের না। কারন, অর্থ সাহায্য করার মতো আত্বীয় নাই বললেই চলে। তাছাড়া, কারো কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য চাউয়াটা আমার দ্বারা সম্ভব হতো না। এমনকি কেউ সাহায্য করতে চাইলেউ নিতে পারতাম না। কারন, দান করা যতটা সহজ নেয়া ততোটা সহজ না। পরিক্ষা শেষ করার পর ২দিন যতটুকু পরিচিত ছিল তাদের সকলের দুয়ারে একটি চাকরির জন্য ধর্না দেয়। কোথাও কোন সুযোগ মিলে না। অবশেষে এলাকার এক বড় ভাই আমাকে ১টি টিউশন ব্যবস্হা করে দেন। সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রী, ২ বেলা করে সপ্তাহে ৬দিন পড়াতে হবে, মাস শেষে ১২৫ টাকা। ১২৫ টাকায় ৪ জনের সংসার পরিচালনা করা কোন মতেই সম্ভব না। তারপরে কোন কিছু নাভাবে জীবনের প্রথম কাজ মহান আল্লাহুর অশেষ রহমত হিসাবে হাসিমুখে গ্রহণ করলাম। বেশ কিছুদিন ঐ একটি ছাত্রীকে পড়ানো অবস্থায় আসে পাসের আরো ৩/৪ টা বাড়ীর ছেলেমেয়েদের পড়ানোর দায়িত্ব পেলাম। কেউ কেউ বলতো “বাবা আমার ২য় শ্রেনীর একটি ছেলে আছে তাকে তুমি পড়াউ আমি মাসে তোমাকে ৫০ টাকা বেতন দিব”। আমি রাজি হয়ে যেতাম। কারন আমি মনে করতার এই অল্প অল্প বেতন জোগার করে আমার মাসে অন্তত মোটা একটা এমাউন্ট হবে। আর সেই টাকা দিয়ে আমি আমার সংসার চালাতে পারবো। এইকরে আমার প্রথম মাসে উপার্জন হয় ১২৫ টাকা, ২য় মাসে উপার্জন হয় ২৭০০ টাকা এবং ৩য় মাসে আমার উপার্জন হয় ৪৭০০ টাকা। আর আমার ৩য় মাসের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দাড়াই ৫৬জন এ । আমি ছোট বেলা থেকে ছবি আকতে খুব পছন্দ করতাম। এই ছবি আকাটা আমি কারো কাছে থেকে শিখিনি। কেমনজানি মনেমনে কল্পনা করতার আর সেই টা কাগজ পেন্সিলে প্রাকটিস করতাম। ১০০% না হলেউ ৯৯% কাছাকাছি হতো। আর হঠাত একদিন আমার এক ফ্রেন্ড এসে আমাকে বলে “দোস্ত তুই তো ছবি ভাল আকতে পারিস, আমার প্র্যাকটিক্যাল খাতা একটু একে দে। প্রতিটি পেজ আকানোর জন্য তো ৩ টাকা করে দিব”। মোট ১৪টি ছবি আকতে হবে আর আমি পাব ৪২ টাকা !! আমার তো মাত্র ঘন্টা খানেক সময় লাগবে কাজটা করতে। ব্যাস আমি রাজি হয়ে গেলাম। ছাত্রদের পড়ানোর ফাকে ফাকে পুরো বায়োলজী খাতাটা একে কমপ্লিট। মনে মনে ভাবলাম এই রকম কাজ আরো পেলে ভাল হতো। ঠিক যেমন ভাবা তেমনি কাজ। চলে গেলাম লাইব্রেরীর দোকানে। দোকানদারের সাথে চুক্তি করলাম প্রতি পেজ সে ৩টাকা করে নিবে আর আমাকে ২টাকা করে দিবে। সময় লাগবে ২ ঘন্টা ১টি খাতার জন্য। অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমার ড্রয়িং করে সপ্তাহে ২৫০০/২৬০০ টাকা আয় হতো। সকাল ৬.০০ টা থেকে রাত ৮.০০ টা পযর্ন্ত শুধু টিউশনি করতাম আর বাসায় ফিরে ৮.৩০ টা থেকে রাত ২/৩ টা পযর্ন্ত খাতা ড্রয়িং করতাম। বাকি সময়টুকু ঘুমাতে পারতাম। সারাদিন তেমনকিছু খাওয়া হতো না। এমন আমার পকেটমানি প্রতিদিন যে ৫টাকা থাকতো সেটা দিয়ে কোন কিছু খেতে গেলে ছোট ভাইগুলোর কথা চোখের সামনে ভেসে আসতো। কেমনজানি মনেহতো আমার ভাইগুলো না খেয়ে আছে আর আমি তাদের কে ছেড়ে কিছু খাব? না থাক খাবো না। এই টাকার কোন কিছু কিনে বাসায় নিয়ে যায়, সবাইমিলে খাওয়া যাবে। ৫টাকায় শাকসবজী যা পেতাম তা নিয়ে বাসায় যেতাম। সারাদিন আমার তেমন কিছু খাওয়া হতো না। মাঝে মাঝে শুধু বুকের বাম দিকটায় হালকা ব্যাথা অনুভব করতাম। একদিন হঠাত করে বুকের ব্যাথাটা চরম আকার ধারন করে এবং আমি অজ্ঞান হয়ে যায়। ২দিন পর জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালে আর আমার মা আমার কাছে বসে আছে। আমি খুব তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে পড়ি এবং আম্মুকে বলি “আম্মু আমি এতক্ষন ধরে ঘুমিয়ে আছি তুমি আমাকে ডাকোনি কেন? ছাত্রছাত্রীরা নাজানি কতক্ষন পযর্ন্ত বসে আছে, হাতে কত কাজ আছে তুমি জান? ছাত্রদের যদি ঠিকমতো না পড়াই তাহলে তারা অন্য টিচার নিয়ে নিবে, হাতের কাজ টা শেষ করতে না পারলে আর কাজ পাবো না।“ এই সব বলতে বলতে আমি বিছানা থেকে উঠতে যাচ্ছি আর ঠিক এমন সময় আমার হাতে দেখি একটা সুচ এর মতো কি জেন লাগলো। তাকিয়ে দেখি আমার হাতে স্যালাইন চলছে। শরিরে কেমন জানি জোর পাচ্ছি না। আম্মু আমাকে বলছে যা হবে হোক তোকে আর কাজ করতে হবে না। এখন থেকে আমি কাজ করবো। আমি হাসতে হাসতে আম্মুকে বললাম আমি থাকতে তুমি? আরে আমি তো এখনো বেচে আছি। তাছাড়া আমার তেমনকিছু হয়নি। তুমি শুধুশুধু ঘাবরাচ্ছো। কিছুক্ষন পর ডাক্তার প্রধান আসলেন এবং আমাকে জিগ্গেস করলেন তুমি এমন কি করো যে তোমার এমন হলো? প্রতিউত্তরে আমি বললাম “স্যার আমার তো কিছু হয় নাই। তবে স্যার বুকের বাম পাশে আমার কেমন জানি হালকা ব্যাথা হতো। সেইদিন হঠাত ব্যাথাটা বেশি হয়। এইটুকুই স্যার।“ ডাক্তার আমাকে বললো তোমার হার্টএটাক হয়েছিলো। আর একটু দেরি হলে..... ডাক্তার আমাকে আরো বললো দেখ বাবা যতটুকু তোমার আম্মুর কাছে থেকে শুনলাম তাতে মনে হলো তোমার অনিয়মের জন্য এমনটাই হয়েছে। এখন থেকে নিয়ম করে চলো। তুমি না বাচলে তোমার মা ভাইদের কে দেখবে? কথাটা আমার মনে খুব ভালভাবে গেথে গেল। এসএসসি রেজাল্ট হয়েছে কিছুদিন আগে। ১ম বিভাগে ৩টি বিষয়ে লেটারস নিয়ে পাস করলাম। ভাবলাম লেখাপড়া এখানেই ইতি টানবো। কিন্তু তা আর হলো না। আমার আম্মুর খুব ইচ্ছা আমি পড়াশুনা করি তাই তিনি আমাকে তার হাতের সোনার গহণা বিক্রি করে আমাকে কলেজে ভর্তি করালেন। ভর্তি করানো শেষে আমাকে আমার আম্মু একটি কথা বললেন বাবা আমার হাত আমি তোমাকে দিলাম। তুমি ভাল রেজাল্ট করে আমাকে দিও। জানিনা আমার মা কতুটুকু সেই সময় আমার জন্য তার সখ বিসর্জন দিলেন তবে আমি আমার সারা জীবন আম্মুর এই ত্যাগ ভুলতে পারবো না। অামার অসুস্থ হবার পর তেমন আর কাজের পেশার আম্মু আর নিতে দেয়না। সংসারে আবার টানাপোড়েন শুরু হতে থাকলো। আস্তে আস্তে আম্মুর যা ছিল তা বিক্রি করে সংসার চলে। কিছুদিন পর আমার সব ছোট ভাই প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে আর হাতে তেমন টাকাও নেই। কোন রকমে ডাক্তার চিকিৎসা করানো হয়েছে। ভাইটা আমার একদম মৃত্যু সয্যায় বলা যায়। মা শুধু চোখের পানি আচল দিয়ে মুছে তার তেমন কিছুয় করার নাই। রাতের ঔসুধ নাই তাকে খাওয়ানোর মতো। আর আমি???? আমি চুপচাপ বসে আমার ভাই এর মৃত্যু দেখবো? না, আমার অসুখ তো আমার কাছে বড় না। এই মুহুর্তে যে ভাবেই হোক রাতের মধ্যে আমাকে ঔসুধ কিনতে হবে। আমি কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কি করবো কি করবো এই ভাবতে ভাবতে যখন কোন উপায় পেলাম না তখন হঠাৎই আমার একটা কথা মনে আসলো। অনেকদিন আগে গল্প শুনেছিলাম ভার্সিটির অনেক গরিব ছেলে রাতে রিকসা চালায় এবং দিনে লেখাপড়া করে। আমার ঠিক সেই মুহুর্তে মনে হলো ভার্সিটির ছেলেরা যদি রিকসা চালাতে পারে তাহলে আমি সদ্য এসএসসি পাশ একজন মামুলি ছাত্র তাহলে আমি কেন পারবো না? ব্যাস যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পরিচিত এক গ্যারেজ থেকে চুক্তি ভিত্তিক রিকসা নিয়ে সন্ধা ৬.০০ টা থেকে ১০.০০টা পযর্ন্ত রিকসা চালনা করে ১৪৫ টাকা মতো আয় হলো। ভাইএর জন্য কিছু ঔষুধ এবং ফলমুল নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। পুনরায় শুরু করলাম জীবন সংগ্রাম। তবে হ্যা রিকসা আর চালালাম না কারন আমার মা যদি কোনমতে জানতে পারতো তাহলে সেই মুহুর্তে সে হয়তাবা মারা যেত। শুরুকরলাম একটি শপিং মলে দারোয়ানের কাজ। দুস্পর্কের এক মামা চাকরিটি নিয়ে দেয়। মাসে ১২০০ টাকা সেই সময় বেতন পেতাম। মাস দুয়েক কাজ করার পর শপিংমলে কিছু সেলসম্যান নিয়োগ করানো হবে সেই সুত্রে আমি দারোয়ান থেকে সেলসম্যান এ এপ্লাই করলাম। চাকরী আমার হয়ে গেল। মাস ৫/৬ এর মধ্যে আমি খুব ভাল কাজ করায় আমাদের বস আমাকে পুরো শপিং মলের ম্যানেজার হিসাবে প্রমোশন দিলেন। আর এই দিকে আমার মা দিনে দিনে তার কিডনি টি পুরোদমে অচল করে দিয়েছে। সে এক রকম বলাযায় বিছানা থেকে উঠতে পারে না। আমার ছোট ভাই ২জন তারা স্কুল এ পড়ে এসে তাদের খেলার সময় তারা টিউশনি করতো আর রাতে বাসায় রান্নাবান্না করতো। আমি খুব সকালে উঠে সবার জন্য নাস্তা এবং দুপুরের খাবার তৈরি করে কাজে চলে যেতাম। বাসায় আসতাম রাত ১০/১১ টায়। আম্মুকে দেখাশোনার তেমন কেউ ছিল না শুধুমাত্র আমরা তিন ভাই ছাড়া। কিছুদিন পর একটি লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে চাকুরীর আবেদন করি। এটাই বোধয় আমার জীবনের প্রথম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তার কারন, লাইফ ইন্সুরেন্সের কর্মকর্তা মাসিক ভাল একটা বেতন এর মিথ্যা আস্বাস দিয়ে বেশ কিছু টাকা আত্মসাত করে। আগের চাকরিটাও হারালাম। কিছুই আর করার নেই। এখন নতুন করে আবার কর্মসংস্থান খোজ করা ছাড়া। বেশকিছুদিন পর মার্কেটিং কোম্পানীর পন্য বিক্রয়কর্মী হিসাবে চাকুরী করলাম। রোদ, বৃষ্টি, ঝোড় কোন কিছুই এই পেশায় বাধার সম্মুক্ষিন হতে পারে না। আর, কখনই আমার কঠোর কাজ কে কঠোর মনে হতো না। দৃঢ়তার সাথে বেশ কিছুদিন চাকরী করলাম। সালটা হবে সম্ভবত ২০০৩/২০০৪ এর দিকে। আমি তখনো কম্পিউটার এর মাউস ধরার স্বাদও গ্রহন করিনি। আমার খুব ইচ্ছা ছিল এস এস সি পরিক্ষার পর যে ৩ মাস ছুটি থাকে সেই সময় কম্পিউটার এর কাজ শেখার। কিন্তু তা আর ভাগ্যে হয়ে উঠেনি। ছোটভাই এর ছোট একটি কাজ নিয়ে এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম কারন তার বাসায় কম্পিউটার ছিল। শখের বসে আমি তার কম্পিউটার এর সামনে বসি এবং টুকিটাকি কিছু নাড়াচাড়া করি। এমন সময় বন্ধু আমার ছোট ভাইএর সামনে আমাকে চরম অপমানিত করে যা আমার পক্ষে হয়তবা ভোলার কথা নয়। আমি তার কম্পিউটারে কিছুই করেছিলাম না। শুধুমাত্র মাউসটা হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলাম। আর, তাছাড়া কারো জিনিসে হাত দেবার আগে অনুমতি চাওয়াটা আমার অবশ্যই উচিৎ ছিল। আমার কেমনজানি আরো একটা জেদ আমার ভিতরে বাসা বাধলো এই কম্পিউটার নিয়ে। আমি যতটা না কষ্ট পেয়েছি তার থেকে বেশি কষ্ট আমার ছোট ভাই বোধহয় পেয়েছিল, তার কারন সে পরের দিন তার টিউশনির টাকা দিয়ে একটি পুরাতন কম্পিউটার আমার জন্য কিনে নিয়ে এসে বলেছিল “ভাইয়া তুমি এই জিনিসটার জন্য অনেক অপমানিত হয়েছো তোমার বন্ধুর কাছে, এখন তুমি এই জিনিসটা দ্বারা কিছু করে দেখাও”। আমি তখন সদ্য কম্পিউটার হাতে পেয়েছে, সেই সময় কম্পিউটারে ইন্টারনেট সংযোগ আমাদের এলাকায় অনেকটাই দূর্লভ এবং কষ্টসাধ্য। আমি তখন কম্পিউটার শেখা কোথায় থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। কারন, আমি কিছুই জানি না। হঠাৎ আমার কেমনজানী মনে হলো সবাই কম্পিউটার এ মাউস এবং কিবোর্ড এ কাজ করে সুতরাং আমাকে সবার আগে এই দুটো জিনিস শিখতে হবে। ব্যাস যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। কিবোর্ড শেখার কিছু নিয়ম আছে যেটা আমি জানি না। শংকর বাবু যিনি আমার টাইপ শেখানোর গুরু তিনি আমাকে খুব সুন্দরভাবে টাইপ শেখার ফর্মূলা বলে দেন এবং আমি মোটামুটি ২০/২২ দিনের মধ্যে টাইপিং শিখা সম্পূর্ণ করে ফেলি। তারপর প্রতি মাসের বেতন পেয়ে আমি ১টি করে কম্পিউটার এর উপর বই কিনতাম এবং প্রতিদিন বাসায় একা একা প্রাকটিস করতাম। প্রথমে এম এস ওয়ার্ড, তারপর এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট, ফটোশপ ইত্যাদী ইত্যাদী কোর্সগুলো একা একা সম্পূর্ন করে ফেলি। কিছুদিন পর পত্রিকায় একটি সার্কুলার দেখলাম কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ হবে। TTBC Ltd, Organization Business:Telecommunications, Organization Address: House No # 02, Road No # 1/A, Gulshan # 01, Dhaka-1212. Designation: Junior Executive. আমি দরখাস্ত করলাম এবং আমার প্রথম চাকরী হয়ে গেল। বেশকিছুদিন চাকরি করার পর কোম্পানী যে প্রোজেক্টের জন্য আমাকে নিয়েছিল সেই প্রজেক্টটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। টানা ৮টি মাস আমি বেকার অবস্থায় থাকি শুধুমাত্র ১টি চাকরীর অপেক্ষায়। আমার তখন নিজের সংসার হয়েছে। একটি ২ মাসের বাচ্চাও আছে। সাংসারিক যন্ত্রনা ও মানসিক চাপে আমি এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলাম যে, অবশেষে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার আর কোন পথ বাকী ছিলনা। অবশেষে সেটাও একদিন করতে গেলাম আর ঠিক তখন আমার চোখের সামনে আমার বাচ্চার ছবিটা ভেসে আসলো। পারলাম না নিজেকে শেষ করতে। মনে মনে ভাবলাম আমি মানুষ। মহান আল্লাহ আমাকে জীবন সংসারে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়েছেন। সুতরাং, এই জীবন যুদ্ধে আমি হেরে গেলে ইহকাল ও পরোকাল কোথাও আমার ঠাই হবেনা। আমি আরো ১টা দিন চেষ্টা করব জীবন যুদ্ধে জয়ী হবার। এই ১দিন ১দিন করে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে অবশেষে কিছুদিন পর আরো একটি মোবাইল কোম্পানীর ডিষ্ট্রিবিউশন এ Head of IT হিসাবে জয়েন্ট করি। ৪ বছর চাকুরী করি। মূলত এখান থেকে আমার অনলাইন জীবন শুরু। আমার অফিসে উপস্তিতি সময় ছিল কিন্তু আউটগোয়িং সময়টা ফিক্স ছিল না। সকাল ৮.০০ টা থেকে কখনো কখনো রাত ৯.০০ টা অথবা ১০/১১ টা। তবে দুপুরের সময় ২/৩ ঘন্টা হাতে সময় থাকতো খাবার জন্য। আমি এই সময়টাকে একটু কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টা করি। শুরু হয় আমার ইন্টারনেট এ পদাপর্ন। ইন্টারনেটে আয় নিয়ে তখন তেমন এতটা সাড়া ছিলনা আমাদের দেশে। গুগোলে সার্চ দিয়ে সাইট পেতাম পিটিসি। কিছু পিটিসি সাইটে জয়েন্ট করার পূর্বে তার terms & condition এবং contact details, reviews ইত্যাদী পড়ে দেখতাম। তবে কেমন জানি আগ্রহী হতে পারছিলামনা পিটিসি তে। তাই কাজটা করা হয় নাই আদো। ২০০৯ এর দিকে ফ্রিল্যান্সার ডট কম সাইটে এ জয়েন্ট করলাম। এটাই আমার প্রথম জয়েন্ট কোন মার্কেটপ্লেস এ । তারপর ওডেক্স, তারপর গেট এ কোডার, ইউফ্রিল্যান্সার ইত্যাদী ইত্যাদী সাইটে জয়েন্ট করলাম। দির্ঘ্য ২/৩ মাস শুধু বিডই করলাম। কোন সাড়া পেলাম না। হঠাৎ ৩ মাস পর ওডেক্স থেকে একটি কাজ পেয়ে গেলাম ১০ ডলারের। কাজটা সম্পূর্ন করলাম। সাথে ক্লায়েন্ট কর্তৃক একটি রেটিং ও পেলাম। তারপর আবার শুরু করলাম বিড করা সব সাইটে। আমার টার্গেট টা ছিল freelancer.com সাইটের দিকে। তার কারন এই সাইটে অনেক কাজ থাকতো। কিন্তু freelancer.com এ কাজ তখনো পাই নাই। মাসে তখন ২৫টা বিড করা যেত। প্রতিদিন কমবেশি ১/২ টা করে বিড করতাম। অবশেষে নিরাশ হয়ে freelancer.com থেকে অব্যহতি নিলাম আর ভাবলাম এটা একটা ফেক সাইট। তার কারন সব সাইটে ২/১ টা করে কাজ করলাম কিন্তু এই সাইটে আমি এখনো ১টি কাজ ও পেলাম না? আসলে আমার ধারনাটা ছিল ভুল সেটা আমি কিছুদিন পর বুঝতে পারি। যখন আমি কিছুদিন পর আবার সেই সাইটে প্রবেশ করলাম তখন দেখলাম গত মাসে যে সকল ইউজার প্রোফাইল এর রেটিং ছিল কম এখন তার অনেক বেশি। সুতরাং আমি কাজ পাচ্ছিনা তার মানে নিশ্চয় আমার কোথায় ভুল হচ্ছে! ব্যাস আমি আমার ভুলগুলো খুজতে থাকলাম_ কেন আমি কাজ পাচ্ছি না। আমি আমার প্রোফাইলটা খুব ভালমতো তৈরি করলাম এবং ছোট ছোট প্রজেক্ট যে গুলো আছে সেই গুলোতে খবু ছোট আকারে সুন্দর আর্টিকেল দিয়ে বিড করা শুরু করলাম। সপ্তাহ খানেক পরে আমি ক্লায়েন্ট থেকে রিপ্লাই পেলাম এবং ১ম freelancer.com এ কাজ পেলাম। তারপর আরো একটা এবং আরো একটা কাজ। পরপর ৩টা কাজ ১দিনে পেয়ে গেলাম। দু:খজনক বিষয়টা হচ্ছে আমি এই কাজ পাবার পর পর আমার অফিসের কাজের চাপ ও বাড়তে থাকলো। এতদিন ২/৩ ঘন্টা সময় পেতাম এখন সেটাও আর পাওয়া যায় না। রাত ১০/১১ টার সময় বাসায় ফিরে কোন রকম ফ্রেশ হয়ে রাত ২/৩ টা পযর্ন্ত কাজ করতাম। কিন্তু কোন মতেই নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন কাজই আমি ঠিক মতো শেষ করতে পারলাম না। আমার এত দিনের পরিশ্রমের ফসল হিসাবে পেলাম ৩ টা ব্যাড রিভিউ। কাজটা হয়তবা শেষ করা যেত কিন্তু অফিসের কাজে আমি কোনদিন কখনো অবহেলা করি নাই। তাই সবার আগে আমি অফিসের কাজে বেশি গুরুত্ব দিতাম। এই জন্য আমার উর্দ্ধতন অফিসারগন আমাকে খুব স্নেহ করত। freelancer.com থেকে ব্যাড ফিডব্যাক পাবার পর আমি আরো সিরিয়াস হলাম আমার বিড এ। ২/৩ মাস পর আরো একটি কাজ এর রিপ্লাই পেলাম সেটা ছিল ডাটা এন্ট্রির। কোন কিছু না ভাবে শুধুমাত্র প্রোফাইল টা ভাল করার জন্য সেই প্রজেক্ট টা গ্রহণ করলাম। খুব সিরিয়াসভাবে কাজটা শেষ করলাম এবং ক্লায়েন্ট আমাকে যে সময় বেধে দিয়েছিল তার আগেই কাজ টা শেষ করলাম। এতে ক্লায়েন্ট খুশি হয়ে ১ম পজেটিব রেটিং দিল আমার প্রোফাইল এ। এরপর সেই ক্লায়েন্ট ১ এর পর ১ এক প্রোজেক্ট আমাকে দিতে থাকলো এবং আমি তা খুব দ্বায়ীত্ব সহকারে শেষ করেছিলাম। তারপর ১ এর পর ১ ক্লায়েন্ট আমার বাড়তে থাকলো আর আমি চাকরীর পাশাপাশি কাজ গুলো করতে থাকতাম। এইদিকে আমার চাকরি জীবনেউ আমার রেটিং বাড়তে থাকলো। অর্থাৎ ২০১০ এর দিকে ৩ টি ড্রিষ্ট্রিবিউশন হাউজ এর মধ্য থেকে বেষ্ট আই টি কন্ট্রিবিউটার আওয়ার্ড পেলাম। শুরু হলো আমার নতুন জীবন চলা। অবশেষে ছোট একটি টিম তৈরী করি। ২০০৯ ও ২০১০ এর দিকে freelancer.com এ একটি করে প্রতিযোগিতা হয়েছিল লোগো এক্সপোজ এর। ফিলিপাইন ১ম স্থান অধিকার করেছিল পরপর ২ বার। আমি প্রায়ই তাদের ভিডিউ ফাইলটা দেখতাম আর মনে মনে ভাবতাম বাংলাদেশ থেকে কেউ সেই প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহন করে নাই কেন? তার কিছুদিন পর ব্যাসিস আওয়ার্ড প্রদান করলো ১০ জন ফ্রীল্যান্সার কে। আমিও এপ্লাই করেছিলাম। ১টা ফোন ও আসছিল ব্যাসিস থেকে কিন্তু আমি চান্স পাই নাই। মনে কেমনজানি একটা উত্তেজনা বিরাজ করলো। ব্যাসিস স্বীকৃতি পাবার জন্য নয়। কিছু একটা করার দিঢ় জেদ আবার আমাকে চেপে বসলো । ২০১১ তে freelancer.com এ আবার সেই প্রতিযোগীতা শুরু হলো এবং বুঝতে পারলাম এবারো বাংলাদেশ থেকে কেউ এই চ্যালেন্জ এ অংশগ্রহণ করছে না। আমি ঝেপে পড়লাম প্রতিযোগীতায়। চেষ্টা করে দেখতে অসুবিধা তো নাই। দেখি না একটু চেষ্টা করে!! ব্যাস আমার চেষ্টা সার্থক হলো। ২০১১ Freelancer.com লোগো এক্সপোজ প্রতিযোগীতায় বাংলাদেশ প্রথম স্থান দখল করলো। ২০১০ এ আমি শুধু ডাটা এন্ট্রি করতাম আর পাশাপাশি কিছু অনলাইন কাজ শিখতে থাকলাম। ২০১১ এর দিকে সোস্যাল নেটওয়ার্ক এর কাজ গুলো করতে থাকলাম। ২০১২ তে ব্যাসিস স্বীকৃতি পেলাম। এখন ২০১৩ বর্তমানে এখন আমার প্লাটফর্ম এ ডাটা এন্ট্রি, সোস্যাল নেটওয়ার্ক এবং ওয়েব ডেভোলপমেন্ট এর কাজ চলে। এখন আমাকে আর কাজের জন্য বিড করার প্রয়োজন পড়ে না। তার কারন পুরাতন ক্লায়েন্টেগন প্রতিনিয়ত কাজ প্রদান করে যাচ্ছে। আমি সবসময়ে কখনো কোন কাজ কে ছোট মনে করি নাই। আমি তাদের কে সবচেয়ে বেশি সম্মান করি যারা শিক্ষিত হয়ে কোন কাজকে ছোট মনে করে না এবং কাজকে অবহেলা করে না। সেটা ফ্রিল্যান্সিং হোক আর সাধারন চাকুরী যেটাই হোকনা কেন। আমার মতে যারা ফ্রিল্যান্সার করে তারাও এক ধরনের চাকুরীর মধ্যে পড়ে সেটা হচ্ছে ক্লায়েন্টের । মানুষ চেষ্টা করলে পারে না এমন কিছুই নেই। প্রয়োজন শুধু সঠিক দিক নির্দেশনা এবং প্রত্যয়। আর ফ্রিল্যান্সিং করা সহজ কাজ না। এটার জন্য কঠোর পরিশ্রমী এবং ধৈয্যশীল হওয়া বান্চনীয়। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে কথাটি মিথ্যা নয়। যেখানেই কষ্ট সেখানেই ততোটা সুখ। আর সাফল্য সেটা তো আসবেই।