রাতের হাতিরঝিল। ছবি- আবু সুফিয়ান জুয়েল

ঢাকার গর্ব হাতিরঝিলঃ সেই শুরু থেকে এখন অব্দি

আফসানা সুমী
সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ২৬ অক্টোবর ২০১৭, ০৯:২০
আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৭, ০৯:২০

(প্রিয়.কম) হাতিরঝিল আমাদের ঢাকার প্রাণ। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আজ আর আলাদা করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই হয়ত। ঢাকার ল্যান্ডমার্কে পরিণত হয়েছে হাতিরঝিল প্রকল্প। সরকার শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়েছেন হাতিরঝিলের কারণে। সত্যি বলতে, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ বলতেই যে হতদরিদ্র, ভগ্ন চিত্র তুলে ধরা হয় তা বদলে দিয়েছে এই হাতিরঝিল। ঢাকা বলতে এখন আর যানজট, ঘনবসতি, নোংরা পথ-ঘাট নয়। ঢাকা বলতেই এখন চোখে ভাসে পরিচ্ছন্ন সড়ক, বিশাল ঝিল থেকে বয়ে আসা শীতল বাতাস, যানজটহীন দ্রুত যাতায়াত। এইসবকিছু ঢাকার আর কোথাও নেই, আছে হাতিরঝিলে। 

নির্মলেন্দু গুণ যখন প্রথমবার হাতিরঝিলকে দেখেন তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘তিন-চার শ' বছর ধরে হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ির বর্জ্যস্তুপের আড়ালে ঢাকা পড়েছিল যে-ঢাকা, সেই ঢাকা আজ কী অপরূপ রূপের আলোতেই না উদ্ভাসিত হলো, উন্মোচিত হলো, আবিষ্কৃত হলো। আমি মুগ্ধ। আমি গর্বিত। আমি আনন্দিত। অবশেষে সিঙ্গাপুর, সিডনি, লন্ডন বা প্যারিসের পাশে দাঁড়ানোর মতো একটা ল্যান্ডমার্ক তৈরি হলো আমাদের প্রিয় নগরী ঢাকার ভিতরে।’ 

হাতিরঝিলআমাদের হাতিরঝিল। ছবি- আবু সুফিয়ান জুয়েল

যা নিয়ে এত বন্দনা সেই হাতিরঝিল কিন্তু চিরদিনই এমন ছিল না। বরং ঝিলের পানি ছিল নোংরা, সবুজ বর্ণের। ধীরে ধীরে ঝিলটি পরিণত হচ্ছিল ডোবায়। এর কারণে আশেপাশের পরিবেশও বিপর্যস্ত হচ্ছিল। সে সময় হাতিরঝিলকে অবৈধ দখল আর জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষায় অনেক আন্দোলনও হয়েছিল। স্যার আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ সেসব আন্দোলনে পাশে ছিলেন। অন্ধ ডোবা হাতিরঝিলকে ঘিরে বাড়ছিল অপরাধপ্রবণতাও। মাদকসেবীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছিল এই জায়গাটি। তবে যে কোনো সময়ই হতে পারে পরিবর্তনের সূচনা- হাতিরঝিল তারই প্রমাণ। আজকের আলো ঝলমলে হাতিরঝিল পেছনের কালো ইতিহাস মুছে সোনালী বর্তমান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে।

হাতিরঝিলের অবস্থান ঢাকার কেন্দ্রে। শুরু হয়েছে কারওয়ান বাজার সোনারগাঁ হোটেল থেকে, বিস্তৃতি লাভ করেছে বনশ্রী অব্দি। হাতিরঝিলকে ঘিরে আছে তেজগাঁও, গুলশান, রামপুরা, বাড্ডা, বনশ্রী, নিকেতন এবং মগবাজার। অর্থাৎ এই প্রতিটি অঞ্চল দিয়ে হাতিরঝিলে প্রবেশ করতে পারবেন আপনি। তবে আমার চোখে এফডিসির মোড় থেকে মগবাজারের দিকের পথটি বেশি সুন্দর। লেকের তীর ধরে হাঁটা, দাঁড়িয়ে থাকা, বা আড্ডা দেওয়ার জন্য আলাদা রেলিং দিয়ে ব্যালকনির মতো করা আছে এখানে। তবে যতই আপনি গুলশানের দিকে এগিয়ে আসবেন ততই বসার ব্যবস্থা ভালো পাবেন। এদিকটায় লোকজন আরও কম। 

হাতিরঝিলের যে স্থাপনাশৈলী আমাদের মুগ্ধ করছে, অবাক করছে সারা বিশ্বকে তার পেছনে রয়েছেন স্থপতি ইকবাল হাবিব, ইশতিয়াক জহির আর এহসান খান। তারা স্থপতি লিমিটেডের হয়ে স্থাপত্য নকশা করেছেন। হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৯ সালে) ফখরুদ্দিন আহমেদ শুরু করেন। কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যান আওয়ামীলীগ সরকার। হাতিরঝিলের প্রকৌশল-নকশা ও পরামর্শ দান করেছেন ডিপিএম ও এআইএ নামের দুটো সংস্থা। 

হাতিরঝিল
এভাবেই দাবার ঘর আঁকা আছে, আছে বসার জায়গা। 

অবসরের সময়টি সুন্দর কাটাতে হলে হাতিরঝিলের কিন্তু সত্যিই কোনো বিকল্প নেই। কারওয়ান বাজার এফডিসির মোড় থেকে আপনি যদি হাতিরঝিলে প্রবেশ করেন, হাতের ডানে দেখবেন সারি বেঁধে বসার জায়গা। দুইটি আসন আর মাঝে টেবিলের মতো তৈরি করা হয়েছে। টেবিলে আঁকা হয়েছে দাবার ছক। ব্যাস গুটি নিয়ে পৌঁছে যান সেখানে। বাদাম বা ঝালমুড়ি খেতে খেতে আড্ডা কিন্তু জমবে বেশ, সাথে চলবে বুদ্ধির খেলা। খেলতে না চাইলেও সমস্যা নেই। গাছের ছায়ায় চুপচাপ বসে কাটিয়ে দেওয়া যাবে একটি বিকেল। পাখির ডাক আর হিমেল শান্ত বাতাস তো থাকছেই আপনার সঙ্গী। 

হাতিরঝিলনানান জাতের ফুল গাছের সমাহার আছে হাতিরঝিলে। 

শুরুতে হাতিরঝিলে কোনো পাবলিক পরিবহন ছিল না। কিন্তু এখন চক্রাকার বাস সার্ভিস চালু হওয়ায় হাতিরঝিলের আশেপাশের এলাকার মানুষদের তো বটেই অন্যদেরও সুবিধা হয়েছে। চক্রাকার এই বাসগুলোতে পুরো হাতিরঝিল ঘুরে দেখতে পারবেন আপনি। ভাড়া সর্বনিম্ন ১০ টাকা আর পুরো হাতিরঝিল ঘুরে আসতে লাগবে ৩০ টাকা। আপনি যতটুকু যাবেন সেই অনুযায়ী কাউন্টার থেকে টিকেট কিনে নেবেন। এফডিসি মোড় থেকে শ্যুটিং ক্লাব ভাড়া নেবে ১০ টাকা, আবার বাড্ডা গেলে ১৫ টাকা, মহানগর ২০ টাকা। মোট বাস আছে ১৪ টি। রামপুরাবাসীর সুবিধার্থে তাদের জন্য আলাদা বাস আছে। আবার এর মধ্যে ২ টি বাস আছে এসি সহ। তবে সংখ্যায় কম বলে সচরাচর দেখা মেলে না এসি বাসের। আপনি ভাবছেন এই বাসের ভাড়া নিশ্চয়ই বেশি! না। ভাড়া একই। বাস সার্ভিসটি পরিচালনা করছে এইচ আর ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি আর ব্যবস্থাপনায় আছে রাজউক। 

হাতিরঝিলহাতিরঝিল চক্রাকার বাস। 

চক্রাকার বাসের ভালো বিষয় হলো এই বাস যেকোনো জায়গায় থামবে না। টিকিট ছাড়া যাত্রী নিবে না। আর হাতিরঝিলে কোনো জানজট না থাকায় খুব দ্রুতই পৌঁছে যাবেন প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে। হাতিরঝিলে প্রতিদিন বাস চলাচল শুরু করে সকাল ৭টা থেকে এবং রাত ১১ টা পর্যন্ত চলে। সরকারি ছুটির দিন বা কোনো উৎসবের দিনও চক্রাকার বাস চলাচল বন্ধ থাকেনা।  

হাতিরঝিলের অভ্যন্তরে যাতায়াতের আরেকটি বাহন ওয়াটার ট্যাক্সি। এফডিসির মোড়ে যেই জায়গা থেকে বাস ছাড়ে ঠিক তার বিপরীতে ওয়াটার ট্যাক্সি স্টপেজ রয়েছে। এখান থেকে দুইটি গন্তব্যে ওয়াটার ট্যাক্সি ছেড়ে যায়। একটি গুদারাঘাটের উদ্দেশ্যে আর অন্যটি রামপুরার উদ্দেশ্যে ছাড়ে। ভাড়া গুদারাঘাটের জন্য ৩০ টাকা আর রামপুরার জন্য ২৫ টাকা। ১০ বছরের নিচে বয়সীদের জন্য কোনো ভাড়া লাগে না। অগ্রীম টিকিট নেওয়ার ব্যবস্থা নেই, তবে আপনি রাউন্ড ট্রিপ দিতে চাইলে একঘাটে দুই টিকিট কাটতে পারবেন। ওয়াটার ট্যাক্সি যাতায়াতের তুলনায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য বেশি সুবিধাজনক, যেহেতু এটি জায়গায় জায়গায় নামিয়ে দেয় না, একটি গন্তব্যেই যেতে হয়। তবে ওয়াটার ট্যাক্সির  ব্যাবস্থাপনা অবাক করার মতো। লাইফ জ্যাকেট আছে প্রত্যেক যাত্রীর জন্য। সব ওয়াটার ট্যাক্সিতেই ওড়ে বাংলাদেশের পতাকা। ঝিলের দৃশ্য দেখতে দেখতে অতুলনীয় একটি সফর দেওয়া যায়।

হাতিরঝিলওয়াটারট্যাক্সিতে উড়ছে দেশের পতাকা। 

হাতিরঝিল ওয়াটারট্যাক্সিগুলো তৈরি হয়েছে চট্টগ্রামে। ইঞ্জিনগুলো আমদানি করা হয়েছে চীন থেকে। সার্ভিসটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে মেসার্স ওয়াহিদ মিয়া নামের একটি প্রতিষ্ঠান।  

হাতিরঝিলের ভেতর দিয়ে যাতায়াতের জন্য লোকাল আর কোনো ব্যবস্থা নেই। কারওয়ান বাজার থেকে কিছু মাইক্রোবাস যায় রামপুরা পর্যন্ত। যেখানেই নামুন ভাড়া ২৫ টাকা। তবে এগুলো কতটা বৈধ বাহন সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। তবে আপনি আপনার ব্যক্তিগত বাহনে আসতেই পারেন। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, সাইকেল চলাচলে কোনো বাঁধা নেই এখানে। তবে রিকশা আর লেগুনা চলাচল নিষিদ্ধ। 

হাতিরঝিলপার্কিং জোন।

আপনি হয়ত ভাবছেন, নিজস্ব গাড়ি নিয়ে আসলাম কিন্তু একটু নামতে চাইলে, ঝিলের পাড়ে ছবি তুলতে চাইলে বা বেড়াতে চাইলে গাড়ি কোথায় রাখব? গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা আছে এখানে। নির্দিষ্ট পার্কিং জোনে আপনার বাহনটি রেখে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারবেন আপনি। প্রতি ২ ঘন্টায় মোটর সাইকেলের জন্য পার্কিং চার্জ ২০ টাকা, সিএনজি বা বেবি ট্যাক্সির জন্য ২০ টাকা, প্রাইভেট কারের জন্য ৩০ টাকা, জিপ ও মাইক্রোবাসের জন্য ৩০ টাকা, মিনি কোস্টারের জন্য ৫০ টাকা এবং  বাস ও ট্রাকের জন্য ১০০ টাকা। এছাড়া হাতিরঝিলের সড়কের পাশে সামরিক পার্কিং জোন আছে। সেখানে কোনো চার্জ দিতে হয় না।

হাতিরঝিলের অপূর্ব লাইট শো যদি না দেখে থাকেন তাহলে কিন্তু মিস করেছেন। শুরুতেই একবার বলেছিলাম হাতিরঝিল বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের পাংশু মুখটা বদলে দিয়েছে। সেখানে এখন ঝলমল করে নানান রঙের আলো। গানের তালে তালে নাচে ফোয়ারা। কোনো এক রাতে হাতিরঝিলে প্রবেশ করে হয়ত চমকে যাবেন আপনি। ভাববেন, এ কোথায় এলাম! জোরে বাজছে গান, ঝিলের শোভা বাড়াচ্ছে নানান রঙের আলো আর সেই আলোর উৎসে চলছে জলের নৃত্য। যেন গানের সুরেই নাচছে ওরা। শুরুর দিকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১৫ মিনিট অন্তর অন্তর চলত এই সঙ্গীত আর জল তরঙ্গের খেলা। এখন আর রোজ চলে না, কারণ উৎসাহী জনতার ভিড় হাতিরঝিলে যানজট তৈরি করছিল। সবদিন না হলেও হঠাৎ এই জল তরঙ্গের খেলার দেখা পেয়ে যাবেন আপনি। আর সে সময় যদি থাকেন ওয়াটার ট্যাক্সিতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই অনুভূতিটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ঘুরে বেড়ানো, ছবি তোলা, যানজটমুক্ত পথে চলা সবই তো হলো কিন্তু কিছু খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও তো চাই। স্ট্রিটফুড বা রেস্টুরেন্ট হাতিরঝিল মানেই যেন মজার মজার সব খাবারের আয়োজন। অভিজাত রেস্টুরেন্ট হিসেবে ক্রুয়া থাই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখানে খাবারের মূল্য জনপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। অবস্থান নিকেতন আড়ং এর পরেই। খোলা থাকে সকাল ১১টা থেকে রাত ১১টা অব্দি। এরপর আছে ইয়ড রেস্টুরেন্ট। এর অবস্থান হাতিরঝিল ওয়াটার ট্যাক্সি টার্মিনাল ২ এ। এখানে খাবার পাবেন জনপ্রতি ১০০ থেকে ৪০০ টাকার মাঝে। এখানে এসি রেস্তোরাঁয় যেমন খেতে পারবেন তেমনি চাইলে খেতে পারবেন ঝিলের পাশে খোলা পরিবেশেও।  

হাতিরঝিলহাতিরঝিলের রেস্তোরাঁ। 

আরও রেস্তোরাঁ আছে হাতিরঝিলে। বাহারি এসি রেস্তোরাঁর বাইরে ক্যাজুয়াল আড্ডা জমে এসব রেস্তোরাঁয়। এফডিসি মোড়ে আছে ওয়াও', রামপুরা ব্রিজের পাশে আছে হ্যাংআউট, শ্যুটিং ক্লাব বাস টার্মিনালের পাশে আছে ইট ইটালিয়া, মধুবাগে পাবেন টুইস্ট অব টেস্ট ও আড্ডা। আরও আছে নৈবেদ্য, আলোটোপিয়া, দিস ইজ ঢাকা, গ্রীন সেভার, নগরসহ নানান নামের খাবারের দোকান। একটু সস্তায় খেতে চাইলে দামি রেস্তোরাঁর বদলে ফুড কার্ট বেছে নিতে পারেন অনায়াসে। থাই, ম্যাক্সিকান, ইন্ডিয়ান যে কোনো ধরণের মুখরোচক খাবার পাবেন এখানে।

হাতিরঝিলহাতিরঝিলের মুক্তমঞ্চ চালু হওয়ার অপেক্ষায়।

হাতিরঝিলে খুব শীঘ্রই চালু হতে যাচ্ছে একটি মুক্তমঞ্চ। এর অবস্থান ক্রুয়া থাই রেস্টুরেন্টের ঠিক বিপরীতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করেন। মঞ্চটি চালু হলে হাতিরঝিল যেন পরিণত হবে একটি যথাযথ বিনোদন কেন্দ্রে।

হাতিরঝিলে সুপরিচ্ছন্ন ওয়াশরুম এবং টয়লেট ব্যবস্থা আছে। নারী আর পুরুষের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। ১০ টাকা করে টিকিট কাটতে হয় জায়গাটি ব্যবহারের জন্য। তবে ভেতরে এতই পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা হয় যে সেই স্বার্থে আপনাকে জুতা খুলে প্রবেশ করতে হবে! ভেতরে হ্যান্ড ওয়াশ আছে তবে টয়লেট টিস্যু থাকলে সেবা পরিপূর্ণ হত।

হাতিরঝিলপরিচ্ছন্ন ওয়াশরুম।

এমনিতেও সমগ্র হাতিরঝিল এলাকা বেশ পরিচ্ছন্ন। আমাদের ঢাকায় এমন পরিচ্ছন্ন সড়ক দেখা যায় না। প্রতি সপ্তাহে ঘাস কাটা হয়, গাছের আকার ঠিক করা হয়। নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা থাকলেও অনেক জায়গাতেই দেখা যায় কাগজ, চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের প্যাকেট পড়ে আছে। বিশেষ করে যেসব জায়গায় বসে মানুষ আড্ডা দেয় সেসব জায়গাগুলো বেশি নোংরা হয়ে যায়। সকালে একবার পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ঘাসে ঢাকা অঞ্চলগুলোর তুলনায় সড়ক পরিচ্ছন্নতায়ই বেশি মনোযোগী। কিন্তু এই জায়গাগুলোও পরিষ্কার রাখা জরুরি। তবে শুধু পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের উপর দায় চাপানো ঠিক হবে না। কারণ সমগ্র হাতিরঝিলে অসংখ্য ছোট ছোট ডাস্টবিন রাখা আছে। বাস আর ওয়াটার ট্যাক্সির কাউন্টারে ঝুড়ি আছে ছেঁড়া টিকিট ফেলার। তবু আমরাই আবর্জনা ঠিক জায়গায় ফেলছি না। যেখানে বসছি বা দাঁড়াচ্ছি তার আশেপাশের পুরো জায়গাটা নোংরা করে ফেলছি!

হাতিরঝিলসড়কের পাশে আছে এমন বসার ব্যবস্থা। তবে প্রচুর কাগজ আর টিস্যু ছড়িয়ে আছে জায়গাটিতে।

এবার আসি হাতিরঝিলের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে। দিনের বেলা হাতিরঝিল নিরাপদ, এই নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু রাত বাড়তে থাকলে হাতিরঝিলের সব জায়গা সমান নিরাপদ থাকে না। সড়কের দুইপাশে, ব্রিজের উপরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলেও নির্জন জায়গাগুলো ছিনতাইকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। পথ চলতি মানুষ তো বটেই, বিশেষ করে যুগল ভ্রমণকারীরা এদের কবলে পড়ে। ছিনতাইকারীরা প্রথমে নানান উপায়ে ঝগড়া বাঁধায়, এরপর ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করে। সারাক্ষণ পুলিশের প্রহরা থাকায় এখন আর কোথাও মাদকসেবীদের আস্তানা নেই। তবে ছিনতাই চলছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। এসব ছিনতাইকারীরা পথচারীর বেশে ঘুরে বেড়ায় আর সুযোগের সন্ধানে থাকে। তাই নির্জন জায়গাগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো। তাহলে এদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

আবার গভীর রাতেও অনিরাপদ হয়ে পড়ে হাতিরঝিল। অনেকেই ফাঁকা সড়কে ড্রাইভিং রেস করতে চলে আসেন। এসময় দুর্ঘটনার মারাত্মক ঝুঁকি থাকে। 

কিছু নেতিবাচক পরিস্থিতি থাকলেও, হাতিরঝিল আমাদের অমূল্য সম্পদ। এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও ভালো করতে যেমন প্রশাসনকে নজর দিতে হবে তেমনি আমাদেরও আরও সাবধান হতে হবে। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে যেমন এখানে নিয়োজিত কর্মীরা কাজ করবেন তেমনি আমাদেরকেও আবর্জনা জায়গামতো ফেলার অভ্যাস করতে হবে। সম্পদ আমাদের, একে রক্ষার দায়িত্বও আমাদের সবার। 

হাতিরঝিলপথচারী পারাপারের জন্য নির্মিত ফুটওভার ব্রিজ।

কিছু সাধারণ তথ্যঃ

* হাতিরঝিল প্রকল্পে ৩০২ একর জমি ব্যবহার করা হয়েছে। 

* এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১,৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এরমধ্যে রাজউক দিয়েছে ১ হাজার ১১৩ কোটি ৭ লাখ টাকা, এলজিইডি দিয়েছে ২৭৬ কোটি টাকা এবং ঢাকা ওয়াসা দিয়েছে ৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

* জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ৪৮ কোটি টাকা।

* যেমব জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তার মাঝে রাজউকের আছে ৪৬ শতাংশ, 'কোর্ট অব ওয়াক্স'-এর ৮১ একর, পাবলিক ল্যান্ড ১৪১ একর ও বিটিভির ১ একর।

* হাতিরঝিল সংযুক্ত করেছে ঢাকা মহানগরীর পূর্ব ও পশ্চিমকে। এজন্য নির্মিত সড়কের দৈর্ঘ্য ৮.৮০ কিলোমিটার। 

* স্থানীয় জনগণের যাতায়াত সহজ করতে নির্মাণ করা হয়েছে সার্ভিস রোড, যার দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার। 

* হাতিরঝিলের যোগাযোগকে সহজ করেছে এবং এর সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে হাতিরঝিলের ওপর নির্মিত ৪ টি সেতু। এদের দৈর্ঘ্য ৪৭৭.২৫ মিটার। 

* হাতিরঝিলে যেমন প্রশস্ত ফুটপাত পাবেন তেমন হয়ত দেশের আর কোথাও নেই। হাঁটার জন্য চমৎকার জায়গা এটি। সড়কের দৈর্ঘ্য যত ফুটপাতের দৈর্ঘ্যও তাই। অর্থাৎ, ৮.৮০ কিলোমিটার। এছাড়া লেক সাইড ওয়াকওয়ের দৈর্ঘ্য ৯.৮০ কিলোমিটার। 

* তিনটি ভায়াডাক্ট আছে এখানে যার দৈর্ঘ্য ২৬০ মিটার। 

* হাতিরঝিলকে যানজটমুক্ত রাখতে তৈরি করা হয়েছে ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্যের ওভারপাস, ইন্টারসেকশন ও রাউন্ডঅ্যাবাউট।  

* হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ণের আগে ঝিলের পরিবেশ ছিল খুবই নোংরা, পানি ছিল দুষিত। প্রকল্পের আওতায় ১০.৪৫ কোটি ঘনফুট বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ১০.৪০ কিলোমিটার মেইন ডাইভারশন স্যুয়ারেজ লাইন স্থাপন করে প্রকল্প এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর করা হয়েছে। 

হাতিরঝিলআলো ঝলমলে হাতিরঝিল। ছবি- আবু সুফিয়ান জুয়েল

মিথঃ

ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শেষ করি হাতিরঝিলের কথা। গল্পটি প্রচলিত আছে এর নাম নিয়ে। অনেকেই প্রশ্ন করেন হাতিরঝিলের নাম হাতিরঝিল কেন? এখানে কি অনেক হাতি ছিল? কার ছিল সেসব হাতি? কোথেকে এলো আর গেলই বা কোথায়? জনতার অনুমান একটু হলেও ঠিক। হাতিরঝিল একসময় ছিল ভাওয়াল রাজার অধীনে। রাজার ছিল অনেক হাতি। রাজার হাতির পাল এখানকার বিলে স্নান করতো। মূলত এখানেই বিচরণ কত তারা। সেই থেকে এখানকার নাম হয় হাতির বিল। কালের বিবর্তনে সেই বিল রূপ নেয় হাতিরঝিল নামে। এই হাতিদের নিজ আবাস ছিল ঢাকার পিলখানা। এখান থেকে বিলে আসতে যে যে পথ ব্যবহার করত তার সবই হাতি সংক্রান্ত নাম পেয়েছে। মজার ব্যাপার হলো সে সময় হাতিরঝিল এত বড় ছিল না। বরং বাড্ডা, রামপুরা, তেজগাঁ, মায়াকুঞ্জ, মগবাজারে আলাদা আলাদা বিল ছিল। এগুলো এক সময় সংযুক্ত হয়ে যায় আর এই অপরূপ জলাশয়ের সৃষ্টি করে।

সোডিয়াম লাইটের সেই সোনালী ঢাকা এখন আর নেই। তবে রঙিন আলো আর ফোয়ারার জলকেলির সংগীতময় এই ঢাকাও মন্দ নয়। বরং আধুনিক, শিল্পসম্মত। ভালোবাসি এই প্রাণের শহর ঢাকাকে।

 

সম্পাদনাঃ ড. জিনিয়া রহমান

প্রিয় ট্রাভেল সম্পর্কে আমাদের লেখা পড়তে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেইজে। যে কোনো তথ্য জানতে মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। ভ্রমণ বিষয়ক আপনার যেকোনো লেখা পাঠাতে ক্লিক করুন এই লিংকে - https://www.priyo.com/post।