ঋত্বিক কুমার ঘটকের ছবিটি সংগ্রহীত

ঋত্বিক কুমার ঘটক মহাকালের নিঃসঙ্গ বেণুবাদক

সোয়েব আহমেদ
চিত্রগ্রাহক ও লেখক
প্রকাশিত: ০৩ নভেম্বর ২০১৮, ১২:৩২
আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৮, ১২:৩২

ঋত্বিক কুমার ঘটক সময়ের এই নিঃসঙ্গ বেণুবাদক ২১ বছর বয়সে দেশ ভাগের কারণে পরিবারের সাথে পূর্ব বাংলা ছাড়তে বাধ্য হন। দাঙ্গা, মন্বন্তর, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দেশভাগ তাকে বিপর্যস্ত করেছে। তার কাজে দলিত মানুষের উপস্থিতি প্রবল। নিজ দেশত্যাগী, বাস্তুচ্যুত, ছিন্নমূল, দলছুট, নির্বাসিত জীবনের কথা বলে গেছেন গল্পে, মঞ্চের সংলাপে, সেলুলয়েডের ফিতায়।

তৎকালীন শিল্প-সংস্কৃতির সূতিকাগার কলকাতায় গমন যেমন ছিল অবধারিত তেমনি দেশভাগ, দাঙ্গা ও মাতা পিতা বিয়োগসহ বিভিন্ন কারণে এখানে ফিরে না আসাটা একরকম বাধ্য হয়েই। কিন্তু আমৃত্যু তার অধিকাংশ সৃষ্টিকর্মে এই মাটির প্রতি নিরন্তর ভালোবাসা ও পক্ষপাতের নিদর্শন রেখে গেছেন। তিনি বলেন - ‘আমার সমস্ত বাংলাকে ভালোবাসার মূল হচ্ছে পূর্ব বাংলা। নিজেদের ষোলআনা সুবিধের জন্য জোচ্চুরি দ্বারা যে দেশ ভাগ করা হলো, তার ফলে আমার মতো প্রচুর বাঙালি শেকড় হারিয়েছে। এ দুঃখ ভোলার নয়। আমার শিল্প তারই ভিত্তিতে।’

খ্যাপাটে এই মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার পারিবারিক কৌলীন্য। সৃষ্টিশীল এই মানুষটির জন্ম এক ধ্রুপদী পরিবারে। এই মহান মানুষটির জন্ম ও বেড়ে ওঠা আমাদের দেশেই। পাবনার ভারেঙ্গা গ্রামে ঋত্বিক ঘটকের মূল বাড়ি। পিতার কর্মসূত্রে ১৯২৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর ঢাকার ঋষিকেশ দাস লেনের ঝুলন বাড়িতে জন্ম হয়েছিল দুটি ছেলেমেয়ের। এদের একজন পরবর্তী জীবনে স্বনামধন্য ঋত্বিক কুমার ঘটক। বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক, মা ইন্দুবালা দেবী। ৯ ভাই বোনের মধ্যে ঋত্বিক ও প্রতীতি সবার কনিষ্ঠ। বাবা ঋত্বিককে আদর করে ডাকতেন ‘টেক বাহাদুর’ এবং ‘ভবা’। তার স্কুলজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহে, এরপর রাজশাহীতে শিক্ষা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটান। মূলত এখানেই ঋত্বিকের ঋত্বিক হয়ে ওঠা।

আজীবন শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের জন্য লড়ে গেছেন কলম, মঞ্চ ও সেলুলয়েডকে হাতিয়ার করে। ছোটবেলা থেকেই বাঁশি বাজানো, ছবি আঁকা, গল্প লেখা ও অভিনয় নিয়ে মেতে থাকতেন। ১৯৪৩ সালে রাজশাহী গণগ্রন্থাগারে নাটক ‘অচলায়তন’ মঞ্চস্থ করেন। সেখানে থাকাকালীন রাজনীতিতে সরাসরি না জড়ালে ও স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য লেখালেখি শুরু করেন, তখন প্রচুর গল্প লিখেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য - জ্বালা, চোখ, কমরেড, গাছ, আয়নান্ত, আকাশ গঙ্গা, দলিল, বিসর্জন ইত্যাদি। সেসময় তার গল্প প্রকাশ হয় দেশ, অগ্রণী ও শনিবারের চিঠিতে। বেশিরভাগ গল্পেই এসেছে দেশভাগ, কাঁটাতার, দুই বাংলার বাস্তুচ্যুত মানুষের কথা। আছে প্রেম। কোনো কোনো গল্প নিছক কবিতাও। দেশভাগের পর ফিরে না আসার কারণে ঋত্বিক হয়ে গেলেন ভারতীয়। আজ বিশ্বময় ঋত্বিক ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তার সৃষ্টি দেখলে বা পড়লেই বোঝা যায় ঋত্বিক কী?

সেই সময়ে নাটক ‘নবান্ন’ মঞ্চস্থ হল। ‘নবান্ন’ তার সমস্ত জীবনধারা পাল্টে দিল। তিনি তখন নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু কোথাও যেন স্বস্তি মিলছে না। লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে যেতে হবে। যোগ দেন কলকাতার আইপিটিএ তে। শুরু করেন গণনাট্য আন্দোলন। যে কয়েকটি নাটকের জন্য ঋত্বিকের নাম নাট্য আন্দোলনে চিরদিনের জন্য জায়গা করে নিয়েছে তার একটি দেশভাগ ও উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে নাটক ‘দলিল’। পাশাপাশি সেলুলয়েডকে হাতিয়ার করে শ্রেণীবৈষম্য ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।

ঋত্বিক কুমার ঘটক। ছবি : সংগৃহীত

১৯৫২ সালে নাগরিক সিনেমার কাজ শেষ হলেও তা তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের সরকারের হস্তক্ষেপে আলোর মুখ দেখেনি। বেকার যুবক রামুর ঘর বাঁধার স্বপ্নের ছবি ছিল ‘নাগরিক’। ঋত্বিকের ছোট বোন প্রতীতি দেবীকে সত্যজিৎ রায় এক অনুষ্ঠানে বারবার বলেছিলেন ‘তখন যদি ওই ছবি নাগরিক দেখানো হতো, তাহলে ঋত্বিকের আগে ভারতবর্ষে আর কারো নাম উচ্চারিত হতো না।’ বুক ভরা যন্ত্রণা নিয়ে ক্ষণজন্মা ঋত্বিক ঘটক ১৯৫২ সালে নিজের লেখা নাটক নিয়ে বোম্বে পাড়ি দিলেন গণনাট্যের কনফারেন্সে। সেই সময় বোম্বেতে বিমল রায়ের ‘মধুমতী’ ও ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির’ এর চিত্রনাট্য লিখে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন।কিন্তু শুধু পয়সা আর জনপ্রিয়তার জন্য দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করা মোটে ও পছন্দ করতেন না। তাই সেসব ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। ‘নাগরিক’ যন্ত্রণা তখনো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

হাত দিলেন পরের ছবি সুবোধ ঘোষের কাহিনি অবলম্বনে ‘অযান্ত্রিক’ সিনেমায়। চরিত্রটি বলতে জগদ্দল আর বিমল। ছিন্নমূল মানুষের কলোনিতে ফের তার ক্যামেরা ধরল ক্ষয়িষ্ণু জীবন। অযান্ত্রিক মুক্তি পেল, উচ্ছ্বসিত দর্শক। জনপ্রিয় হলো পরের সিনেমা শিবরাম চক্রবর্তীর ছোট গল্প অবলম্বনে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। এরপর একে একে তৈরি করলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কমলগান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’। নাট্য আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির অনেকের সাথে তার মতবিরোধ দেখা দিল। অনেকে তাকে বয়কট করল। কিন্তু জীবনের কোনো স্তরে তিনি বিন্দুমাত্র আপোষ করেননি। ফলে হারিয়েছেন বন্ধু, সহকর্মী, কখনো বা পারিবারিক আশ্রয়। অর্থ, যশ, খ্যাতি তাকে কখনো প্রলুব্ধ করেনি। বরং তাচ্ছিল্যের সাথে এসব জাগতিক মোহ উড়িয়ে দিয়েছেন এক ফুঁৎকারে।

স্বাধীন বাংলাদেশ এসে করেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এই সিনেমাটি নিয়ে তার আগ্রহ আর উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। সবটুকু দরদ ঢেলে তিনি ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন। বস্তুত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে কজন জীবনবাদী চলচ্চিত্রকারের সাধনায় বাংলা ছবি আজ গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত, তাদের প্রথম সারিতে রয়েছে তার স্থান।

‘মশাই আমার শত্রু অনেক। মাঝে মাঝে মনে হয় বাঁচব কী নিয়ে! চারিদিকে শুধু হতাশা, বিদ্বেষ, প্রতারণা, বঞ্চনা, যে প্রিয় বন্ধুদের নিয়ে মহা সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলাম একদিন, তারা যে শুধু আমাকে নিরাশই করছেন তা নয়, তারা আজ শত্রুতাই করছেন। আমি জানি আমার অপরাধের কথা। তবু ও একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমি আজো মরে যাইনি। মরার আগে আমি প্রমাণ করে দিয়ে যাব আমার চারপাশের জনতার চাইতে আমি অন্যরকম।’

ঋত্বিক ঘটক আজো কাঁধে হাত রেখে যেন বলছেন - ‘চলো, থেমে থেক না। ঐ তো নতুন বাড়ি, সুবর্ণরেখার তীরে...’

প্রিয় বিনোদন/গোরা