ছবি সংগৃহীত
‘আমরা নাট্যচর্চার মাধ্যমে একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করছি’
আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৬, ১৫:২০
ছবি: নাঈম প্রিন্স।
(প্রিয়.কম) হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নাট্যদলগুলো। বেশকিছু মঞ্চদলই বর্তমানে তাঁদের নাটক দিয়ে মঞ্চে আলো ছড়িয়ে আসছেন। এদের মধ্যে ‘স্বপ্নদল’ নিজগুণেই স্বনামধন্য। সম্প্রতি দলটির প্রধান জাহিদ রিপন স্বপ্নদলের কর্মীদের নিয়ে হাজির হয়েছিলেন প্রিয়.কম অফিসে। সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি জানালেন নানান গল্প। আড্ডার চুম্বক অংশ তুলে ধরলেন সুদীপ্ত সাইদ খান।
প্রিয়.কম: গত বছরের নভেম্বরে আপনারা লন্ডনে স্বপ্নদলের নাটক ‘ত্রিংশ শতাব্দী’র প্রদর্শনী করে এলেন? কেমন ছিল সে অভিজ্ঞতা?
জাহিদ রিপন: আমি একটু শুরু থেকে বলতে চাই। ২০০১’য়ে স্বপ্নদলের তৈরি।এরপর ২০০২ তে ত্রিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রদর্শন করি। আমরা পনের বছর ধরে এই নাটকটা প্রদর্শন করে আসছি। প্রতি বছর ৬ই আগস্ট আমরা নাটকটি মঞ্চায়নের মাধ্যমে হিরোশিমা দিবস পালন করি ।২০১৫’র ফেব্রুয়ারিতে ভারতের রাষ্ট্রীয় নাট্য উৎসব ‘রঙ্গমঞ্চে’ আমন্ত্রিত হওয়ার পর আমরা মনে করেছি যে এই নাটকটা বিশ্বব্যাপী প্রদর্শন করা সম্ভব। সে সময়েই আমরা লন্ডন থেকে আমন্ত্রণ পাই।লন্ডনের এ সিজন অব বাংলা ড্রামা শিরোনামে উৎসবে আমরা অংশ নিই। আর বিদেশে গিয়ে প্রদর্শনী করাটা আমাদের জন্য একটা অভিনব আনন্দের ব্যাপার।আমরা ওখানে দুটি প্রদর্শনী করেছি।
প্রিয়.কম: যুদ্ধবিরোধী নাটক নির্মাণের অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন?
জাহিদ রিপন: আমরা শুধু নাটক করার জন্য নাটক করব না এমনকিছু করব যা আসলে মানুষকে ভাবাবে। সেই চিন্তা থেকেই এই নাটকটা নির্মাণ করা।আর মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নৃসংস হত্যাকাণ্ড হয় নাগাসাকি হিরোশিমায়। এর সঙ্গে আমরা আপডেট করেছি সাম্প্রতিক যুদ্ধের হত্যাকাণ্ডগুলোর কথাও। এটি প্রতিনিয়ত আপডেট হয়। প্রতি প্রদর্শনীর আগেই সমকালীন বিষয়গুলো আমরা যুক্ত করি।
প্রিয়.কম: লন্ডনে আপনারা আতিথেয়তা কেমন পেয়েছেন?
জাহিদ রিপন: বাংলাদেশ থেকে একটা দল যাচ্ছে, সেটা আবার যাচ্ছে একটা কমিটির বাছাইয়ের মাধ্যমে। ফলে সেখানকার দর্শকদের মধ্যে বেশ একটা আগ্রহ ছিল।সেখানকার বেশকিছু দল ও নাট্যকর্মী। আমাদের জানিয়েছে, আমাদের এই নাটকটা নাকি তাদের আকৃষ্ট করেছে।আর আমাদের নাটকটি পরিশীলিত বলেও জানিয়েছে তারা। সেখানকার ডকল্যান্ড থিয়েটার আমাদের জন্য পার্টিও দিয়েছে, এ ছাড়া সোলফেয়ার থিয়েটারসহ তিনটি দলের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে।
প্রিয়.কম: তাদের সঙ্গে কথা বলে কি জানতে পেরেছেন, আমাদের দেশের মঞ্চ নাটক সম্পর্কে তাদের ধারণা কতটুকু?
জাহিদ রিপন: তাদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু মনে হয়েছে তাতে তারা বাংলাদেশের দলগুলো সম্পর্কে কিছুই জানে না বলা যায়। কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ক্লাস নেওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলে সেখানে আমি স্বপ্নদল ও বাংলা নাটক বিষয়ে চার ঘণ্টার ক্লাস নিয়েছি। আমরা সেখানে যেটা দেখেছি যে, তারা আসলে বাংলা নাটক বা এই অঞ্চল সম্পর্কে কম জানে।আমরা তাদের বলেছি আমরা তো তোমাদের কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে জানি। তোমাদের কি আমাদের কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে জানা উচিত না। তখন তারা স্বীকার করেছ যে হ্যাঁ, আমাদের তা জানা উচিত। আমাদের বক্তব্যের মাধ্যমে তারা আমাদের নাটক সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করেছে।
প্রিয়.কম: লন্ডনের নাটকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নাটকের তুলনামুলক মূল্যায়ন দাঁড় করালে আমরা কতটুকু পিছিয়ে থাকবো?
জাহিদ রিপন: লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানকার একটি পত্রিকাসহ বেশ কয়েকটা জায়গায় আমাকে আম্রন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তো আমি সব জায়গায় একটা কথা বলার চেষ্টা করেছি-বাংলা নাটকে হাজার বছরের একটা ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু এই বৃটেনের কারণেই আমাদের ঐ ধারাবাহিক ঐতিহ্যটা বিনষ্ট হয়েছে। আজকে আমরা যদি বৃটেনের অধীনে না থাকতাম তাহলে আমাদের হাজার বছরের সেই ঐতিহ্যটা আরও সমৃদ্ধ হতো। আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাধ্যমে আমরা এখন আমাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন।এখন আমরা আমাদের আধুনিক নাট্যকলাকে ঐতিহ্যগতভাবে উন্নয়ন করার চেষ্টা করছি। তোমাদের সেক্সপিয়র শুধু নয় এর বাইরেও আধুনিক নাটক তৈরি হতে পারে এর নমুনা হিসেবেই ত্রিংশ শতাব্দী এনেছি।
ওখানকার যে মূল ধারার দলগুলো-অর্থাৎ ইংরেজদের প্রদর্শনীগুলো দেখা হয় নাই। তবে তাদের মিলনায়তনগুলো দেখেছি। ওখানে থিয়েটার বেশ এক্সপেনসিভ। ইংল্যান্ডে তো প্রচুর পর্যটক যায়, তাদের প্রায় ত্রিশ শতাংশই থিয়েটার দেখে যায়।
আমি একটা মিলনায়তনের টিকেট কাউন্টারে গিয়ে বললাম যে এখানে আজ কি নাটক চলে? তো জবাবে তারা বলল যে, কি নাটক নয় কি কি নাটক চলে সেটা জিজ্ঞাসা করেন। আজ এখানে ২৫টি নাটক চলছে, আপনি যেটা দেখতে চান, দেখতে পারবেন। ওখানে কিছু নাটক আছে যেগুলোর দুই মাসে একটা টিকিট পাওয়া যায় না।সেগুলো বেশিরভাগই পুরস্কারপ্রাপ্ত নাটক। আর একটা নাটকের জন্য তারা একটা মিলনায়তন পাঁচ বছরের জন্য ভাড়া করে রেখে দিয়েছে। পাঁচ বছরের জন্য তারা তাদের মঞ্চটাকে সেভাবে সাজিয়ে রেখেছে।এরপর প্রতিদিন তিনটা করে শো হচ্ছে ঐ নাটকের। তো দেখুন তাদের নাটক কতটা প্রফেশনাল।
প্রিয়.কম: সেলিম আল-দীনের আদর্শকে মূলমন্ত্র হিসেবে নিয়েছেন আপনারা। কিন্তু আর কোন মণীষাকে নিয়ে কেন আপনারা সেভাবে কাজ করলেন না?
জাহিদ রিপন: প্রথমত হলো আমি সেলিম আল দীনের সরাসরি ছাত্র ছিলাম। যদিও সেলিম আল দীনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পাঁচ ছয় বছর আগে থেকেই থিয়েটার করি। তো সেলিম আল দীনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার ধারণাটা পাল্টে গেল। আমি থিয়েটার সম্পর্কে আরও বুঝতে পারলাম। সেলিম আল দীন বললেন আমরা হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে নাটক নির্মাণ করব কিন্তু পাশ্চাত্য ঋণকে অস্বীকার করে নয়। আমরা আরও অনেক মণীষাকে নিযেও কাজ করেছি। ফলে শুধু সেলিম আল দীনকে নিয়ে কাজ করছি এটা বলা যাবে না।
প্রিয়.কম: কিন্তু আপনাদের দলের সঙ্গে সেলিম আল দীনের নাম কিন্তু সিল মেরে গেছে?
জাহিদ রিপন: সেলিম আল দীনের নামের সঙ্গে আমাদের দলের নাম মিলে যাওয়ার কারণটা হচ্ছে কঠিনতার কারণে সেলিম আল দীনের নাটক সবাই করতে পারে না। দুটি নাট্যদল তাঁর নাটকগুলো করে তারা হচ্ছে ঢাকা থিয়েটার আর স্বপ্নদল। আমরা সেলিম আল দীনকে নিয়ে ১৩টা উৎসব করেছি। এ ছাড়া ময়মনসিংহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় আমরা উৎসব করেছি। সেজন্যই সেলিম আল দীনের নামটা যুক্ত হয়ে গেছে আমাদের সঙ্গে।
আড্ডার এই পর্যায়ে স্বপ্নদলের অন্য সদস্যরাও অংশ নেন। তাঁরা ত্রিংশ শতাব্দী নাটক, লন্ডন সফর, দলের ভালমন্দ ও স্বপ্নদলে যুক্ত হওয়ার গল্প বলেন-
জুয়েনা শবনম: এই নাটকে মিসেস ইথারলি চরিত্রে অভিনয় করেছি। আমি মনে করি এই চরিত্রটা করে আমি আত্মতৃপ্তি পাই। আর স্বপ্নদলের আমি একজন ফাউন্ডার মেম্বার। শুরু থেকেই স্বপ্নদলের সঙ্গে আছি।আমি নিজের তাড়না থেকেই এই নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।
শিশির শিকদার: ত্রিংশ শতাব্দী নাটকে আমি ১৯৪৪ সালে আক্রান্ত এক নাবিকের চরিত্রে অভিনয় করেছি। আর স্বপ্নদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে এটি একটি প্রোডাক্টিভ দল। আমাদের দল প্রধান জাহিদ রিপনের জীবনাচারণ তার সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে।
আব্দুস সামাদ ভুঞা: ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ নাটকটি আসলে মানুষের সত্তার দ্বন্ধ নিয়ে নির্মিত। মানুষের ভাল এবং মন্দ সত্তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এতে । ২০০৩ সাল থেকে আমি এই দলের সঙ্গে যুক্ত আছি। সম্পৃক্ত থাকার আরেকটা কারণ হচ্ছে নাটক করার জন্য যে যে জিনিসগুলো করা দরকার-মানুষ হিসেবে যে কাজগুলো করা দরকার তা স্বপ্নদল থেকেই শিখেছি।
জেবুননেসা: ২০১২ সালে আমি স্বপ্নদলে এসেছি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে।আর আমি যে মাসে জয়েন করেছি সেই মাসেই কুষ্টিয়ায় গিয়ে পারফর্ম করার সুযোগ পেয়েছি।কুষ্টিয়ায় প্রোগ্রাম করার পর দলের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে গেছে কারণ নারী হিসেবে যে নিরাপত্তা, যে সম্মানটা পাওয়ার দরকার তার পুরোটাই পেয়েছি। স্বপ্নদলের প্রায় সবগুলো নাটকই করেছি। আর ত্রিংশ শতাব্দীতে যে কাজ করতে পেরেছি এটা আমার সৌভাগ্য বলব। আপনি জানতে চেয়েছেন স্বপ্নদলের কোনো দোষ আছে কিনা, আমি বলবো স্বপ্নদলের কোন দোষ নেই, ভালটাই বেশি দেখি।তবে আমরা প্রচুর শো করি। আমাদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। স্বপ্নদলের দোষ এই একটাই (হাসি)।
মো. রেজাউল মাওলা নাবলু: বিজ্ঞাপন দেখে স্বপ্নদলের কর্মশালা করি। এরপর নাট্যদলে যোগ দেই। স্বপ্নদল নিয়ে যেটা বলবো সেটা হচ্ছে পুরো দলটাই একটা ফ্যামিলির মতো হয়ে গেছে।আর স্বপ্নদলের দোষ হচ্ছে থিয়েটার করতে এলে থিয়েটারই করতে হবে। অন্যকিছু করা যাবে না। এখানে কোন অসততা চলবে না, বিশৃঙ্খলা করা যাবে না। মানে স্বপ্নদল একটু বেশি কঠোর। বাসায় ঢোকার সময় জুতাটা এলোমেলো করে রাখি কিন্তু এখানে সেটা করা সম্ভব হয় না। সবকিছু সাজিয়ে রাখি। এই কষ্টটা করতে হয় এটাই স্বপ্নদলের দোষ মনে হয়। আর অন্যান্য থিয়েটার মতো নাটক-গান করলেই হয় না এখানে সেমিনারে যেতে হবে, নাটক দেখতে হবে, বই পড়তে হবে সাহিত্য করতে হবে। স্বপ্নদল নিয়ে প্রচলিত আছে যে, তুমি স্বপ্নদলে যোগ দিবে? তোমার পরিবারের কেউ আর্মিতে ছিল নাকি? এ দলের নিয়ম শৃঙ্খলা এরকমই কঠিন।
মেহেদী হাসান: আমি ২০১২ সাল থেকে স্বপ্নদলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমি এখানে আসার আগে বিভিন্ন দলে অ্যাপ্লাই পাঠিয়েছি কিন্তু কেউ সেভাবে ডিসিপ্লিনের সঙ্গে আপডেট জানায়নি। কিন্তু স্বপ্নদল অ্যাপ্লিকেশন পাওয়ার পর পরই নিযমিত সর্বশেষ আপডেট জানিয়েছে। এ কারণেই স্বপ্নদলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। সবমিলিয়ে বলবো নাটক থেকে কিছু শিখতে চাইলে স্বপ্নদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে।
তানভীর শেখ: স্বপ্নদলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ঘটনাটাও মজার। পাবনা থেকে ঢাকায় এসেছি শুধুমাত্র শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হব বলে। এরপর স্বপ্নদলের সঙ্গে ওয়ার্কশপ করার পর তাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। পাশাপাশি আরও বিভিন্ন জায়গায় ওয়ার্কশপ করেছি। কিন্তু প্রথম দিকে মন ছিল না তেমন। এক বছর পর মনে বুঝলাম যে স্বপ্নদলই আমার জন্যে পারফেক্ট। সেই থেকে স্বপ্নদলের সঙ্গেই যুক্ত আছি।
দীন ইসলাম শুভ: স্বপ্নদলের কাজ দেখেই আমি স্বপ্নদলে যুক্ত হয়েছি। আমরা সবাই আত্মসম্মানের সঙ্গে কাজ করি। এখানের কোনো দোষ চোখে পড়ে না। এমন শৃঙ্খলাবদ্ধ দল খুবই কম আছে বাংলাদেশে।
প্রিয়.কম: জাহিদ ভাই আপনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন নাকি?
জাহিদ রিপন: (হাসি) থিয়েটার হচ্ছে সচবচেয়ে কঠিন কাজ। ভরতমুণী বলে গিয়েছেন সকল কর্ম সকল জ্ঞান মহৎ হতে হবে। কিন্তু সেটা তো আমাদের পক্ষে হওয়া সম্ভব না। একটা শিল্পকে একটা ফ্রেমের ভেতর আনতে হবে। নচেৎ হবে না। আর আধুনিক সময়ে থিয়েটার সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন কাজ।বিশ্বের অন্যান্য দেশে সবচেয়ে ট্যালেন্টেড লোকরা থিয়েটারে আসে।আর আমাদের দেশে যারা নাচ জানে না বা অভিনয় জানেন না তারাই আসে থিয়েটারে। একটা বিজ্ঞাপনে দেখায় যে, ফেয়ার এন্ড লাভলি মেখে হেঁটে যাওয়া এক মেয়ের সঙ্গে ডিরেক্টরের ধাক্কা লেগে গেল আর তিনি অমনি বলে উঠলেন অভিনয় করবে। তো ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে ফেয়ার এন্ড লাভলি থাকলে এবং ধাক্কা খেলেই অভিনেত্রী হওয়া যায়। এটা আসলে ঠিক নয়। এটার মাধ্যমে ভুল ইনেফরমেশন দেওয়া হচ্ছে তরুণদের। এই জায়গাটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। আমার মতে প্রস্তুতিটা হবে সবচেয়ে কঠিন। তাহলে পারফর্মটা হবে সহজ। সেজন্যই আমরা কঠোর পন্থা অবলম্বন করি।
প্রিয়.কম: একটা দল নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন, আবার একটা দলকে ১৫-১৬ বছর একত্রিত রাখাও কঠিন। এটা নিয়ন্ত্রণের মন্ত্র কি?
জাহিদ রিপন: যদি মূল কাজটা বোঝা যায় আমরা কি আয়োজন করতে যাচ্ছি, আমরা কোথায় বিশেষ, সেটা জানতে পারলেই সমাধানটা হয়ে যায়। আমি চাই আমাদের এ ছেলেমেয়েদের প্রত্যেকের মধ্যে যে গুণটা আছে সেটা বিকশিত হোক। আমাদের দলে অনেকেই এসেছে আবার অনেকে চলেও গেছে। আবার সবাই যে একরকম হবে তাও নয়। আমরা মনে করি নাট্যচর্চার মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় দায়িত্ব পালন করছি।সে কারণেই আমরা নাট্যকর্মীরা এক থাকতে পারি।
প্রিয়.কম: মঞ্চনাটকের এই মাধ্যমটা সেভাবে কিন্তু এদেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না, এর কারণ কি?
জাহিদ রিপন: আমি একটু লন্ডনের অভিজ্ঞতা যোগ করে উত্তরটা দিতে চাই। লন্ডনে কিন্তু পর্যটকদের ত্রিশ শতাংশই নাটক দেখছে। তার মানে সভ্য দেশের জনগণের মাঝে থিয়েটার দেখা অপরিহার্য একটা অংশ। কিন্তু আমাদের দেশে এটা হয়নি।কারণ আমাদের ধারণাগুলোর জায়গায় কিছু বিভ্রান্তি আছে। আমাদের দেশের অভিনয় শিল্পী হতে চাওয়া তরুণদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে যে, প্রথমে মঞ্চ নাটক, টিভি নাটক, এরপর সিনেমায় অভিনয়। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ এগুলো মঞ্চনাটকের জায়গাটাকে বাধাগ্রস্ত করে।সেই সঙ্গে আমাদের পরিবারে থেকে, সমাজ থেকে মঞ্চনাটক দেখার আগ্রহটা বাড়াতে হবে। ঢাকা শহরেও সবাই জানে না মঞ্চনাটক কোথায় প্রদর্শন করা হচ্ছে। সরকারেরও এ মাধ্যমে সহায়তা করতে আরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
প্রিয়.কম: মঞ্চনাটকগুলো সার্ভাইভ করছে কী করে?
জাহিদ রিপন: মঞ্চনাটক করে সার্ভাইভ করা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। আমাদের স্পার্টাকাস বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা। আমাদের কর্মী থেকে ছেলেমেয়েরা এমনকি আমরাও এখান থেকে কোনো টাকা আয় করছি না, এমনকি পারিশ্রমিকও নিচ্ছি না, আমরা এটা করেছি ভালোবাসা থেকে। আমরা নিজেদের টাকায় নিজেরা নাটক নির্মাণ করছি। আর স্পন্সরও খুব একটা পাই না। তবে আমাদের দলের শুভাকাঙ্খীরা কখনো কখনো টাকা দেয়। এভাবেই চলছে আমাদের দলগুলো।আমাদের পাশ্বর্তী দেশেও থিয়েটার কর্মীদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে যদি অন্তত বিশটা দলকে সিলেক্ট করেও বেতন দেওযা হয় তাহলে পুরো বাংলাদেশের নাট্যদলগুলোর চেহারা পাল্টে যাবে, পাল্টে যাবে সংস্কৃতির চেহারাটাও।
প্রিয়.কম: এমন পরিস্থিতিতে স্বপ্নদলের সংগ্রাম, কষ্ট…
জাহিদ রিপন: অমানুষিক পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি। আপনারা যতটুকু দেখেন তার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করি আমরা।আমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা জব করে চলি। আর আমার সুবিধা হচ্ছে আমার পুরো পরিবারই থিয়েটার পাগল। ফলে পারিবারিক বাঁদাটা অন্তত আমাকে স্পর্শ করে না। তবে দলগত জায়গায় আমাদের পৃষ্ঠপোষকতার বড় অভাব। যে পরিশ্রম করি সে পরিশ্রমের স্বীকৃতিও মেলে না।আরেকটা কষ্ট হচ্ছে অনেক ছেলেমেয়েরাই আমাদের ছেড়ে চলে যায়।ফলে মাঝে মাঝেই মন খারাপ করে একাকী ঘুরাঘুরি করি।আমরা যারা থিয়েটার করি তাঁদের সবার অবস্থা এরকমই।