ছবি সংগৃহীত

হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য : বিষয়বিন্যাস ও নির্মাণ কৌশল

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ০৯:০৩
আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ০৯:০৩

গ্রাফিক্স: আকরাম হোসেন।

(প্রিয়.কম) অমর একুশে বইমেলা ২০১৬তে প্রকাশিত হয়েছে চন্দন আনোয়ারের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য : বিষয়বিন্যাস ও নির্মাণ কৌশল’। বইটি নিয়েই সাজানো হলো আজকের ‘বই সমাচার’।


প্রকাশনা তথ্য:

অমর একুশে বইমেলা ২০১৬তে প্রকাশিত হয়েছে চন্দন আনোয়ারের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য : বিষয়বিন্যাস ও নির্মাণ কৌশল’। বইটি প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। ৩৬৮ পৃষ্ঠার এ বইটির মূল্য : ৪২০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে বইমেলার বাংলা একাডেমি’র স্টলে।

লেখকের কথা:

বাংলাদেশের কথাসাহিতের অবিস্মরণীয় নাম হাসান আজিজুল হক। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের যবগ্রামে জন্ম নেওয়া এই লেখকের লেখালেখির শুরু বিশশতকের ষাটের দশকে। ছোটগল্পের লেখক হিসেবে প্রধান পরিচিতি হলেও সম্প্রতি ‘আগুনপাখি’ ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ উপন্যাস লিখে ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর শক্তিমত্তার স্বাক্ষর রেখেছেন।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের ভয়াবহতম মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংঘাত, বস্ত্রসংকট, দেশভাগ, উত্তরকালে সৃষ্ট উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সমস্যা, পাকিস্তানের স্বৈরশাসন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সকল পর্যায়, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতা, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু, সামরিকতন্ত্রের উত্থান ও বিকাশ ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ তাঁর কথাসাহিত্যের বিষয়।

বলা যায়, বাঙালির জাতীয় জীবনের অর্ধ-শতাব্দীর অধিককাল ধরে ঘটে যাওয়া সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সকল পরিবর্তনকেই হাসান আজিজুল হক কথাসাহিত্যের বিষয় করেছেন। এছাড়া বাংলা কথাসাহিত্যের নির্মাণকৌশলের প্রতিটি অনুষঙ্গে, যেমন আখ্যান-নির্মাণ, ভাষারীতি, শব্দসৃজন, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, বাক্যবিন্যাস, সংলাপ-নির্মাণ, রূপক-উপমা, চিত্রকল্প ইত্যাদিতে হাসান আজিজুল হক নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেন। তিনি গল্পবর্জিত প্রকরণসর্বস্ব কঙ্কালসার আখ্যান নির্মাণের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন। সময়, সমাজ, দেশ ও মানুষ যে বাস্তবতার মুখোমুখি, এবং যে বাস্তবতার ভেতর দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত, সেই বাস্তবতাকে শিল্পায়িত করতে যে ধরনের আখ্যান ও গল্পভাষার প্রয়োজন, হাসান আজিজুল হক ঠিক সেই ধরনের আখ্যান ও গল্পভাষা নিজের মতো করে নির্মাণ করে নিয়েছেন। তিনি গল্প-উপন্যাসের প্রচলিত নির্মাণ-কাঠামোর ধারণা অথবা কোনো ধরনের সংজ্ঞা বা প্রতিষ্ঠিত কোনো সাহিত্যতত্ত্বকে গ্রহণ করেননি। তাঁর প্রতিটি লেখা অভিজ্ঞতার নিজস্ব রূপায়ণ। তাই, তাঁর গল্প-উপন্যাসের নামকরণ থেকে শুরু করে নির্মাণকৌশলের প্রতিটি অনুষঙ্গ স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত। হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যের বিষয় ও নির্মাণশৈলীর সামগ্রিক মূল্যায়নধর্মী গ্রন্থ এটিই প্রথম।

বই থেকে পাঠ
হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যে দেশভাগ ও দাঙ্গা
চন্দন আনোয়ার

দেশভাগের (১৯৪৭) প্রত্যক্ষ ও তাৎক্ষণিক ভয়ঙ্কর রূপ ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তান অংশে কম ছিল। তাই, বাংলা কথাসাহিত্যে দেশভাগের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম। পাঞ্জাবে দেশভাগের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক। সাদাত হাসান মান্টো, কৃষণ চন্দর, ভীষ্ম সাহীন দেশভাগ ও দাঙ্গা নিয়ে এমন অসাধারণ গল্প লিখেছেন, যার তুল্য দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে খুব কম আছে। ‘বাংলায় ধর্ষণ, অপহরণ, ধর্মান্তর সেই পরিমাণে হয়নি বটে, ধর্ষণের আতঙ্ক, অপহরণ, ধর্মান্তরের ভয় সবসময়ই ছিল এবং সেই ভয়ই দেশ ছাড়তে মানুষকে বাধ্য করেছে।’  তাই, সংখ্যাধিক্য না ঘটলেও বাংলা কথাসাহিত্যের বিষয় হিসেবে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা, দুর্ভিক্ষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘‘ভালবাসা’’, ‘‘ছেলেমানুষি’’, ‘‘স্থানে ও স্তানে’’, সুবোধ ঘোষের ‘‘অযান্ত্রিক’’, ‘‘ফসিল’’, নরেন্দ্র মিত্রের ‘‘হেডমাষ্টার’’, ‘‘পালঙ্ক’’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘‘উর্বশী ও জনি’’, ‘‘সাঁঝ সকালের মা’’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘‘ইজ্জত’’, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘‘দখল’’, মনোজ বসুর ‘‘গান্ধিটুপি’’, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘‘কাফের’’, সমরেশ বসুর ‘‘আদাব’’, ‘‘পশারিণী’’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘‘গণনায়ক’’, ঋত্বিক ঘটকের ‘‘স্ফটিক পাত্র’’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের ‘‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী”, আবু রুশদের ‘‘হাড়’’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘‘ছুরি’’, ‘‘শিকড়’’, শওকত ওসমানের ‘‘আলিম মুয়াজ্জিন’’, ‘‘আখেরী সংক্রান্ত’’, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা’’, আবু ইসহাকের ‘‘বনমানুষ’’, ‘‘হারেম’’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘‘মানিকজোড়”, ‘‘আরো দুটি মৃত্যু’’, ‘‘মাছ’’ এবং হাসান আজিজুল হকের ‘‘উত্তর বসন্তে’’, ‘‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’’, ‘‘পরবাসী’’, ‘‘মারী’’, ‘‘খাঁচা’’, ‘‘একটি নির্জল কথা’’ ইত্যাদি গল্পের বিষয় দেশভাগ, দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ।

এছাড়া দেশভাগ ও দাঙ্গা বিষয়ক উপন্যাসের মধ্যে আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’, জীবনানন্দ দাশের ‘জলপাইহাটি’, অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘গড় শ্রীখণ্ড’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জীবন রহস্য’, শঙ্খ ঘোষের ‘সুপুরিবনের সারি’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকো’, গৌরকিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ ইত্যাদির নাম উচ্চারণ করা যায়।

দেশভাগ ও দাঙ্গা বিষয়ক গল্প-উপন্যাসের ধারায় হাসান আজিজুল হকের গল্প-উপন্যাস স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমিণ্ডত। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু সংকটের কালে হাসান আজিজুল হকের বালক বয়স, কিন্তু প্রত্যেকটি ঘটনা তাঁকে স্পর্শ করে গেছে। এই বেদনাময় স্মৃতি তাঁর শিল্পীসত্তায় চিরজাগরূক। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘দেশভাগ আমার জীবনের জন্য একটি ক্ষতস্বরূপ। ক্ষত সারলেও দাগ থেকে যায়। আমি এই দাগের কারণ অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি।’  বস্তুত, এই ব্যক্তিক ক্ষতের কারণেই হাসান আজিজুল হক বাস্তুচ্যুত মানুষের মর্মন্তুদ যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করতে পারেন। দেশভাগের প্রকৃত চিত্রকে কথাসাহিত্যের বিষয় করতে পারেন।

প্রকৃতপক্ষে, বাংলার খুব কম কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের মতো দেশত্যাগের প্রত্যক্ষ ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন, দেশত্যাগী উদ্বাস্তু মানুষের মিছিলে ছিলেন অথবা উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কষ্টকে অনুভব করেছিলেন। সেই সময়ে বাংলা সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র কলকাতায় স্থায়ীভাবে অবস্থান করছিলেন পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সন্তোষকুমার ঘোষ, বুদ্ধদেব বসু বা সমরেশ বসুর মতো কথাসাহিত্যিকরা। দেশভাগের প্রকৃত ক্ষতি তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেননি। তাঁরা দেশভাগের প্রকৃতচিত্র, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হঠকারিতা ইত্যাদি এড়িয়ে বাস্তবে যা ছিল না কিন্তু হলে ভালো হতো―হারানো শান্তি, সৌহার্দ্য, স্মৃতি, নস্টালজিয়ার বর্ণনায় মজে ছিলেন।  হাসান আজিজুল হকের পক্ষে দেশভাগের প্রকৃত বাস্তবকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। কারণ, এই বাস্তবের অংশ তিনি। তাই, দেশভাগ ও দাঙ্গা বিষয়ক তাঁর গল্প-উপন্যাস দেশভাগের সাহিত্যের অনন্য সম্পদ।

মধ্যরাঢ়ের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের উদ্বাস্তু জীবনের বাস্তব কাহিনি ‘সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য’ গ্রন্থের “উত্তর বসন্তে” গল্পটির বিষয়।  এই পরিবারটি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ফেলে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় পাকিস্তানে দেশান্তরিত হয়। পরিবারের সদস্যরা আত্মীয়-পরিজনহীন নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে আপন করে নিতে পারে না। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সুস্থভাবে জীবনধারণের কোনো উপায় খুঁজে পায় না। সন্তানাদি, অসুস্থ স্বামী, জঙ্গলের পরিত্যক্ত বাড়িকে ঘিরে বাড়ির কর্ত্রীর অশান্তির প্রলাপ ও অস্বস্তি প্রকাশের অন্তরালে শেকড়চ্যুতির কঠিন কষ্টের অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে।

দেশভাগ যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল এই নারীকে, যে সুখ-স্বপ্নের মোহে ছেলের হাত ধরে জন্মভূমি ছেড়েছিল, সেখানে জায়গা করে নিয়েছে অসীম নৈরাশ্য, হতাশা, অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস। বস্তুত, দেশভাগ তাদের উপহার দিয়েছে অবশ অবসাদ ও ভীষণ বীতশ্রদ্ধ একটি জীবন। জীর্ণ ন্যাকড়ার মতো ওড়ে তাদের জীবন। তাদের পরিচিত বা প্রিয় বলে কেউ নেই। বেঁচে থাকার স্বপ্ন নেই। এমন কি অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করা ছাড়া তাদের বেঁচে থাকার আর কোনো উপলক্ষ বা উদ্দেশ্যও নেই। পরিবারের প্রত্যেকেই মানসিক বৈকল্য ও ভারসাম্য হারিয়ে মনোবিকারগ্রস্ত। অন্ধকার ঘরের নির্জনে দিন-রাত পড়ে থাকেন অসুস্থ রুগ্ণ গৃহকর্তা। তার জীবনে দেশভাগ কি দুর্বিপাক উপহার দিয়েছে, মেয়ে বাণীর উচ্চারণেই তা স্পষ্ট হয়।

কি দিন কি রাতে ওর একটাও জানালা খোলেন না আব্বা। দিনের বেলাতেও মশারির ভিতর হাঁটুর মধ্যে মাথাগুঁজে পাথরের মত বসে থাকেন আব্বা আর মাঝে মাঝে দাঁত খিঁচিয়ে চিৎকার করে ওঠেন কারণে অকারণে। আব্বাকে ভাবতে গেলেই তাকে আর আলোর জীব বলে মনে হয় না। অস্পষ্ট অন্ধকারে তাকে যেন জীবন্ত বলেই মনে হয় না। 

রিফ্যুজি হয়ে অমর্যাদাশীল ও পরিত্যক্ত জীবনযাপনের চাপে বাড়ির কর্তা মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। নিজের অক্ষমতা নিয়ে অন্ধকার ঘরে দিনরাত কাটান। জীবনের স্পন্দন আছে কিন্তু প্রাণ নেই। শারীরিকভাবে বেঁচে আছেন বটে, কিন্তু বেঁচে থাকার নিষ্ঠুর দায় পালন করা ছাড়া আর তার কিছুই করার নেই। মুসলমানের দেশ পাকিস্তানে এসে এমন মানবেতর জীবনের সম্মুখীন হবেন, এই কথা সেদিনের হিন্দু-মুসলমানের কোনো নেতাই তাকে বলেননি। দেশভাগ করে তাকে দেশান্তরিত করার সকল ব্যবস্থা করেছে তার অমতে ও অজান্তে। তার কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। কারণ, কেউ কিছুই শুনবে না। যা ঘটার তাই ঘটবে। সবকিছুকেই নিয়তি বলে মেনে নিতে হবে। কিন্তু জীবনের এই প্রান্তিক মুহূর্তে অভ্যস্ত জীবনের পরিবর্তনও দুঃসাধ্য ও গ্লানিকর।

কেন এবং কার জন্যে তাদের এই দুর্গতি সেই রাজনৈতিক জিজ্ঞাসার উত্তর তাদের অজানা নেই। নির্বাক্যে মেনে নেওয়াটাই তাদের নিয়তি। ‘বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের ‘‘একটি নির্জল কথা’’ গল্পের দেশান্তরিত মা দেশভাগকে প্রত্যাখ্যান করেন, কিন্তু দেশ ছাড়ার নিয়তিকে এড়াতে পারেননি।
ছেলেদের কাছে শুদোই ক্যানে আমাকে ই ভিন্ দ্যাশে লিয়ে আনলি। ই দ্যাশ ই দ্যাশের লোকদের লেগে ভালো―আমাকে ক্যানে লিয়ে এলি! কুন দোজখিরা দ্যাশ ভেঙেছে, তাতে আমার কি? ... আমার মাটিটো ক্যানে কেড়ে লিবি? আমার পুকুর ঘাটটো, মাঠটো, বাগান টো ক্যানে লিবি? আমার চাঁদ-সুরুজ ক্যানে লোকে কেড়ে লেবে?  

বস্তুত, এই জিজ্ঞাসা দেশান্তরিত প্রত্যেক মানুষের জিজ্ঞাসা। কেন দেশভাগ আর কেন তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে, এই জিজ্ঞাসার সদুত্তর কেউ দেয়নি। যে দেশ ও বন্ধু-প্রতিবেশীকে ছেড়ে যাচ্ছে তাকে শত্রু বা পর ভাবার, অথবা যে দেশে যাচ্ছে সে দেশকে বা সে দেশের মানুষদের বন্ধু বা আপন ভাবার কোনো কারণ তাঁরা খুঁজে পায়নি। লেখকের জিজ্ঞাসা,
বাংলার শ্রমিক, কৃষক, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমোর যে কোনো সাধারণ মানুষ অসহ্য তালুজ্বালা ক্রোধে জিজ্ঞেস করতে পারে কেন দেশভাগ? জিন্নাহ সাহেবের মুসলিম লীগের জমিদার সামন্ত আয়মাদার আশরাফদের প্রয়োজন হতে পারে, প্যাটেল সাহেবদের হিন্দুরাজের প্রয়োজন হতে পারে, তার জন্যে পাঞ্জাব কাটা, বাংলা ভাঙা জরুরি হতে পারে―কিন্তু রাঢ়ের কোন্ মুসলমান কেন পাকিস্তান যাবে, হাজার হাজার লাখ লাখ হিন্দু কেন ছেড়ে আসবে বাংলাদেশ? 

দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন যারা, তাদের বাধ্য হওয়াটা ছিল সম্পূর্ণ শারীরিক ব্যাপার, মনোজগতে তারা কখনো জন্মভূমির অধিকার ছাড়েননি। অগ্রন্থিত গল্প ‘‘দিবাস্বপ্ন’’-এর করিম বখশ তার দীর্ঘজীবনের শেষভাগে দেশত্যাগ করে ভয়ানক বিপদের মুখোমুখি। দৃষ্টিশক্তি ফুরিয়ে এসেছে, কিন্তু তার মনশ্চক্ষু জেগে থাকে বাস্তুভিটায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের যুবকের মতো রহিম বখশ পুরানা শীতের কাপড় ও মাথায় পশমি টুপি পরে অপেক্ষা করে স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশের জন্য। এই স্বপ্নরাজ্য তার বাস্তুভিটা, ছেড়ে আসা জন্মভূমির মাঠ-ঘাট, কৃষিক্ষেত, শস্যক্ষেত, নানা গাছগাছালি। স্বপ্নে সে ফিরে যায় বাল্যকালে, যে বাল্যকাল তার দেশের মতো সমান দূরে অবস্থিত। গ্রামের শীতের সন্ধ্যা, নতুন ধানের স্তূপ, বৃত্তাকারে বসা কৃষক, সাঁওতাল মেয়ে-পুরুষ ইত্যাদি বিচিত্র সব দৃশ্য রহিম বখশকে মোহমুগ্ধ করে রাখে। এভাবে তার দিন কাটে। রহিম বখশের এই নস্টালজিয়ার জাগরণ একান্তই তার সম্পদ। এই সম্পদের শেয়ার নাতিকে বলতে দেবার চেষ্টা করে কিন্তু বাকহীন জন্তুর অস্ফুষ্ট আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দই বের হয় না মুখ দিয়ে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে দেশান্তরিত হতে হয়েছে বলে রহিম বখশের যন্ত্রণার মানচিত্রও বিস্তৃত। অবশিষ্ট দিনগুলোতে বেঁচে থাকার রসদ তার পেছনের জীবন। সেই জীবনের বাইরে এসে বাঁচার সময় তার ফুরিয়ে এসেছে। দেশ নতুন, কিন্তু রহিম বখশের নতুন করে শুরু করার সুযোগ নেই।

হাসান আজিজুল হকের ��আত্মজা ও একটি করবী গাছ” শুধু তাঁর গল্পে নয়, বাংলা সাহিত্যের সমস্ত দেশভাগের গল্পের মধ্যে বিশিষ্টতার দাবিদার। দেশত্যাগী মানুষের মর্মঘাতী যন্ত্রণার তীব্রতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে এ গল্পে। একটি জাতির ভাঙনের ইতিহাস ও তার বেদনাবহ পরিণতিকে হাসান আজিজুল হক অসাধারণ দক্ষতায় মূর্ত করে উপস্থাপন করেন। গল্পের কেশো-বুড়ো বিপন্নলাঞ্ছিত ভাগ্যাহত মানুষের প্রতীক। আর করবী গাছ হচ্ছে তার আত্মজার প্রতীক। আত্মজাও তার কাছে বিষবৃক্ষের বীজ।  তার ভেতর-বাইরে মরণঘাতী নিষাদ। তার কথায়, ‘দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর বাইরে নেই। সব এক হয়ে গেছে।’ 

গল্পের সূচনায় ডাকু শেয়ালের মুখে মুরগির চিত্রকল্পে শেয়ালটি পকেটমার ফেকু, নাপিত সুহাস ও বেকার ইনামের প্রতীক চরিত্র। আর ওদের শিকার উদ্বাস্তু পিতার কিশোরী কন্যা রুকু হচ্ছে ডানা ঝামড়ানো অসহায় মুরগির প্রতীক। তিন বখাটের নৈশ অভিসারের বৃত্তান্তের সূত্রে লেখক সমসাময়িক অস্থির-বিশৃঙ্খল সময়কে উপস্থাপন করেন। ওদের কথাবার্তা আপাত খাপছাড়া কিন্তু গল্পকার প্রত্যেকটি কাটা কাটা বাক্য ও শব্দের ব্যবহার করেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। সুহাসের ছোট মামার বিয়ের গল্প, ফেকুর পকেটমারার গল্প, আর ইনামের স্কুল ত্যাগের গল্প―এই তিনটি গল্প মিলে একটি গল্প তৈরি হয়। কোনো গল্পের শুরু বা শেষ নেই। খাপছাড়াভাবে কিছু বলা হয়, আবার অন্যটায় চলে যায়। কারো গল্পের দিকে কেউ মনোযোগ দেয় না, বরং বিরক্তিই প্রকাশ করে। কে কখন কোন গল্পটা শুরু করে, এক বাক্য বা দুই বাক্যের পরে কেটে গিয়ে আবার অন্য গল্প শুরু হয়, সেটি ধরার জন্য ভীষণ সতর্ক থাকতে হয় পাঠককে। বাস্তবে, এই তিন বখাটের বিক্ষিপ্ত, অসংলগ্ন ও অসম্পূর্ণ কথোপকথনের মধ্য দিয়ে লেখক দেশভাগোত্তর জীবনধারার অসঙ্গতি ও বিচ্ছিন্নতাকে তুলে ধরেন। সমাজের তলদেশ থেকে উঠে আসে তিন বখাটের গল্প। সুহাসের মামার বিয়ের ম্যারাথন গল্প শুনে চরম বিরক্ত ইনাম এক ফাঁকে বলেছে, ‘তোর ছোট মামা বিয়ে করতি গিলো ক্যানো ক তো?’ (পৃ. ১৩) অর্থাৎ যে সমাজব্যস্থাপনায় দুই টাকায় কিশোর মেয়ের দেহভোগের স্বীকৃত পন্থা আছে, সেখানে বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধনের ঝামেলা বা দায় নেবার দরকার কি? স্বাধীন দেশে অবাধ লাম্পট্য ও নারীর যথেচ্ছ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নৈতিকতা বিবর্জিত এক প্রজন্মের নির্বিঘ্নে বিস্তৃতি ঘটছে। যে দেশটির প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি আবার ধর্ম। ফেকুর পকেট মারার গল্প ও ইনামের স্কুল ত্যাগের গল্প ব্যর্থ রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত।
করবটা কি কতি পারিস? লেহ্পাড়া শিকলি না হয়―। লেহাপড়ার মুহি পেচ্ছাব―ইনাম বলল। আবার অসহ্য লাগল ওর। তাহলি―ফেকু ভেবে চিন্তে বলল, উঁচো জায়গায় দাঁড়ায়ে সবির উপর পেচ্ছাব। কাম কোয়ানে? জমি নেই, খাঁটি ট্যাহা নেই ব্যবসা করি―কি কলাডা করবানে? (পৃ. ১৫)

তিন বখাটের গল্প যেখানে শেষ, সেখান থেকে শুরু হয় আর একটি গল্পের। ওরা জানালার রড ধরে দাঁড়াতেই বেরিয়ে আসেন এক পিতা। সৌজন্য, সম্ভ্রম সব রক্ষা করেই একটা রফা হয়। জেগে থাকার কৈফিয়ত বখাটেরা চায় না, কারণ ওরা জানে বৃদ্ধ তাদের জন্যই অপেক্ষা করছে, তারপরেও একটা কৈফিয়ত দাঁড় করাতে হয়। মেয়েকে বখাটেদের হাতে তুলে দিয়েই শুরু হয় এই পিতার নিষ্ঠুর অভিনয়। আত্মপ্রবঞ্চনামূলক এই অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে হাঁপানির কাশি ও শ্লেষা এসে পিতার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে চায়, কিন্তু গল্প বলার নিয়তি থেকে তার মুক্তি নেই। গল্প তাকে বলতেই হবে। পৃথিবীর চোখে পরাস্ত হলেও নিজের কাছে অজেয় থাকার দৃঢ় প্রত্যয়ী পিতা নৈতিকতার কৃত্রিম অহংকার বা আবরণ তৈরি করে মিথ্যার মোড়কে।  পাশের ঘরে ফেকু-সুহাস মেয়ের শরীর নিয়ে তৈরি করে নতুন গল্প, সেই গল্পের মরণচিৎকার ও উল্লাসের ফাঁকে আর একটি গল্পের ফাঁদ পাতেন মেয়ের পিতা―একটি করবী গাছের গল্প।

আমি যখন এখানে এলাম―আমি প্রথমে একটা করবী গাছ লাগাই...তখন হু হু করে কে কেঁদে উঠল, চুড়ির শব্দ এলো, এলোমেলো শাড়ির শব্দ আর ইনামের অনুভবে ফুটে উঠল নিটোল সোনারঙের দেহ- সুহাস হাসছে হি হি হি―আমি একটা করবী গাছ লাগাই বুঝলে? বলে থামল বুড়ো, কান্না শুনল, হাসি শুনল, ফুলের জন্য নয়, বুড়ো বলল, বিচির জন্যে, বুঝেছ, করবী ফুলের বিচির জন্যে। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে। আবার হু হু করে ফোঁপানি এলো আর এই কথা বলে গল্প শেষ না করতেই পানিতে ডুবে যেতে, ভেসে যেতে থাকল বুড়োর মুখ- প্রথমে একটা করবী গাছ লাগাই বুঝেছ আর ইনাম তেতো তেতো―এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? (পৃ. ১৯)

দুই টাকা দিতে পারেনি বলে চরম উত্তেজনা ও বিরক্তি নিয়ে গল্প শোনে ইনাম। মেয়ে ও পিতার বেদনার প্রতি তার কোনো প্রকার সহানুভূতি বা বিকার নেই। বরং প্রচ্ছন্ন উপহাস আছে।
অনাকাঙ্ক্ষিত দেশভাগ পিতা ও মেয়ের জীবনকে দাঁড় করিয়েছে এক বিমূঢ় অভিজ্ঞতার সামনে। দেশভাগে তাদের কোনো হাত নেই, কাঙ্ক্ষিতও ছিল না। গল্পে রাজনীতির প্রসঙ্গ প্রচ্ছন্ন আবরণ মাত্র কিন্তু গল্পটি পড়া শেষে মনে হয় প্রবল রকমের একটি রাজনৈতিক গল্প। ব্যক্তি বিশেষ বা পরিবার বিশেষের হলেও দেশভাগের ফাঁদে পড়া সকল উদ্বাস্তু মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে গল্পের পাত্র-পাত্রীরা। এটি শুধু একটি করবী গাছের গল্প নয়, অসংখ্য উদ্বাস্তের প্রাঙ্গণের করবী গাছের গল্প। এই করবী গাছের বিষাক্ত বিষ ছড়িয়ে গেছে মানুষের মনে। এই বিষ সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বিদ্বেষ ও দাঙ্গা সৃষ্টি করে। একই গ্রন্থের “পরবাসী” গল্পের বশির ও ওয়াজদ্দির মতো নিরীহ সাধারণ মানুষ সেই বিদ্বেষ ও দাঙ্গার শিকার হয়।

দেশভাগের পরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটেনি। বরং, ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষেরা দেশভাগের রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে বলে তাদের কল্পনায়ও আসেনি যে, কলকাতার দাঙ্গা গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে বা তাদের সম্পৃক্ত করবে। দাঙ্গা গ্রামের দিকে আসছে, বশিরের এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে ওয়াজদ্দি বলে, ‘তোর বাপ কটো? এ্যা―কটো বাপ? মা কটো? একটো তো? দ্যাশও তেমনি একটো? বুইলি?’ (পৃ. ২৮)

জন্মদাতার মতো মানুষের জন্মভূমিও একটি―এই চিরন্তন সত্যটি দেশনেতাদের চিন্তায় লালন করার কথা ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই চিন্তা তারা করেননি ক্ষমতার অন্ধমোহে বা সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার কারণে। সেই চিন্তা লালন করে গ্রামের কৃষক ওয়াজদ্দি। এই উক্তির মধ্য দিয়ে দেশভাগকে সে প্রত্যাখ্যান করে। দেশের অখ-তায় বিশ্বাসী এই মানুষটিকেই প্রথম খুন করে হিন্দু দাঙ্গাবাজরা। সম্পূর্ণ অপরিচিত ও অসম্পর্কিত মানুষেরা কপালে সিঁদুর পরে অপ্রতিরোধ্য বেগে ছুটে আসে। গ্রামে আগুন ধরিয়ে আদিম প্রাগৈতিহাসিক তাণ্ডবলীলা চালায় এবং নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। এই আকস্মিক আক্রমণে পুড়ে ছাই হয়ে যায় বশিরের ঘর-বাড়ি, ঘরের ভেতরের দুইজন মানুষ।
বাড়িটা ততক্ষণে পুড়ে শেষ। ওরা চলে গেল। বল্লম দিয়ে মাটির সঙ্গে গাঁথা বশিরের সাত বছরের ছেলেটা। ছাব্বিশ বছরের একটি নারীদেহ কালো একখণ্ড পোড়া কাঠের মত পড়ে আছে ভাঙা দগ্ধ ঘরে। কাঁচা মাংস-পোড়ার উৎকট গন্ধে বাতাস ভারি।
আল্লা তু যি থাকিস মানুষের দ্যাহোটার মধ্যি- বুকফাটা চিৎকার করে উঠল বশির, কোতা, কোতা থাকিস তু, কুনখানে থাকিস বল। (পৃ. ২৯)

এভাবেই জাতিগত বিদ্বেষের শিকার হয় ওয়াজদ্দির মতো নিখাদ দেশপ্রেমী, বশিরের মতো সাধারণ কৃষক, বশিরের স্ত্রী-সন্তানের মতো নিরীহ অসহায় নারী ও শিশু। দেশভাগের বিষাক্ত ছোবলে টিকতে না পেরে যারা দেশান্তরি হয়েছিল তাদের “আত্মজা ও একটি করবী গাছ” গল্পের বৃদ্ধ পিতা ও কন্যার পরিণতির বরণ করে নিতে হয়। আবার, যারা দেশভাগকে অগ্রাহ্য করে বাস্তুভিটা আঁকড়ে থাকে তাদের বরণ করে নিতে হয় বশির-ওয়াজদ্দির নিয়তি।

দেশভাগ ও ক্ষমতার রাজনীতির কুটিল জটিল আবর্তের সাথে নিরীহ কৃষক বশিরের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু দেশভাগের রাজনীতির ঘৃণ্য পরিণতি তাকে আততায়ী বানিয়েছে। এই ঘটনার পরে ফেরারী বশির আশ্রয় নেয় পাকিস্তানের সীমান্তে। তার মৃত্যুচিহ্নিত দু’চোখে ওয়াজদ্দির তাজা রক্ত, বল্লম দিয়ে গাঁথা ছেলের লাশ, আগুনে দগ্ধ স্ত্রীর লাশের জীবন্ত ছবি। এই চোখ হঠাৎ আবিষ্কার করে খালের পুবদিকের উঁচু জায়গায় ধুতি পরিহিত এক হিন্দু পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশের জন্য দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত, পাকিস্তানে দাঙ্গায় বশিরের মতোই স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে মানুষটি ভারতে পালাতে যাচ্ছে। বশিরের ভেতরে জিঘাংসা জেগে ওঠে। পোড়া স্ত্রী, বল্লম গাঁথা পুত্রের উষ্ণ রক্তের ছটা, মৃত ওয়াজদ্দির তীব্র চাহনি বশিরের মগজে আলোড়িত হতে থাকলে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। সে নৃশংসভাবে হত্যা করে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটিকে। নিম্নশ্রেণির হওয়ায় তার ভেতরের যন্ত্রণা, ক্রোধ ও প্রতিশোধের নেশাকে কোনো ধরনের আবরণ দেবার চেষ্টা করেনি। তাই, সম্পূর্ণ অচেনা ও অসহায় একজন মানুষকে প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতা নিয়ে এভাবে পশুর মতো হত্যা করতে পারে। কিন্তু হত্যার পরে মৃত মানুষটির মুখে ওয়াজদ্দির মুখচ্ছবি ভেসে উঠলে এই সত্যোপলব্ধি ঘটে, যে রক্তপাত সে নিজে ঘটিয়েছে, আর যে রক্তপাতকে সে ছেড়ে এসেছে―এই দু’য়ের মধ্যে কোনো তফাত নেই। তফাত নেই যাকে খুন করেছে তার মুখ, আর ওয়াজদ্দির রক্তাক্ত মুখাবয়বে। তখনি বশিরের চোখে পানি নেমে আসে, যা তাকে দাঙ্গাপূর্ব নিরীহ বশিরে রূপান্তরিত করে। গল্পে রক্তপাত ও জাতি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অসাধারণ এক মানবিক আবেদন তৈরি হয়

দেশভাগের পরে যারা নিজেদের বসতভিটা আঁকড়ে ছিল তারা দ্বিমুখী দ্বান্দ্বিকতা ও অস্থিরতায় ভুগেছে―থাকলেও সংকট, গেলেও সংকট। হাসান আজিজুল হকের ‘জীবন ঘষে আগুন’ গ্রন্থের “খাঁচা” গল্পের অম্বুজাক্ষ বাস্তুভিটা ছেড়ে যাবার চাপা কষ্টকে আড়াল করে সেতারে করুণ সুর বাজিয়ে। তাকে পরাস্ত করে আত্মবিচ্ছেদের অস্থিরতা ও নতুন গন্তব্যের অনিশ্চয়তা। একটি মাত্র দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে সমূলে বিনাশের মতো মরণঘাতী চিন্তাও তার মনে উঁকি মারে একবার। এরইমধ্যে সাপের কামড়ে ছেলে অরুণের মৃত্যু হয়। বাস্তুভিটা ছেড়ে যেতে অনিচ্ছুক পিতা কালীপ্রসন্ন বিনা কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয় এবং ছেলের কাছে মর্মান্তিক আকুতি জানায়, ‘আমাকে মেরে ফেল্ বাবা, তোর পায়ে পড়ি, তোর ভাল হবে―আমি আশীর্বাদ করব তোকে।’  এ দুটি ঘটনায় অম্বুজাক্ষ দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। যেই মুহূর্তে তার এই সিদ্ধান্ত সেই মুহূর্তে তৈরি হয় নতুন এক সংকট। স্ত্রী সরোজিনী উন্মাদের মতো সেতারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলে। এমনকি অম্বুজাক্ষকে শারীরিকভাবে আঘাত করতে উদ্যত হয়। দেশত্যাগের মাধ্যমে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সামান্য যে প্রত্যাশা বা স্বপ্ন জেগেছিল, তার অপমৃত্যু ঘটেছে বলে সরোজিনীর এই উন্মাদনা। সরোজিনীর আক্রমণের মুখে অম্বুজাক্ষের ‘আমাকে নয়, আমি নই’ চিৎকার দেশভাগের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসে। (পৃ. ৫০)

যে ক্রোধ ও হাতাশায় সরোজিনীর এই বুকভাঙা আর্তনাদ ও উন্মাদনা, তার দায় অম্বুজাক্ষের নয়, দায় দেশভাগের স্বার্থান্ধ নেতাদের।

দেশভাগের পরে নিয়মিত দাঙ্গায় বিরাট জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হয়। এই উদ্বাস্তুদের চাপে সমাজে চরম মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। উদ্বাস্তু সংকট এতটাই প্রকট হয় যে, শেষ পর্যন্ত মহামারী ঠেকানো যায়নি। এই ভয়াবহ মহামারী আক্রান্ত মানুষের দুর্দশার চিত্রই ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গ্রন্থের “মারী” গল্পের বিষয়। স্কুল ঘরে আশ্রিতদের একের পর এক বমির শব্দে দুর্ভিক্ষের বীভৎসতা হানা দেয় পাঠকের মনেও। তবে, সরকারের প্রতারণামূলক ত্রাণ বিতরণ ও জনতার সামর্থ্যমাফিক এগিয়ে আসার বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের বিষয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ ও দেশান্তরিত মানুষের ইতিহাস। বাঙালির গৃহস্থঘরের এক নারী তার নিজের বর্গের ইতিহাস বর্ণনা করেন। এই সূত্রে একে একে বিশ্লেষণ করেন তার নিজের ব্যক্তিসত্তা, পরিবার, সমাজ, দেশ, সময় ও ইতিহাসকে। তার শারীরিক চলাচলের গণ্ডি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, কিন্তু তার চিন্তার ব্যাপ্তি, পরিস্থিতি অনুধাবন ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা অসাধারণ। নিজেই বর্ণনাকারী, তাই নামহীন থেকে গেছেন এই নারী। শুধু এই নারী নয়, উপন্যাসের প্রায় সমস্ত চরিত্রই নামহীন। এর মধ্যে দিয়ে সমাজ ও ইতিহাসের উত্থান-পতনের সমগ্র ইতিহাসকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন লেখক। এখানে ব্যক্তি অর্থ দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে যে কোনো একজন ব্যক্তি। একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি সম্প্রদায়, একটি দেশ, একটি জাতির ভাঙন-উত্থান-পতনের ইতিহাসকে আখ্যানে বেঁধে ফেলতে চেয়েছেন বলেই কোনো চরিত্রের নাম ব্যবহার করেননি। এতে লেখকের উদ্দেশ্যবাদিতাই একমাত্র কার্যকারণ নয়, যে সময় ও ইতিহাস উপন্যাসের বিষয়, সেই সময় ও ইতিহাসের ফাঁদে পড়া মানুষের স্বতন্ত্র সত্তা বা ‘আমিত্ব’ বলে অবশিষ্ট কিছু ছিল না।

‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের কথক নারী, বাড়ির কর্তা, কর্ত্রী ও অন্যান্য সদস্যের কেউ হাসান আজিজুল হকের জীবনবৃত্তের বাইরের নন। বস্তুত, মানবভাগ্যের চরমতম বিপর্যয়ের ইতিহাস লিখতে গিয়ে তাঁর নিজের দিকেই, বিশেষ করে নিজের অস্তিত্বের শিকড়ের দিকেই তাকিয়েছেন। তাঁর পিতা-মাতার মধ্যে দেশত্যাগের যে মর্মান্তিক যন্ত্রণা ও রক্তক্ষরণ দেখেছেন, সেই যাতনার ইতিহাস-ই লিখেছেন উপন্যাসের নির্মাণ-আঙ্গিকে। তাঁর মা সাতাশি বছরের দীর্ঘজীবনের অধিকারী ছিলেন। শেষের দিকে তাঁর মায়ের স্মৃতিভ্রম ঘটেছিল এবং মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছিল। এই সময়ে তিনি অবচেতন মনে কথায় কথায় রাঢ়ের ঘরগেরস্থির প্রসঙ্গ টেনে আনতেন। উপন্যাসের কথক চরিত্রটিকে তাঁর মায়ের প্রতিমূর্তি করে নির্মাণ করেন। 

বিশ শতকের প্রথম দশকের দিকে একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম গৃহস্থ পরিবারে হাসান আজিজুল হকের মায়ের জন্ম (১৯০০)। কথক চরিত্রের বর্ণনার শুরুটা ঠিক এই সময় থেকে, জন্মের বৃত্তান্ত দিয়ে। কিন্তু এই বর্ণনা শুধুমাত্র সাংসারিক ফিরিস্তি বা পারিবারিক বৃত্তান্তসর্বস্ব নয়। বর্ণনার ক্ষেত্র ক্রমশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। আট কি নয় বছর বয়সে কথকের মাতৃবিয়োগ, পিতার দ্বিতীয় বিবাহ, দাদির মৃত্যু ইত্যাদি দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে বিশ শতকের সূচনায় গ্রামবাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সৌহার্দ্যরে অপূর্ব সমন্বয় ঘটে। কথক নিজের শিক্ষা সম্পর্কে বলেন, ‘আমি কিন্তুক একদিনও পাঠশালে যাই নাই। বাপজি যেতে দেয় নাই। মেয়ে আমার পাঠশালে ল্যাখাপড়া শিখে কি করবে? খানিকটা বেয়াদপ হবে, মুখের ওপর কথা বলবে―এই তো?”  এতে আধুনিক শিক্ষা থেকে বাঙালি মুসলমানদের মুখ ফিরিয়ে নেবার ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটে। এছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থানও নির্ণীত হয়। সাধারণত, ঘর-সংসারের বাইরে, স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আদেশ ও মতামতের বাইরে নারীর নিজের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা স্বাধীনসত্তা ছিল না। কিন্তু উপন্যাসের এই নারী ধীরে ধীরে নিজেকে একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি স্বামীর কাছে বাংলা বানান করে পড়তে শিখেছেন। বঙ্গবাসী পত্রিকা পাঠ করে, কর্তার মুখে শুনে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলি অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন এবং তার নিজের সম্পৃক্ততা ও অবস্থান নির্ধারণ করেন।

ভারতবর্ষের পরাধীনতা ও খিলাফত আন্দোলন কথক নারীর সামনে নতুন এক জিজ্ঞাসাচিহ্ন নিয়ে উপস্থিত হয়। জিজ্ঞাসাচিহ্ন তৈরি হয় হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থচিন্তা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে ঘিরেও। তুরস্কের খলিফা পদ বাতিল হওয়ায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নৈতিক পথ রুদ্ধ হয় এবং তারা পরস্পর দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে। কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার (১৯২৬) মতো ভয়াবহ দাঙ্গাসহ এক বছরে ২৫টির মতো দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এই দাঙ্গা মফস্বল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সরকার দাঙ্গা দমনে যায়নি, বরং হিন্দু-মুসলমানের বিভেদকে আরো বাড়িয়ে তোলার জন্য নতুন নতুন ফাঁদ সন্ধানে ব্যস্ত ছিল। সরকারের ফাঁদ ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিদ্বেষের মধ্যেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আরো বেগবান হয়। গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন পূর্বের অসহযোগ আন্দোলনের চেয়েও দুর্বার হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, বাংলার পরিবেশ তখন ভয়ানক বিস্ফোরণমূলক। বিদেশি কাপড় বর্জন, মদের দোকানে পিকেটিং ছাড়াও কম্যুনিস্টরা ও বিপ্লবীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। বাংলায় আন্দোলন অগ্নিরূপ ধারণ করে।উপন্যাসের কথকের যে ছেলে শহরের স্কুলে পড়ে, এই আন্দোলনে সেও সম্পৃক্ত। এর মধ্য দিয়ে গ্রামের পরিবারটির সাথে ভারতবর্ষের রাজনীতির একটি প্রত্যক্ষ সংযোগ নির্দেশিত হয়। পুলিশের আক্রমণের শিকার ছেলে সান্নিকপাত জ্বরে মারা গেলে এই সংযোগ বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। আর, অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপকতা প্রতীয়মান হয় বাড়ির কর্তার কথায় :
ব্রিটিশদের রাজত্ব, বড়ো কঠিন শাসন মা! এই শাসন এখন দেশের লোকও মানতে চাইছে না―ঘর-সংসার বাপ-মা ভাই-বোন লেখাপড়া ছেড়ে দলে দলে সব বেরিয়ে আসছে―এরই মতোন খোকা সব, কিছুই মানছে না, কারুর বারণ শুনছে না, ঝাঁকে ঝাঁকে মরতে যাচ্ছে। কি এখন বলবে বলো দিকিন। আইন তো ছাড় কথা―এখানে বোমা ফাটাচ্ছে, ওখানে সায়েব মারছে আর যতো জেল হচ্ছে ফাঁসি হচ্ছে, তাতে তাদের রাগ আরো বাড়ছে। আগুন জ্বলছে দেশে, কি করা যাবে বলো? (পৃ. ৫৭)

বাড়ির কর্তা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার মধ্য দিয়ে গ্রাম্য রাজনীতি, ভারতবর্ষীয় রাজনীতি ও ব্রিটিশ শাসনের সাথে কথকের পরিবারের একটি নিবিড় সম্পৃক্তি তৈরি হয়। নব্বই শতাংশ হিন্দু জনবসতিতে একজন মুসলমানের নেতৃত্বে চলে আসা এবং নির্বাচিত হওয়া সাম্প্রদায়িক ঐক্যের একটি দৃষ্টান্ত। এছাড়া তখনো পর্যন্ত আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি জোরালো হয়ে ওঠেনি। অথবা যা হচ্ছে তা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক ও নেতৃত্বের পর্যায়ে এবং নির্বাচন কেন্দ্রিক। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। মুসলমানদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‌্যামেজ ম্যাকডোনাল্ডের ‘সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা’ ঘোষণা এবং এর আলোকে ভারত শাসন আইন পাশের যে কেন্দ্রীয় রাজনীতি, সেই রাজনীতির সাথে সাধারণ মানুষের বাস্তবে কোনো সম্পর্ক ছিল না, কর্তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার মধেই তার প্রমাণ। 
১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েও কংগ্রেস সরকার গঠন করেনি এবং ফজলুল হকের ‘কৃষক প্রজা পার্টি’কেও প্রার্থিত সমর্থন দেয়নি।  ফলে ফজলুল হক মুসলিম লীগ ও তপসিলীদের সহায়তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। ১৯৩৭-১৯৪০ সময়কালে ফজলুল হক ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিম লীগের জনসভা-কনফারেন্সে বক্তৃতায় এই মর্মে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন যে, হিন্দুপ্রধান প্রদেশে মুসলমানদের উপরে দুঃশাসনের প্রতিশোধ তিনি বাংলার হিন্দুদের উপরে চালাবেন।  এই সময়ে অবাঙালি নেতা জিন্না বাঙালির ভাগ্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এভাবেই বাংলা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে এবং এই রাজনীতি গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে (৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯) ভারতের রাজনীতিতে বহুমুখী মেরুকরণ ঘটে। ব্রিটিশ রাজ্যের অংশ হওয়ায় ভারতবর্ষ যুদ্ধের বাইরে থাকেনি। জনগণ বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সরকার ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়েছে। উপন্যাসের কথকের জীবনে এটি দ্বিতীয় যুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল চৌদ্দ, তবে, যুদ্ধের কোনো খবরই জানতেন না। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার অজান্তে তো নয়-ই, বরং পশ্চিমের দেশ থেকে যুদ্ধ ছুটে আসছে তাকে, তার পরিবার, তার গ্রাম ও দেশকে গ্রাস করে নিতে। স্বামীর মুখে শুনে ও ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা পাঠ করে জানতে পারেন, সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। আর এই যুদ্ধ ঢাল-তলোয়ারের সম্মুখ যুদ্ধ নয়, আধুনিক অস্ত্রের এই যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ, মানুষের ঘরবাড়ি মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই যুদ্ধে কে, কখন, কোথায় এবং কাকে আক্রমণ করবে, তাতে কত মানুষের প্রাণহানি হবে, তার কোনোকিছুই কারো জানা নেই। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে ঘুমিয়ে থাকলেও এই যুদ্ধের আওতার বাইরে যাবার উপায় নেই। মানবতাবিরোধী এই যুদ্ধের ভয়াবহতাকে কথক তার নিজের উপলব্ধিতে ধরার চেষ্টা করেন।

উড়োজাহাজ দিয়ে একটো-একটো বড়ো শহরে বোমা ফেলছে, কামান-বন্দুকের গুলি মারছে―আহা আহা, সব ভেঙে গুঁড়িয়ে যেচে, সমুদ্দুরেও আগুন লাগছে। কি ক্ষেতিই না হচে, কতো লোকই না মরছে! ইসবের হিসেব যি থাকচে না তা লয় কিন্তুক আমার মাথায় ঢুকছে না।...এই লেগে কাগজ পড়তে গেলেই বুকের মদ্যে খালি খাঁ খাঁ করে। হায় হায়, তামাম দুনিয়ার সব্বোনাশ হচে! (পৃ. ৮৫)

প্রকৃত যুদ্ধ ভারতবর্ষে হয়নি। কিন্তু যুদ্ধের অভিঘাত বিশ্বের যে কোনো অংশের চেয়ে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায় কম হয়নি। বার্মা দখলের পরে বাংলা দখলে আসছে জাপান, যে কোনো মুহূর্তে বোমা ফেলবে, এই গুজব ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের যুদ্ধ প্রস্তুতি, বিপুল যুদ্ধের সরঞ্জাম ও সৈন্যের উপস্থিতি এবং গ্রামে পর্যন্ত ক্যাম্প ফেলা; মাথার উপরে যুদ্ধবিমানের বিকট গর্জন ও এলোপাথাড়ি ডিগবাজি; রাস্তাঘাটে ভারী অস্ত্রসজ্জিত মেলিটারি বাহিনীর দানবীয় চলাচল এবং মানুষের বাড়ি-ঘরে ঢুকে গরু-ছাগল-মুরগি, চাল, এমনকি যুবতী মেয়ে পর্যন্ত টেনে বের করে নেওয়া―এসব ঘটনায় সর্বদা এবং সর্বত্রই আতঙ্ক আর মৃত্যুভয় কাজ করে। আতঙ্কিত কথক ভাবেন, ‘হঠাৎ ভয়ে আমার বুক হিম হয়ে গেল। এত সাজ সরঞ্জাম, এত আয়োজন তবু যুদ্ধের তো কিছুই নাই এ্যাকন! তাইলে য্যাকন দেশে আসবে ত্যাকন কি হবে?’ (পৃ. ৯২)

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সরকারের বিশাল বাহিনীর খাদ্যের যোগান দিতে গিয়ে গ্রাম-বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের (এপ্রিল, ১৯৪৩) সৃষ্টি হয়। খাদ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। সরকার দুর্ভিক্ষকে অস্বীকার করায়, ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশগুলো থেকে বাংলায় খাদ্য আমদানি বন্ধ থাকায়, কিছু অসৎ ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে পণ্য গুদামজাত করায় এবং চড়া দামে মিলিটারি বাহিনীর কাছে বিক্রি করায় চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সম্পূর্ণ বাইরে চলে যায়। এতে দুর্ভিক্ষ ভয়ঙ্কররূপ নেয় এবং প্রাণ হারায় আনুমানিক ৩০ লাখ মানুষ।  উপন্যাসের কথক যুদ্ধের মতো ধেয়ে আসা দুর্ভিক্ষকে নিবিড়ভাবে অবলোকন করেন। দেশীয় পণ্যের অতিরিক্ত দাম এবং তেল, নুন, কেরোসিন, চিনি, কাপড় ইত্যাদি আমদানি বন্ধ থাকার কারণে গ্রামের তিনটি মুদির দোকান-ই বন্ধ। স্বাভাবিকভাবেই দুর্ভিক্ষের প্রথম আঘাত হানে ভূমিহীন, শ্রমনির্ভর, দৈনন্দিন উপার্জননির্ভর দরিদ্র মানুষদের উপরে।

কর্মহীন, খাদ্যহীন অনাহারী বুভুক্ষু মানুষের মিছিল বেড়েই চলে। বোমার আতঙ্ক ভুলে গিয়ে খাদ্যের আতঙ্কে ভোগে মৃত্যু পরাকীর্ণ মানুষেরা। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ভূতের মতো কঙ্কালসার মানুষেরা উলঙ্গ শরীর নিয়ে রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাচ্ছে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।

যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের মধ্যেই বস্ত্রসংকট (১৯৪৪) বাংলার মানবিক বিপর্যয়কে আরো ভয়াবহ করে তোলে। মানব-ইতিহাসের এই জঘন্য অভিশাপ ডেকে আনে সেই মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরাই, যারা মানুষের খাদ্য গুদামজাত করে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে। সেইসাথে, সরকার দুর্ভিক্ষের মতো বস্ত্রসংকটকেও আমলে না নেওয়ায় সংকট আরো ভয়াবহ হয়। গ্রামের ছায়রাতুন বিবির যুবতী নাতনি কাপড়ের অভাবে ন্যাংটা হয়ে ঘরে বসে থাকে। পুরাতন কাপড় চুরির আতঙ্কে গ্রামের মানুষ ঘরে খিল দিয়ে শোয়। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ যে মানুষের মনুষ্যত্বকে টলাতে পারেনি, বস্ত্রসংকটে পড়ে সেই মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে। কথকের ভাষ্যে এই বাস্তবতার বর্ণনা,
আমি মেয়েমানুষ, তবু তাদের দিকে তাকাইতে পারতাম না। ময়লা চেকট ত্যানাকানি পরে আছে। তার ভেতর দিয়ে সব দেখা যেচে, কিছুই ঢাকা পড়ে নাই। তা ঢাকা পড়বেই বা কি? না খেয়ে খেয়ে দ্যাহে কিছু নাই, ঢাকা দিলেও যা, না দিলেও তাই। সবার আবার ত্যানাকানিও জোটে নাই। কেউ এক টুকরো পচা চট জড়িয়েছে বুকে। কাকে শরম করবে, কি করে শরম করবে? এ বাড়ি এ বাড়ি ঘুরে বেড়াইছে ভূতের মতোন, গাছপালার আড়ালে আড়ালে। জট পাকিয়ে আছে চুল, ডাইনির মতোন সেই চুল চুলকোতে চুলকোতে ছিঁড়ে ফেলছে। (পৃ. ১১৫)

চালের দাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি এবং গ্রামের রাস্তায় ক্ষুধার্ত মানুষের চলাফেরা দেখে কথক প্রথমেই অনুমান করেছিলেন, দুর্ভিক্ষের অভিশাপ থেকে তার অবস্থাবান পরিবারটিও রেহায় পাবে না। বলেছিলেন, ‘খুব ভয় লাগছে, খুব ভয় লাগছে।’ (পৃ. ১০১)
বাস্তবে তাই ঘটে। টানা সাতদিনের বর্ষণে মাঠের ফসল সব নষ্ট হয়ে গেলে তার পরিবারেও দুর্ভিক্ষের প্রভাব পড়ে। এছাড়া, যুদ্ধের পৃথিবীর ভাঙন আর অবিশ্বাসের ঢেউ লাগে তার পরিবারে। বাড়ির কর্তার কর্তৃত্ব খর্ব হয়। ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে নির্মমভাবে আঘাত করে একে অপরের মাথায়। ‘দুজনাই আবার উঠে দাঁড়াইল বটে কিন্তুক দুই ভাই লয়, ঠিক যেন একে আরেকের দুশমন। ’ (পৃ. ১২২)

এক বছরের মধ্যেই দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় পরিবারটি, কিন্তু যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ মানবিক সহানুভূতি, নির্ভরতা ও বিশ্বাসের বন্ধনে যে ফাটল তৈরি করেছে, সেই ফাটল আর জোড়া লাগেনি। তাই, একান্নবর্তী পরিবারটির ভাঙন ঠেকানো যায়নি। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ ব্যক্তিকে আত্মসুখসর্বস্ব স্বার্থপর হতে শিখিয়েছে, যেখানে তার বেঁচে থাকা ছাড়া সবকিছুই মূল্যহীন। সংসারের এই ভাঙনে বাড়ির বিধবা মেয়ে সংকটে পড়ে বেশি। একান্নবর্তী পরিবারের ভাইদের সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব ও মায়ের অনুপস্থিতিতে বাড়ির কর্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে যে নারী, সে এখন একা ও নিঃসঙ্গ হয়ে গেল।

যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের পরে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা ও আলাদা রাষ্ট্রের দাবি ছিল আরো ভয়াবহ ও মরণঘাতী। ১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গা (১৬-১৮ আগস্ট) এবং নোয়াখালীর দাঙ্গার (১০ অক্টোবর) নরহত্যার পৈশাচিকতা সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এই দাঙ্গা হিন্দু-মুসলমানের সতির ভিত্তি সম্পূর্ণ বিনাশ করে ফেলে। ‘দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বলে খ্যাত দাঙ্গায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পাঁচ হাজারের মতো মানুষ মারা গিয়েছিল এবং পনেরো হাজার মানুষ আহত ও গৃহচ্যুত হয়েছিল। দাঙ্গার ভয়াবহতা সম্পর্কে কথকের উপলব্ধি, ‘কলকাতার রাস্তায় ডেরেন দিয়ে কলকল করে মানুষের রক্ত বয়ে যেছে। মুসলমানের রক্ত, হিঁদুর রক্ত। আলাদা কিছু লয়, একই রক্ত। ঐ ডেরেনে হিঁদু-মুসলমান এক।’ (পৃ. ১৪৫)

নিতান্তই দরিদ্র পরিবার রায়দের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে সত্য কলকাতার দাঙ্গায় নিহত হলে গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গার আশঙ্কা। সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ও ক্ষমতার ভাগাভাগির বলি সাধারণ মানুষের প্রকৃত দুর্গতি কথক উপলব্ধি করেন সত্য’র মায়ের বেদনাবোধকে শেয়ার করতে গিয়ে। মায়ের যে বেদনা নিয়ে রায়গিন্নি মেঝেতে মুখগুঁজে গোঙাচ্ছে আর বিলাপ করছে, সেই শোক-তাপ-বেদনার সান্ত¡না দেবার ক্ষমতা তার নেই, এমনকি আল্লারও নেই। সহানুভূতি প্রকাশের জন্যে তার আসারটাই অর্থহীন। তারপরেও কেন এলেন এই আত্মজিজ্ঞাসা মধ্যে মানুষ হিসেবে তাঁর একটি অবস্থান নির্ণীত হয়। মানবিকতাবিরোধী জঘন্য পৈশাচিক আদিম নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে প্রত্যাখ্যান ও ঘৃণার প্রকাশ করা এবং মা হিসেবে আর এক মায়ের বেদনাকে বুক পেতে গ্রহণ করা জন্যেই আসা। একইভাবে, মুসলমানেরা ছেলের প্রাণসংহার ঘটিয়েছে জেনেও, এই মর্মান্তিক বেদনার মধ্যেই রায়গিন্নি কথক নারীকে সাদরে গ্রহণ করে।

‘আগুনপাখি’ উপন্যাস ও ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ আত্মজীবনীতে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা ও দেশভাগের রাজনীতির ভয়াবহতার চিত্র অভিন্ন। উপন্যাসের কথক নারীর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও দাঙ্গাবিরোধী অবস্থানের প্রতিফলন আত্মজীবনীর বালকের মধ্যেও দেখতে পাই। বস্তুত, হাসান আজিজুল হক উপন্যাসে পরিণত বয়স্কা মায়ের চোখে এবং আত্মজীবনীতে বালকের চোখে দাঙ্গা ও দেশভাগের ইতিহাস মূল্যায়ন করেন। কলকাতায় দাঙ্গা, দাঙ্গায় মুসলমানের হাতে গ্রামের নিরীহ ছেলে সত্য’র (আত্মজীবনীতে ‘লক্ষ্মী’) মৃত্যুর ঘটনা ও যুধ্যমান দুই সম্প্রদায়ের মুখোমুখি অবস্থান, এই রক্তারক্তির সাথে জড়িয়ে থাকা জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দেশভাগের উদ্দেশ্য নিয়ে দুই জনেই ভেতর-বাইরের অস্থির, মানসিকভাবে ক্ষতি-বিক্ষত ও ভীষণ প্রশ্নাকুল।

সম্প্রীতির এই বন্ধনকে ধ্বংস করে, দাঙ্গা বাঁধিয়ে, খুনোখুনির হিড়িক লাগিয়ে যারা মহাযুদ্ধ বাঁধিয়েছে, তাদের রাজনৈতিক মতলব সম্পর্কে কথকের তেমন কোনো ধারণা নেই। তবে, তাঁর এই সহজ উপলব্ধি ঘটে যে, বিভেদ সৃষ্টিকারীরা একে অপরের খুনে শত্রু করে, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে মানুষের বিশ্বাস, মানবিকতা ও সভ্যতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। মানুষের বিশ্বাস ও সভ্যতার এই অপমানে কথকের ভেতরে যে ক্রোধ, ঘৃণা, জিজ্ঞাসা, বুকভাঙা বেদনা ও কান্না জমে ওঠে, সেখানে সে একা ও নিঃসঙ্গ। সাম্প্রদায়িকতার বিষ তার গ্রাম, এমনকি তার পরিবারের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। তার দেবরেরা ‘লড়কে ল্যাঙ্গে পাকিস্তান’ নিয়ে মেতে উঠেছে। গ্রামের হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের প্রতীক বাড়ির কর্তা এখন নিস্প্রভ ও নিশ্চুপ। তার এখন কিছুই করার নেই। বরং গ্রামের হিন্দু দাঙ্গাবাজরা তাকেই খুন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বস্তুত, যে আগুন লেগেছে এবং যেভাবে সারাদেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে, গ্রামের এই কর্তা কেন, হিন্দু-মুসলমানের যে নেতারা আগুন নিয়ে খেলা শুরু করেছিলেন, সেই নেতাদেরও আর সাধ্য নেই এই আগুন নেভানোর।
ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানকে স্থায়ী শত্রু বানিয়ে দেশভাগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে যে রাজনৈতিক নেতারা―জিন্না, নেহেরু, প্যাটেল প্রমুখ―তাঁদের উপরে অসীম ক্রোধ ও ঘৃণা বাড়ির কর্তার। তার মতে জিন্নার ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ আরূঢ় প্রতারণা এবং ক্ষমতার লিপ্সা পূরণের হাতিয়ার মাত্র। ভারতবর্ষের দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে জিন্না প্রায় নিশ্চুপ ছিলেন এবং নিজেকে ক্ষমতাবান করার জন্য নানা ধরনের ফাঁদ পেতেছিলেন। দেশ স্বাধীনের কাছাকাছি সময়ে তিনি নতুন এক ফর্মুলা দিয়ে অখ- দেশ ও জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করে চিরস্থায়ী সংঘাত ও বিভেদের দিকে ঠেলে দেন। এমনকি, শেষ মুহূর্তের বৃহৎ আন্দোলন ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২)’ থেকে মুসলমানদের বিরত রাখার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে স্তিমিত করে দিয়েছিলেন।  উপন্যাসের কর্তা বলেন, ‘এই জিন্না লোকটা একটা দিন জেল খাটলে না, একটা দিন উপোষ করলে না গান্ধির মতো, মুসলমানের কিছুই নাই তার, জামাকাপড় আগে পড়ত সাহেবদের মতো, এখন মুসলমানদের নেতা হয়েছে, সেরওয়ানি পরে, মাথায় পরে তার নিজের কায়দার টুপি।’ (পৃ. ১৩৫)

জিন্না ছাড়া বল্লভভাই প্যাটেল ও কংগ্রেসের অন্যান্য যে নেতারা দেশভাগের জন্য মরিয়া ছিলেন তাদের উপরেও কর্তার ভয়ানক ক্রোধ। দেশভাগের এই ট্রাজেডি নিয়তি নির্ধারিত প্রাচীন গ্রিক ট্রাজেডি নয়, জিন্না-প্যাটেলদের রাজনৈতিক ভুল ও স্বার্থের টানাপোড়নের কারণে সৃষ্ট শেক্সপীরিয়ান ট্রাজেডি।  শতবছরের উপরে প্রত্যক্ষ আন্দোলন, বিপুল জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ের বিনিময়ে আসে স্বাধীনতা, কিন্তু স্বাধীনতার আনন্দের পর��বর্তে ক্রোধ, বিষাদ আর আতঙ্কের মহাঅন্ধকারে তলিয়ে যেতে শুরু করে দুই দেশের মানুষ।

উপন্যাসের কথকের কাছে দেশভাগের প্রহসন ও গোঁজামিল অবিদিত থাকে না। বরং তার এই উপলব্ধি ঘটে যে, দেশভাগের নামে ‘সারা দ্যাশের মানুষ নিয়ে তামাশা করেছে’। (পৃ. ১৪৮) তার আশঙ্কা ও ভয়ের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে দুই বছরের মধ্যেই। দুই দেশেই হিন্দু-মুসলমান আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে, একপক্ষ অন্যপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে চলে অবাধ নিধনযজ্ঞ। ফলে, দেশভাগের পরেও যারা নিজ দেশে থাকার দৃঢ় সংকল্প নিয়েছিলেন, দেশভাগকে অস্বীকার করেছিলেন, তাদের বিরাট অংশের দেশত্যাগ না করে উপায় ছিল না। দাঙ্গা ও দাঙ্গা-উত্তর বিপর্যয়ের ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা পূর্বের কলকাতা-নোয়াখালীর দাঙ্গার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। কথক জানান,
আবার ভয়ানক মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়েছে। বাড়ি বাড়ি লুট হচে, সোনা-দানা ধনসোম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মানুষকে ভিটে-মাটি ছাড়া করেছে। শহরে গঞ্জে টেরেনে, ইস্টিমারে মানুষ মেরে মেরে গাদা করছে আর হাজারে হাজারে মানুষ ই দ্যাশ থেকে উ দ্যাশে যেছে, উ দ্যাশ থেকে ই দ্যাশে আসছে। ই দ্যাশ থেকে কজনা যেছে জানি না, উ দ্যাশ থেকে লিকিন বেসুমার মানুষ সব্বস্ব হারিয়ে ইখানে এসে হাজির হচে। কলকাতায় ইস্টিশানে ইস্টিশানে লিকিন মানুষের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নাই। আকালের সোময় যতো লোক গিয়েছিল কলকাতায়, এ্যাকন তার চেয়ে অ্যানেক বেশি মানুষ সিখানে গিজগিজ করছে। (পৃ. ১৪৯)

কথক মুসলমান হওয়ায় তার জন্য ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে দেশান্তরিত হওয়া ভবিতব্য ছিল। কিন্তু তিনি দেশভাগের রাজনীতিকে এবং এর ভিত্তিতে আগত ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে প্রত্যাখ্যান করেন। নিছক আবেগ বা একগুঁয়েমির বশে নয়, অথবা প্রত্যাখ্যানের জন্য প্রত্যাখ্যান নয়, তিনি কয়েকটি জিজ্ঞাসার উত্তর জানতে চেয়েছেন। স্বামী ও সন্তানদের কাছে জানতে চাইলেও তার এই সমস্ত জিজ্ঞাসা মূলত দেশভাগের কুশীলবদের কাছেই। ‘আমি ক্যানে আমার বাড়ি, আমার দ্যাশ ছাড়ব?’―এই জিজ্ঞাসার মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করিয়ে কথক দেশভাগ ও দেশত্যাগের বিপক্ষে নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করেন। (পৃ. ১৫৭)

প্রথমত; ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ সঠিক হয়েছে কি না? যদি ধর্ম-ই একটি দেশের ভিত্তি হয়, তবে একই মুসলমানের এত দেশ কেন? ধর্ম আর জাতিসত্তা কখনো এক হয় নাকি? একই ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূ-প্রকৃতি, গাছগাছালি, ফসলি জমি, সর্বোপরি একই জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে শুধু ধর্মের জন্য আলাদা রাষ্ট্র কী করে সম্ভব? তবে তো পৃথিবীর কোনো দেশেই মানুষ বাস করতে পারত না।

দ্বিতীয়ত; ভারতবর্ষের মতো ভৌগোলিক সীমানার ও বহুধর্মের দেশে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ বাস্তবসম্মত ছিল কি না? আর ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পরেও পাকিস্তানে কেন কোটি কোটি হিন্দু, আর ভারতে কেন কোটি কোটি মুসলমানের বসবাস থেকেই যাচ্ছে? তাহলে পাকিস্তান মুসলমানের দেশ আর ভারত হিন্দুর দেশ কিভাবে হয়?

তৃতীয়ত; স্বামী-সন্তানেরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে তাকে কেন নিজের দেশ ও বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে? তার নিজের ভাষায় ‘আমাকে আরো বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকে সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো এক মানুষ লয়, আলাদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ কিন্তুক আলাদা মানুষ।’ (পৃ. ১৫৮)

সন্তানেরা সবাই পাকিস্তানে চলে গেছে, ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনিদের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও দেশ না ছাড়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার অনুরোধ করেন কর্তা। এবার তার যুক্তি, চিরকাল সন্তানের মুখে দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, এখন সন্তানেরাই বরং তার মুখের দিকে তাকাক। শেষে কর্তা প্রলুব্ধ করেন এই বলে―নতুন দেশে জীবন নতুনভাবে শুরু হবে, নিশ্চিন্তে জীবন কাটবে, সব হবে। এবার তার যুক্তি আরো কঠিন ও অলঙ্ঘনীয়―‘ঐ লোভ আমাকে তুমি আর দেখিয়ো না। চারাগাছ এক জায়গা থেকে আর জায়গায় লাগাইলে হয়, এক দ্যাশ থেকে আর দ্যাশে লাগাইলেও বোধায় হয়, কিন্তু গাছ বুড়িয়ে গেলে কিছুতেই ভিন্ মাটিতে বাঁচে না।’ (পৃ. ১৫৪)

নারীর এমন দাঙ্গা, যুদ্ধ ও রক্তপাতবিরোধী উপলব্ধি ও অবস্থান বাংলা সাহিত্যে কেন, বিশ্বসাহিত্যেও দুর্লভ দৃষ্টান্ত। এই নারী অখণ্ড ভারতমাতার প্রতীক। তার ‘আমিত্ব’ ও ‘ব্যক্তিত্ব’কে লেখক এমন একটি শক্ত জমিনে প্রতিষ্ঠিত করেন, যেখানে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, সংস্কার সবকিছুই তার বাধ্যগত। তিনি ইচ্ছেমতো গ্রহণ, প্রত্যাখ্যান, ভাঙচুর, নির্মাণের অধিকারী হয়ে ওঠেন। এই শক্তির জোরেই দেশভাগকে প্রত্যাখ্যান করেন, যুদ্ধ ও দাঙ্গাবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন, স্বামী-সন্তানেরা দেশত্যাগ করলেও একাই থেকে যান। দেশভাগ ব্যক্তির মনে যে ভয়, ত্রাস, একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নবোধ, শূন্যতাবোধ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে তাকে জয় করেন এবং অনাগত ভবিষ্যতের জন্য নতুনভাবে ইতিহাস নির্মাণের প্রত্যয়জাত অঙ্গীকার ঘোষণা করেন, ‘সকাল হোক, আলো ফুটুক, ত্যাকন পুবদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি।’ (পৃ. ১৫৮)

হাসান আজিজুল হকের ক্ষুদ্রায়তনের উপন্যাস ‘শিউলি’তে পশ্চিমবাংলার বর্ধমান থেকে পূর্ব বাংলার দিনাজপুরে স্থানান্তরিত একটি শিক্ষিত পরিবারের বৃত্তান্ত ঠাঁই পেয়েছে। দেশভাগ মানুষের মানবিক সম্পর্ক ও আকাঙ্ক্ষাকে কিভাবে আঘাত করে বিনষ্ট করে চিরজীবনের দীর্ঘশ্বাস উপহার দিয়েছে, ছত্রিশ বছর বয়সী অবিবাহিতা শিউলির জীবন-বিন্যাসের মধ্যে তার প্রতিফলন ঘটে। শিউলির অতীতচারী মনের গভীরে আলো ফেলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, দেশভাগ প্রশ্নে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের টানাপোড়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করেন লেখক। শিউলির ভাষ্য ‘একটা জটিল নাটক চালাচ্ছেন তখন দেশের হিন্দু-মুসলমান নেতারা―তাতে শরিক ব্রিটিশ সরকার―তাতে জড়িত রয়েছে অগণ্য জনসাধারণ, অসংখ্য মানুষের ভাগ্য, প্রাণ―সব জড়িয়ে আছে সেই নাটকে।’  দেশভাগের এই নাটকেরই একটি অংশ শিউলির মর্মান্তিক জীবননাট্য। বাড়ি থেকে বহুদূরে কলেজের অধ্যাপনা, শহরতলির জঙ্গল পরিবেশে অল্প ভাড়ায় বাড়ি নিয়ে বসবাস, ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়ার দায়িত্ব, বৃদ্ধ বাবা-মা ও ছোট ভাইবোনের খোরাকির জন্য বেতনের একটি অংশ পাঠিয়ে দেবার মতো কঠিন কর্তব্যকর্ম পালন করে শিউলি। এই কর্তব্যভার তাকে চাপিয়ে দিয়েছে দেশভাগ। বর্ধমানে বাবার কেরানির চাকুরি দিয়ে সংসার চলে যেত। কিন্তু দেশান্তরি হয়ে আসা বিদেশে বাবা সম্পূর্ণ বেকার। বাবা, মা, ছোট ছোট ভাইবোনের সমস্ত দায়িত্বভার এখন শিউলির একার। জীবনের এই কঠিন দায়িত্বভার পালন করতে গিয়ে ঘর-বর-সন্তান-সংসারের সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে। বাবা-মার মৃত্যু এবং ভাইবোনের লেখাপড়া শেষে সাবলম্বী হয়ে উঠার আগে পর্যন্ত শিউলির এই দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি নেই। কিন্তু ততদিনে তার জীবনের আকাঙ্ক্ষাগুলোও মরে যাবে। সে তখন আরো একা হয়ে যাবে। তার মনে গভীর দীর্ঘশ্বাস বাসা বাঁধে।

ততদিনে সম্ভবত শিউলি গাছটা মরে যাবে, বেঁচে থাকলেও শরতের সন্ধ্যার বাতাস শিউলির গন্ধে ভারি হয়ে উঠবে না। লেবু গাছটাও মরে যাবে। একটা জীবন উল্টোপাল্টা হয়ে গেলে কি আর নতুন করে আরম্ভ করা যায়! জীবনটা একদম ছোট কিনা। (পৃ. ১৬)

জীবনধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শিউলি নিজের সঙ্গে কঠিন এক লড়ায়ে লিপ্ত হয়। নিজের বর্তমানের সামনে দাঁড়াবার শক্তি খুঁজে পায় না। বর্ধমানের জীবনের স্মৃতি, প্রেমিকের চিঠি এসব এখন শিউলির বেঁচে থাকার আশ্রয়―যার সঙ্গে বর্তমান জীবনের আর যোগ নেই। অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন, মুমূর্ষু একটি বর্তমান তাকে উপহার দিয়েছে দেশভাগ। সমস্ত অতীতটাকে পুড়িয়েও নতুন একটি বর্তমান তৈরি সম্ভব না। শিউলির বাইরের পৃথিবী কোনো রকমে টিকে থাকলেও ভেতরের পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা ও নিঃসঙ্গ। তার বর্তমান অস্তিত্ব আত্মপ্রবঞ্চনার নামান্তর। অপূর্ণতা ও শূন্যতার নিদারুণ এক কান্না তার বুক জুড়ে―এভাবেই অতীতের দিকে তাকিয়ে নিঃশেষ হবে জীবন। একটি মুহূর্তের বা একদিনের জন্য হলেও শিউলি মুক্তি দাবি করে―“আমি একটু মুক্তি চাই, একদিনের জন্যে হলেও আমি মুক্তি চাই। আমি কি মুক্তি পেতে পারি না, আমাকে কি কিছুই আশা করতে নেই।” (পৃ. ৪৩)
বস্তুত, দেশভাগের কুশীলবরা, যারা শিউলির জীবনাট্যের নিয়ন্ত্রক ছিলেন, তারা শিউলির মুক্তির এই আকাক্সক্ষাকে চিরদিনের জন্যে হত্যা করেছে। শিউলির বর্তমান নেই, নতুন জীবন গড়ে উঠেনি বা আর ওঠার সম্ভাবনাও নেই। শিউলির মতো দেশান্তরিত প্রত্যেক মানুষ তার জীবন ফেলে এসেছে, তার পৃথিবী ফেলে এসেছে, কিন্তু নতুন জীবন বা পৃথিবী পায়নি।
দেশভাগে হাসান আজিজুল হকের ব্যক্তিজীবনে চিরকালের একটি ক্ষত। দেশভাগ ও দাঙ্গা নিয়ে লেখা তাঁর প্রত্যেকটি গল্প-উপন্যাস প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অংশবিশেষ। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দেশভাগের সার্বিকতাকে স্পর্শ করে। ক্ষমতালোভী অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক নেতাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে যে দেশভাগ, তা বাঙালির জাতীয় জীবনে নতুন এক উপনিবেশ তৈরি করে। এই উপনিবেশের প্রতীক বৃদ্ধের প্রাঙ্গণের করবী গাছ। এই গাছের বিষছায়া ক্রমশ বিস্তৃতি ঘটেই চলছে। সাধারণ মানুষকে বাধ্য হয়ে সক্রেটিসের হেমলকের মতো বিষবৃক্ষের বিষ গলাধঃকরণ করতে হচ্ছে। হাসান আজিজুল হকের দেশভাগের গল্পের চরিত্ররা অতি সাধারণ মানুষ, যাদের জন্যে স্বাধীনতা তারাই তাঁর গল্পের কুশীলব।