ছবি সংগৃহীত

হাওরে আফালের তাফালিং

Niazuddin Pasha
লেখক
প্রকাশিত: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ০৭:৫০
আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ০৭:৫০

সমুদ্র নয়, কিন্তু সমুদ্রের মতোই আদিগন্ত নীল দরিয়া, জলরাশি। নামটিও এসেছে সাগর শব্দের অপভ্রংশ সায়র থেকে। ভাটির দেশ বাংলাদেশ। হাওর এলাকাকে ভাটি এলাকাও বলা হয়। হাওর একটি বিশাল চ্যাপ্টা বেসিন, বাটির মতো। দেশের অন্য অঞ্চল হতে নিচু, সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা খুব একটা বেশি নয়। উজান হতে বর্ষায় নেমে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি এ বেসিনে জমে সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। প্রকৃতির বিচিত্র বৈশিষ্ট্য নিয়েই প্রতিবছর এখানে বর্ষা আসে, বর্ষা যায়। ‘আফাল’ তিনটি বর্ণের একটি শব্দ ! হাওরবাসীর কাছে টর্পেডো, ভীম ভাসমান মাইনের মতো ভীতিকর এর ফল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, ঘন ঘোর অমানিশা, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, ঝড়, অবিরাম বৃষ্টি, দমকা হাওয়া, ঝির-ঝির বৃষ্টির সাথে প্রচণ্ডবেগে প্রবহমান বাতাস। ফলে হাওরের জলরাশিতে সৃষ্টি হয় উথাল ‘চাঁন কপাইল্যা’ ঢেউ। এ পরিস্থিতিকে ‘গাদলা দিন’ বলে। ‘বাদলা দিন’ হতেই হয়ত ‘গাদলা দিন’-এর উদ্ভব হয়েছে। সৃষ্ট বড় বড় এ ঢেউকে ‘আফাল’ বলে। যা আছড়ে পড়ে দ্বীপসম গ্রামে, আঘাত করে একের পর এক। স্রোতের অনুকূলে উত্তরদিকের বাতাস বড়ই ভয়াবহ। এতে ঢেউ-এর ভাঙ্গনের গতি. ক্ষমতা ও তীব্রতা অনেক বেশি থাকে। ‘আফাল’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলেই এর ভয়াবহতা, ধ্বংস ক্ষমতা বুঝা যায়। আমি একে এভাবে বিশ্লেষণ করি- ‘আ’ মানে আপদ, ‘ফা’ মানে ফাঁড়া এবং ‘ল’ মানে লণ্ডভণ্ড। ‘আফাল’-এর তাফালিং বিপদ ডেকে আনে, সবকিছু লণ্ড-ভণ্ড করে দেয়। আফালের আরেক নাম তুফান। সমুদ্রাকৃতির বিশাল জলরাশিতে প্রতিটি গ্রাম কচুরিপানার মতো ভাসমান। আফালে হাওর ভাটি বাংলায় জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। হাওরে সৃষ্টি হয় বিশাল বিশাল বড় বড় ঢেউ; দূর হতে সবেগে আঘাত করে ভঙ্গুর বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত বৃক্ষবিহীন গ্রামগুলোর উপর আছড়ে পড়ে। উত্তাল ঢেউয়ের গ্রাসে ভেঙে যাচ্ছে মাটির আদল। গ্রামগুলো সামান্য ঘাস, ছোবড়া, বাঁশ, একপ্রকার ঘাস-চাইল্যা প্রভৃতি দিয়ে প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি করা হয়। প্রতিবছরই এভাবে প্রতিরক্ষা দেয়াল দিতে হয়। হাওর উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবমতে, হাওরবাসী তাদের আয়ের ১/১৬ অংশ ব্যয় করেন এ প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণে। এ প্রতিরক্ষা দেয়াল ঢেউয়ের আঘাতে লণ্ড-ভণ্ড হয়ে, সব হাঁস-মুরগি, গরু-বাছুর ভেসে যায়। অনেক বাড়িতে ঘরের চাল দাঁড়িয়ে আছে, বেড়া নেই। ঘরের চাল ছুঁয়ে পানি পড়ে। ঘরে-বাইরে মানুষ পানিতে নাকানি-চুবানি খায়। আবার কোন কোন বাড়ি একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রতিবছরই এরূপ ভাঙ্গনে গ্রামগুলোর অস্তিত্ব বিলীনের পথে। ইতিমধ্যেই অনেক গ্রাম ভেঙ্গে বিলীন হয়েছে, ছোট হয়ে এসেছে গ্রামগুলোর আয়তন। হাওর এলাকার ভিটের জায়গা বড়ই মূল্যবান, দামি। হাওরের ঢেউয়ের আঘাত উপেক্ষা করে নতুন বাড়ি তৈরি, বাড়ানো ও টিকিয়ে রাখা কষ্টসাধ্য কাজ। একচিলেত খোলা মাঠ দুর্লভ। আফালের ফলে সবকিছু কাদা-জলে একাকার হয়ে এক মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হয় হাওরবাসী। ভিটের মাটি বন্যায় সরে গিয়ে, বেড়াবিহীন ঘরের ভাঙ্গা খুঁটি দাঁত বের করে উপহাস করে। কারণ, বর্ষাকালে হাওর-ভাটি বাংলায় বাঁশ-কাঠ, চাইল্যা দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে। দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়ে যায় দাম, দুর্লভও বটে। ফলে গরীব ও খেটে-খাওয়া মানুষদের বাড়িতে প্রতিরক্ষা দেয়াল দেয়া সম্ভব হয় না। অপ্রতিরোধ্য ভাঙনে চোখের সামনেই তাদের বাড়িঘর ভেঙে ভেসে যায়। এ ভিটে ঘর ভরাট ও পুনঃনির্মাণ অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। হলেও ঋণ কর্জে জর্জরিত নিষ্পেষিত হতে হয়। প্রতিবছর বৈশাখ থেকেই হাওর-ভাটি বাংলায় বর্ষা আগমনের সাথে আফালের তাফালিং শুরু হয়। শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। বর্ষা এলেই থমকে যায় সবকিছু। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত হয় কর্ম-চাঞ্চল্যহীন হাওরবাসী। বর্ষাকালে হাওর এলাকার প্রতিটি বাড়ি ‘জলবন্দী’ হয়ে পড়ে। আফালের ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। অঘোষিতভাবে স্কুল, হাট-বাজার, যোগাযোগ বন্ধ থাকে। এমনিতেই হাওরের স্কুলগুলো বর্ষায় শিক্ষার্থী/ শিক্ষকের অভাবে প্রায়ই বন্ধ থাকে। আর আফালের সময় হাওরের বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অলিখিত ছুটি থাকে। এ সময় ছাত্রছাত্রী এমনকি শিক্ষকরাও নিয়মিত স্কুলে আসতে পারে না। কারণ এলাকায় সড়ক যোগাযোগ বলতে কোন ব্যবস্থা নেই। কোন কোন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ উপস্থিতির হার মাত্র ৫/৬ জন। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকরাও বর্ষাকালে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কমে যাবার বিষয়টি স্বীকার করেন। স্থায়ী ছ’মাস বেকার হাওরবাসীকে আফাল ‘ঘরবন্দী’ করে অচল করে দেয়। স্যাঁতস্যেঁতে আবহাওয়ায়, কাদাজলে মানুষের রোগ-বালাই বৃদ্ধি করে। মানুষের জীবিকা সংকট দেখা দেয়। আফালকে উপেক্ষা করে মত্স্যজীবীরা জাল নিয়ে ঘর হতে বের হতে পারে না। জলমহাল লীজ গ্রহীতাদের উত্পাত তো রয়েছেই। অনেক সময় নৌকাডুবিতে মানুষ মারা যায়। প্রচণ্ড ঢেউয়ের ফলে জলজ উদ্ভিদের পরিবেশ, মাছের আবাস বিনষ্ট হয়। পলি পড়ে ভরাট হয় বিল-ঝিল। জলজ উদ্ভিদ মাটি হতে ্উপের ছিঁড়ে ভাঙ্গনকে বেগবান করে। সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়াসহ রোগ-বালাই বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় মানুষের কাছে হাওরের পানিতে প্রতিফলিত ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। কর্মহীন মানুষেরা নিরুপায়, ঝুঁকছে দাদন ব্যবসায়ীদের ওপর। মাসে পাঁচ টাকা হারে সুদের ব্যবসায়ীদের গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়ে। হাটবাজারে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বর্ষাকালে হাওর এলাকায় সবচেয়ে বড় সংকট হয় জ্বালানি ও গো-খাদ্যের। জ্বালানির অভাবে এ সময়ে অনেক পরিবারে দিনে একবার রান্না করারও উপায় থাকে না। নিরুপায় লোকজন ৫-১০ ফুট হাওরের পানিতে ডুব দিয়ে এক ধরনের দুর্বাঘাস তুলে। রোদে শুকিয়ে তা রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাও বর্তমানে দুর্লভ। আফালের তাফালিং হতে হাওর গ্রামকে রক্ষার পরিকল্পিত পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অপরিহার্য। বিচ্ছিন্নভাবে, যেখানে সেখানে ছোট গ্রাম তৈরি করতে দেয়া যাবে না। জমি, পরিবেশ ও গ্রাম সুরক্ষার স্বার্থেই তা বন্ধ করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে, স্রোতের অনুকূলে, সুবিধাজনক স্থানে, আড়াআড়িভাবে, কয়েক স্তরে, সমন্বিত নতুন নতুন গ্রাম সৃজন করতে হবে। এ গ্রামকে কেন্দ্র করে হাওর জীবনে নতুন প্রাণ সঞ্চারের সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে ভিটা তৈরির গাঁথুনি দেয়ার সময় মাটির সাথে শক্ত কিছু মিশানো যায় কি না তা খুঁজে বের করতে হবে। পুরনো গ্রামগুলোকেও এ পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে। গ্রাম সুরক্ষার জন্যে গ্রাম ও হাওরে জল সহিষ্ণু বৃক্ষরাজি রোপণ করতে হবে। প্রত্যেক গ্রামকে কেন্দ্র করে কয়েক স্তরের বিভিন্ন গাছ-গাছালির সবুজ বেস্টনি গড়ে তোলা যেতে পারে। হাওরের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য ‘হাওর কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে বাজেট, জনবল, পরিকল্পনা দিয়ে শক্তিশালী ও কর্মক্ষম করতে হবে যেন হাওরের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। (এই পোষ্টটি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে) এই বিভাগে প্রকাশিত মতামতের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে