
ছবি সংগৃহীত
শাস্ত্রীয় সংগীত এবং লোকসংগীত যেভাবে আলাদা
আপডেট: ১৭ মে ২০১৩, ০৯:৫৩
সংগীত ভুবনে শাস্ত্রীয় সংগীত এবং লোকসংগীত দুটি বহুল জনপ্রিয় ধারা। সংগীতের এই দুটি ধারা নিয়ে সংগীত প্রেমিদের মাঝে বিতর্কের অন্ত নেই। অনেকে বলেন শাস্ত্রীয় সংগীত এবং লোকসংগীত দুটোই একই বৃক্ষের দুটি ভিন্ন শাখা। আবার অনেকে এ দুটো বিষয়কে দুটো ভিন্ন ভিন্ন বৃক্ষ হিসেবে ভাবতে ভালোবাসেন। তবে বেশির ভাগ সংগীত বিশারদই শাস্ত্রীয় সংগীতকে একটি প্রকান্ড মহীরুহ এবং লোকসংগীতকে সেই মহীরুহের আশেপাশে গজিয়ে উঠা ঘাস-লতাপাতা হিসেবে দেখে থাকেন। শাস্ত্রীয় সংগীত এবং লোকসংগীতের মধ্যেকার মূল পার্থক্যটা শ্রেষ্ঠত্বে, নৈপুণ্যে, কালোত্তীর্ণতায়। মানব সম্প্রদায়ের একটি ছোট্ট গোষ্ঠীর অল্প কিছু লোকের মুখে মুখে যে সকল গানের প্রচলন ঘটতে দেখা যায়, মূলত সেগুলোকেই লোকসংগীত বা ফোক বলা হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয়না কোন শিক্ষার, তাই লোকসংগীত হয়ে থাকে ব্যাকরণ উপেক্ষিত। একটি ছোট্ট অঞ্চলকে ভিত্তি করে লোকসংগীতের চর্চা হয়ে থাকে বিধায় এর মাঝে আঞ্চলিকতা দোষ বিদ্যমান। লোকসংগীত একটি সংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু মূলের নয়। অপরদিকে একটি ভাষার সংগীত বলতে আমরা সাধারণত বুঝি শাস্ত্রীয় সংগীতকে। সংগীতকে শাস্ত্রীয় বা ক্লাসিক্যাল হতে হলে এর ভিতর কিছু গুণ থাকা আবশ্যক। একটা উপন্যাসকে সেই ভাষার সাহিত্যাঙ্গনে স্থান পেতে হলে বিশেষ কিছু যোগ্যতা থাকা চাই, তেমনি সংগীতকেও ক্লাসিক্যালে স্থা��� পেতে হলে বিশেষ কিছু যোগ্যতা থাকা বাধ্যতামূলক। শাস্ত্রীয় সংগীত একটি শাস্ত্র। বাংলা ব্যাকরণ শাস্ত্রের কারক-বিভক্তির ন্যায় ক্লাসিক্যালের ভিতর অসংখ্য শেখার এবং চর্চার উপাদান বিদ্যমান। একই সাথে ক্লাসিক্যাল কোন রসকষ বর্জিত নিষ্প্রাণ শাস্ত্র নয়। এরমধ্যে রয়েছে শাস্ত্রের প্রতিটা নিয়মানুসারে শিল্প মিশ্রিত প্রায়োগিক রূপ। এ কারণেই ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের মতোই চিত্তাকর্ষক ও মনোরঞ্জক। ক্লাসিক্যালকে সংগীতের অন্যান্য ধারা গুলোর জননী বলা চলে না, যদিও আধুনীক গানের ধারাগুলোর উদ্ভব ক্লাসিক্যাল থেকে একটু সরে গিয়ে এবং সেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছে আরো শত শত শাখা-উপশাখার। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে- শাস্ত্রীয় সংগীতকে কেন শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে? আবার অপরদিকে আধুনিক, পপ, রক ইত্যাদি ধারা গুলোকে কেন পেছনে রাখা হয়েছে? বাংলা ভাষার রাগসংগীতের ক্ষেত্রে এটা আয়ত্বের জন্য দরকার হয় কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণ, মেধা, চর্চা ও সাধনার। তবে গান গাইবার জন্যে রাগসংগীত বা শাস্ত্রীয় সংগীতে দখল থাকাটা বাধ্যতামূলক না। যদিও সংগীতের শাস্ত্রীয় পাণ্ডিত্য এর অন্যান্য ধারা গুলো দখল করা সহজ করে তুলে। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী যেমন সংগীতের প্রায় সব গুলো শাখাতেই অনায়াসে আরোহণ করতে সক্ষম হবেন, সেক্ষেত্রে এতোবছর ধরে গান গেয়ে দেশ মাতানো কোন পপ বা ব্যান্ড গায়ককে সেটা করতে যেয়ে হিমসিম খেতে হবে। একইসাথে ক্লাসিক্যালকে কালোত্তীর্ণ হিসেবে ধরা হয়। বাংলা সংগীতাঙ্গনে মান্নাদে, অজয় চক্রবর্তী, প্রসূন ব্যানার্জি, ভীষ্মদেবদের করা কাজগুলো শত শত বছর টিকে থাকতে বাধ্য। প্রায় সকলেই ক্লাসিক্যাল হিসেবে রবীন্দ্র-নজরুল চিহ্নিত করে থাকেন। রবীন্দ্র সংগীতে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় উপাদান যেমন খেয়াল, তারানা, ঠুমরীর ব্যবহার ঘটলেও গাওয়ার সময় সেগুলো অনেক সময় অব্যবহৃত থাকে। অপরদিকে নজরুলের সব গান ক্লাসিক্যাল বলা না গেলেও, চর্চার দিক থেকে দেখলে অনেক গানই শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্তর্ভূক্ত। সেইসাথে এদুটো ধারাই কালজয়ী। তাছাড়া রাগসংগীতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র গুলো আয়ত্বে আনতে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের থেকে বেশি দক্ষতা, চর্চা এবং সাধনার প্রয়োজন পরে। এজন্যেই ক্লাসিক্যালকে সবসময় সংগীত ধারার সবচেয়ে উপরে রাখা হয়। এবং এই কারণে লালন সর্বজনীন এবং কালজয়ী হয়ে উঠলেও তা লোকসংগীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বর্তমানকালের জনপ্রিয় সংগীত ধারা গুলোর ভীড়ে শাস্ত্রীয় সংগীত না আবার বিলীন হয়ে যায়। এ ব্যাপারে প্রায় সকল সংগীত বিশারদরই একই মতামত প্রদান করে থাকেন, ক্লাসিক্যালের বিলুপ্তি অসম্ভব। হাজার হাজার মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়া সংগীত ধারাগুলোর মাঝে যদি কিছু টিকে থাকে, তবে সেটা ক্লাসিক্যাল। কিন্তু কথা হচ্ছে, আধুনিক পপ, রক, মেটাল ইত্যাদির ভীড়ে ক্লাসিক্যালের জনপ্রিয়তা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে কেন? জীবনান্দদাশ একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, ‘জনসাধারণ কবিতা বুঝবে এতটা আশা করা বাড়াবাড়ি।’ তেমনি টপ্পা, ঠুমড়ি, দাদরা ইত্যাদি জনসাধারণের বোধগোম্যতার বাইরে। তবে সত্যিকারের সুরবোধসম্পন্য সংগীত প্রেমিদের চিত্তে ক্লাসিক্যালের এই ব্যাপার গুলো ভালো লাগতে বাধ্য। আরেকটা ব্যাপার বর্তমান কালে বাংলা সংগীত জগতে বেশ আলোচিত। সেটা হলো তরুন শিল্পীদের কণ্ঠে রবীন্দ্র-নজরুলের ফিউশান। এতে কি রবীন্দ্র-নজরুলগীতি হুমকির সম্মুখে? না, এই আশঙ্কাটি সাময়িক। অর্ণব, সাহানা, শিরোনামহীনের করা রবীন্দ্রও সাময়িক। অচিরেই এগুলো কালের গহবরে হারিয়ে যাবে, টিকে থাকবে মূল ধারার রবীন্দ্র। "অ, আ, ক, খ" এর মতোন শত শত ব্যান্ড "আমার সোনার বাংলা" শত শত বার রিমেক করবে, কিন্তু টিকে থাকবে মূল "আমার সোনার বাংলা।"
- ট্যাগ:
- লাইফ
- জীবন চর্চা