ছবি সংগৃহীত

প্রশ্নোত্তরে হজ ও উমরাহ : প্রবন্ধ :- ১২ : কঙ্কর নিক্ষেপ করার বিধান

priyo.Islam
লেখক
প্রকাশিত: ২৩ আগস্ট ২০১৪, ০৩:৪৮
আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০১৪, ০৩:৪৮

কঙ্কর নিক্ষেপ করার বিধান প্রশ্ন : ১০ই যিলহজ অর্থাৎ ঈদের দিনে আমাদের কী কী কাজ আছে? উত্তর : নিম্নবর্ণিত ৪টি কাজঃ (১) কঙ্কর নিক্ষেপ [শুধুমাত্র বড় জামারায়], (২) কুরবানী করা, (৩) চুল কাটা (৪) তাওয়াফ করা অর্থাৎ তাওয়াফুল ইফাদা বা ফরয তাওয়াফ। এ দিনে না পারলে পরবর্তী ২ দিনের মধ্যে বা অন্য যে কোন সময় করলেও চলবে। প্রশ্ন : আজকের ঈদের দিনে কোন কাজটি প্রথমে করব? উত্তর : বড় জামারায় ৭টি কঙ্কর মারা। মুস্তাহাব হলো এর আগে অন্য কোন কাজ না করা। প্রশ্ন : ‘‘বড় জামারা’’ কোন্টি? উত্তর : হারাম শরীফ থেকে মিনায় আসলে ঐ পথে যেটা কাবার নিকটতম সেটাই বড় জামরা। প্রশ্ন : কঙ্কর নিক্ষেপের হেকমত কি? উত্তর : আল্লাহ তা‘আলার যিক্র কায়েম করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সাঈ এবং জামারায় পাথর নিক্ষেপ আল্লাহ তা‘আলার যিক্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যই করা হয়েছে। (তিরমিযি) প্রশ্ন : জামারায় কঙ্কর মারার হুকুম কি? উত্তর : ওয়াজিব। এটা ছুটে গেলে দম দিতে হবে। প্রশ্ন : ১১ এবং ১২ যিলহজ তারিখে প্রতিটি ‘‘জামারায়’’ প্রতিবারে কয়টি কঙ্কর মারতে হয়? উত্তর : ৭টি করে তিনটি জামারায় মোট (৭×৩)=২১টি কঙ্কর। প্রশ্ন : প্রথমদিন অর্থাৎ ১০ই যিলহজ তারিখে ‘বড় জামারায়’ পাথর নিক্ষেপের সময় কখন শুরু হয়? উত্তর : সূর্যোদয়ের পর থেকে কঙ্কর মারা উত্তম। ফজরের আউয়াল ওয়াক্ত থেকে সূর্য উঠার আগেও পাথর নিক্ষেপ জায়েয আছে। দুর্বল, শিশু, নারী ও অক্ষম ব্যক্তিরা মধ্যরাত্রির পর থেকে কঙ্কর মারা শুরু করতে পারে। প্রশ্ন : প্রথমদিন কঙ্কর নিক্ষেপের শেষ সময় কখন? উত্তর : ঐদিনে কঙ্কর নিক্ষেপের উত্তম সময় হল সূর্যোদয় থেকে শুরু করে দুপুরে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত। সন্ধ্যা পর্যন্ত মারাও জায়েয আছে। কারণবশতঃ সন্ধ্যার পর থেকে ঐ দিবাগত রাতের ফজর উদয় হওয়ার আগেও যদি মারে তবু চলবে। তবে এ সময়ে মাকরূহ হবে। প্রশ্ন : কঙ্কর নিক্ষেপের শর্ত কয়টি ও কি কি? উত্তর : শর্তগুলো নিম্নরূপঃ (১) জামারার খুঁটিকে লক্ষ্য করে কঙ্কর ছুঁড়ে মারতে হবে। অন্যদিকে টার্গেট করে মারলে খুঁটিতে লাগলেও শুদ্ধ হবে না। (২) ঢিলটি জোরে নিক্ষেপ করতে হবে। সাধারণভাবে কঙ্করটি সেখানে শুধু ছুয়ায়ে দিলে হবে না। (৩) কঙ্করটি পাথর হতে হবে। মাটি বা ইটের টুকরা দিয়ে হবে না। (৪) কঙ্করটি হাত দিয়ে নিক্ষেপ করতে হবে। ছেলে-মেয়েদের খেলনা, গুলাল, তীর বা পা দিয়ে লাথি মেরে নিক্ষেপ করলে হবে না। (৫) সাতটি পাথর হাতের মুঠোয় ভরে একেবারে নয় বরং একটি একটি কঙ্কর হাতে নিয়ে নিক্ষেপ করতে হবে। (৬) ব্যবহৃত কঙ্কর পুনরায় ব্যবহার করা যাবে না। (৭) ওয়াক্ত হলে কঙ্কর নিক্ষেপ করা। এর আগে পরে নয়। প্রশ্ন : কঙ্কর নিক্ষেপের সুন্নাত তরীকাগুলো কি কি? উত্তর : এগুলো নিম্নরূপঃ (১) মিনায় প্রবেশ করে কঙ্কর নিক্ষেপের আগে অন্য কিছু না করা। (২) কঙ্কর নিক্ষেপ শুরু করার পূর্বে তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করে দেয়া। (৩) প্রতিটি কঙ্কর নিক্ষেপের সময় ‘‘আল্লাহু আকবার’’ বলা। ডান হাতে নিক্ষেপ করা। পুরুষের হাত উঁচু করে নিক্ষেপ করা। মেয়েরা হাত উঁচু করবে না। (৪) কংকরের সাইজ হবে গুলালের গুলির কাছাকাছি বা চানা বুটের দানার চেয়ে একটু বড়। (৫) প্রথমদিন সূর্যোদয়ের পরে মারা সুন্নাত। (৬) দাঁড়ানোর সুন্নত হলো মক্কাকে বামপাশে এবং মিনাকে ডানে রেখে ‘জামারার’ দিকে মুখ করে দাঁড়াবে। এরপর নিক্ষেপ করবে। প্রচন্ড ভীড় হলে যে কোন দিকে দাঁড়িয়েও মারতে পারেন। (৭) একটা কঙ্কর মারার পর আরেকটি মারা। অর্থাৎ দুই কংকরের মধ্যে বেশী সময় না নেয়া। (৮) কঙ্করগুলো পবিত্র হওয়া মুস্তাহাব। অপবিত্র হলেও তা দিয়ে নিক্ষেপ করা যাবে। তবে মাকরূহ হবে। প্রশ্ন : আইয়্যামে তাশরীকের দিনগুলোতে পাথর নিক্ষেপের হুকুম কি? উত্তর : ওয়াজিব। এটা বাদ গেলে দম দিতে হবে। আইয়্যামে তাশরীক হল ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহজ। প্রশ্ন : উপরে বর্ণিত ৩ দিনে কঙ্কর নিক্ষেপ কখন শুরু করব? উত্তর : দুপুরের পর থেকে। এর আগে জায়েয নয়। প্রশ্ন : এ ৩ দিনে পাথর নিক্ষেপের শেষ সময় কখন? উত্তর : সুন্নাত হলো সূর্য ডুবার পূর্ব পর্যন্ত। তবে রাতেও মারা যাবে অর্থাৎ ফজরের পূর্ব পর্যন্ত জায়েয আছে। প্রশ্ন : ১২ই যিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপ করে যদি সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করতে না পারে তাহলে এর বিধান কি? উত্তর : ঐ দিন মিনাতেই রাত্রিযাপন করা ওয়াজিব হয়ে যায়। পরের দিন ১৩ই যিলহজ দুপুরের পর ৩টি জামারাকে আরো ২১টি পাথর নিক্ষেপ করে পরে মিনা ত্যাগ করতে হবে। প্রশ্ন : যারা ১২ তারিখে সন্ধ্যার পূর্বে মিনা ত্যাগ করতে পারেনি তারা কি ১৩ তারিখে দুপুরের আগে পাথর মারতে পারবে? উত্তর : ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর মতে মারা জায়েয আছে। কিন্তু একই মাযহাবের তাঁরই দুজন সঙ্গী ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মতে দুপুরে সূর্য ঢলার আগে কঙ্কর নিক্ষেপ জায়েয হবে না। কাজেই দুপুরের আগে নিক্ষেপ না করাই উত্তম। প্রশ্ন : প্রথমে ছোট, এরপর মধ্যম এবং সর্বশেষে বড় জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপে তারতীব অর্থাৎ সিরিয়াল ঠিক রাখার বিধান কি? উত্তর : সিরিয়াল ঠিক রাখা ওয়াজিব। হানাফী মাযহাবে সুন্নাত। প্রশ্ন : আইয়্যামে তাশরীকের (অর্থাৎ ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহজ তারিখে) কঙ্কর নিক্ষেপের সুন্নাত তরীকাগুলো কী কী? উত্তর : তরীকাগুলো নিম্নরূপ : (১) দুপুর হলে পরে কঙ্কর নিক্ষেপ আগে, এরপর যুহরের সালাত আদায় এভাবে সিরিয়াল করা মুস্তাহাব। (বুখারি) প্রচন্ড ভীড় থাকে বিধায় এ সিরিয়াল ঠিক রাখার চেষ্টা না করাই ভাল। (২) মিনার মসজিদে ‘খায়েফ’ থেকে কাবার দিকে অগ্রসর হলে প্রথমে ছোট এরপর মধ্যম এবং শেষে বড় জামরা দেখতে পাবেন। আগে ছোট ‘জামারায়’ কঙ্কর নিক্ষেপ করে এটাকে বামে রেখে এখান থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে কিবলামুখী হয় দাঁড়িয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়বেন এবং দু’হাত উঠিয়ে দোয়া করবেন। (৩) এরপর যাবেন মধ্যম ‘জামারায়’। এখানেও পূর্বের মত ‘আল্লাহু আকবার’ বলে প্রতিটি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন এবং পরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, পড়বেন এবং কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত উঠিয়ে আরবীতে বাংলায় যত পারেন লম্বা মুনাজাত করবেন। একাকি মুনাজাত করাই সুন্নাত। (৪) সবশেষে বড় জামরায় এসে ৭টি কঙ্কর মেরে আর থামবেন না সেখানে। জামারা ত্যাগ করবেন। একই নিয়মে শেষ ৩ দিন প্রতিদিন ৭+৭+৭= ২১টি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। প্রশ্ন : কঙ্করটি হাউজের মধ্যে পড়ল কিনা যদি এমন সন্দেহ হয় তাহলে কী করতে হবে? উত্তর : যে কটা সন্দেহ হবে সে কটা আবার মারতে হবে। কঙ্কর হাউজের বাইরে পড়লে ঐ পাথর পুনরায় মারতে হবে। প্রশ্ন : যদি এক বা একাধিক কঙ্কর কম নিক্ষেপ করে থাকে তবে তার বিধান কী? উত্তর : প্রতিটি কংকরের জন্য অর্ধেক সাআ (অর্থাৎ এক কেজি বিশ গ্রাম) পরিমাণ গম, খেজুর বা ভুট্টা দান করতে হবে। আর ঘাটতি কংকরের সংখ্যা ৩ এর অধিক হলে দম দিতে হবে। প্রশ্ন : কোন্ ধরনের হাজীদের পক্ষে বদলী পাথর নিক্ষেপ জায়েয আছে? উত্তর : দুর্বল, রোগী, অতি বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য। প্রশ্ন : কোন্ কোন্ শর্তে বদলী কঙ্কর নিক্ষেপ জায়েয হবে? উত্তর : (১) যিনি বদলী মারবেন তিনি একই বছরের হাজী হতে হবে। (২) যার পরিবর্তে বদলী মারবেন তিনি অবশ্যই অক্ষম ব্যক্তি হতে হবে। (৩) প্রথমে হাজী নিজের পাথর মারবেন, এরপর অক্ষম ব্যক্তির কঙ্কর মারবেন। প্রশ্ন : ‘জামারাগুলোকে’ শয়তান অর্থে ব্যবহারের একটা প্রচলন আছে। অর্থাৎ বড় শয়তান, মধ্যম শয়তান ও ছোট শয়তান বলা হয়, এরূপ নামকরণ কি ঠিক আছে? উত্তর : না, ঠিক নয়। এ ৩টি জামারা শয়তানের প্রতিভূ বা চিহ্ন নয়। এগুলোকে পাথর নিক্ষেপ করলে শয়তানকে পাথর মারা হয়, এ কথাও ঠিক নয়। এটা একটা ভুল ধারণা ও বিভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস। একটা ভুল অনুভূতি নিয়ে জামারাগুলোকে কঙ্কর নিক্ষেপের ক্ষেত্রে মানুষের ভাবাবেগের পরিবর্তন হয়ে যায়, বাড়াবাড়ি করে ফেলে। ফলে নানা অঘটনও ঘটে যায়। আসুন আমরা ভুল আকীদা পরিহার করি। প্রশ্ন : কঙ্কর নিক্ষেপকালে কি কি ত্রুটি হাজীগণ সচরাচর করে থাকেন? উত্তর : নিম্নবর্ণিত ভুল ত্রুটি লক্ষ্য করা যায় : (১) ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহজ দুপুরের আগেই কঙ্কর নিক্ষেপ করে থাকে। এ কাজটা ভুল। সময় শুরু হয় দুপুরের পর থেকে। (২) মুযদালিফা থেকেই কঙ্কর কুড়াতে হবে, এ ধারণা ভুল। (৩) কেউ কেউ কঙ্কর ধৌত করে থাকে। এ কাজ ঠিক না। (৪) ধাক্কাধাক্কি করে অন্য হাজীদেরকে কষ্ট দিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করে থাকে। এরূপ করা অন্যায়। (৫) ক্ষিপ্ত হয়ে কোন কোন হাজী বড় পাথর, জুতা, ছাতা ও কাঠ দিয়ে ঢিল ছুড়ে। এরূপ মারা জায়েয নয়। লেখক : অধ্যাপক মোঃ নূরুল ইসলাম সম্পাদনা : ড. মাওলানা মুহাম্মাদ শামসুল হক সিদ্দিক