.jpg)
ছবি সংগৃহীত
পান্ডুলিপি থেকে ফারুক ওয়াসিফের একগুচ্ছ কবিতা
আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৬, ০৯:২২
(প্রিয়.কম) ফারুক ওয়াসিফ সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত আছেন দীর্ঘ বছর ধরেই। পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখে তিনি বেশ জনপ্রিয় পাঠক সমাজে। বিশেষ করে তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ মূলক কলাম লিখে থাকেন। এর বাইরেরও কবি হিসেবে তার আরেকটি পরিচয় রয়েছে। তার প্রথম কবিতার বই 'জল জবা জয়তুন'। এরই মধ্যে তিনি তার নিজস্ব ভাষারীতির মাধ্যমে কবিতার পাঠকদের কাছেও পরিচিত হয়ে ওঠেছেন। আসছে বই মেলায় প্রকাশি হতে যাচ্ছে ফারুক ওয়াসিফের নতুন একটি কবিতার বই। সেই বইয়ের পান্ডুলিপি থেকে একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হলো প্রিয়.কমের পাঠকদের জন্য।
সমাচার
বলে দিচ্ছি, কাশবন এবারও আলুথালু দেখা যাবে। একটা লোকভীত শেয়াল তোমাকে কেমন করে চা’বে? ওকে ভয় নেই, ও আমার পরজন্মের পাপ। মেঘের মতো নদীও ঝরতে ঝরতে সরে— নাচতে নাচতে ময়ূরও। বিধিতে এমন ধারাই লেখা থাকে। এর পরে ছায়াদের কথা কিছু বলি; তাদেরও পিঠ ভেজে বৃষ্টিতে আর পৃষ্ঠার পিঠে লেখা পৃষ্ঠা ওল্টানোর স্বভাব তোমার। শত্রুভয় রেখ না, ট্রেন আসবে সকালে। পালঙ্কটা ভেঙ্গে রেখেছি, ঢেউগুলি ভাঁজ করে পলিথিনে ভরা। বৌ-বাচ্চার পাশে তোমাকেও বসাই, মায়া! সাইকেলটা রশি দিয়ে বাঁধা জানালায়। পানির বোতল, গুচ্ছখানিক নাশপাতি আর একটা অজ্ঞাত পদার্থের প্যাকেটও দিয়ে দিচ্ছি সঙ্গে...একটা রেলগাড়িতে সব কি আর আঁটে? স্টেশন মাস্টার আমার ছোটোবেলাকার ভাই, তোরঙ্গগুলি পরে সে-ই পাঠাবে। ফিরতি পত্রের প্রযত্নও তারই... ফুলছড়ি ঘাটে শিশিটা ফেলে দেবে জানি। শীত আসছে, উলের বলগুলি গড়াতে থাকবে পায়ের কাছে। মেয়েটার কার্ডিগান কি ছোটো হয়ে গেল? আমিও ছোটো হয়ে যাচ্ছি, নামতে থাকছি আগের চ���য়েও আগের স্টেশনে। সে এক দেশ, শতকিয়া নিয়মে কৃতকর্ম পরীক্ষা করা হয় সেখানে। জানো কিনা পৃথিবী এখনও গোলাকায় আর ঘূর্ণনশীলই আছে। আর খেলনা পুতুলগুলি অযথা বুড়ো হয়, বাড়ি ফিরলে আদর চায়, মুখও ফিরিয়ে থাকে। কিন্তু নড়বার গরজ নাই এক্কেরে...ঈশ্বরদী স্টেশনের আগে কিছুটা ঘুমিয়ে নিও। কুয়াশাকে ধীরেসুস্থে নামতে বলছি। নিদ্রা পেরিয়ে তখনও ছুটবে কয়লাচালিত লাল গাড়ি, আমাকে স্থাণু করে দিয়ে চলে যাওয়া পূর্বমুখী ট্রেন! জানালায় কাউকে চাইছি না এখন মুখ। ওয়েটিং রুমে মুখের দিকে ছল করে যে তাকালাম, কিছু মনে করো না অভ্যাশবশত। খিদামুখে আস্ত হা যে পেতে রাখি, তথা রেলসুড়ঙ্গ—ওর অন্ধকারেই প্রেরিত বাতাস তোমাকে ছোঁবে। সবই বিধির দান, তাই আমার ভেতর দিয়েই যাও। মনে রেখো, চলে যাবার এইসব দিনও বৃথাই চলে যাবে। আর চিরকালীন হাতটা আমি নেড়েই চলেছি নেড়েই চলেছি...
আতরের ইতিহাস
আতর পাহাড়ের ঘ্রাণ ভেসে আসছে আবার আজ সন্ধ্যায়। মনে হয় তার কাছে যাই।
সকল গরিমা সত্বেও আগরের নিকট বিব্রত বোধ করি। নিজেকে উলঙ্গ বোধ হয়। এরই বাকলে আদি লজ্জা ঢেকেছিল আদম আর হাওয়া। বড় কুণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করি, ‘পুণরায় আমি লজ্জিত আজ, নগ্নতা নিবারণ করো হে মহাদ্রুম!’
স্তব্ধ বৃক্ষ কিছুই বলে না। শাখা নাড়ায় না, পাতা ঝরায় না; উলম্ব শয়ানে শুধু কাঁদে।
আর কালো কালো কষ ঝরে। ততই সৌরভে চিনচিন করে সমস্ত অরণ্য। গতজন্মে তারা ছিল কস্তুরিমৃগ— সারারাত হরিণা সন্ধানে ছুটে বেড়াত ব্যাধের নিশানায়— মৃত্যুনেশায়। এখন নিশ্চল তরু শুধু। গন্ধবণিকেরা জানে, দেহের রূপান্তর আছে; কস্তুরির ঘ্রাণ অবিনশ্বর। আগরের অন্তরের কান্নারস তাদের লোভার্ত করে।
সর্বাঙ্গে পেরেকবিদ্ধ অজস্র যিশুর যন্ত্রণার কাছে তাই নত হতে ইচ্ছা করে। মনে হয় বলি, ‘ভাই রে!’
কিন্তু স্তব্ধ বৃক্ষ কিছুই বলবে না। শাখা নাড়াবে না, পত্রপল্লবে মাতম করবে না; উলম্ব শয়ানে শুধু অশ্রু জমাবে। নিরভিনয় কালো কান্নার বরফ জমাবে।
যত কালো ও ঘন তার জীবনের কষ, তত তার আতরের সম্মোহন।
কবির হৃদয়ও এক পেরেকভরা আগরবন। কবিও এক কস্তুরি পুরুষ—কঙ্করভরা অরণ্যে পড়ে থাকা মর্মন্তুদ সুঁচরাজা।
কাঠপেন্সিল
আমি একটা ইরেজারহীন কাঠপেন্সিল। নিশি ও কালো হাড়ের ফসিল । যেই মুখেই কাটো ভিতরে কয়লার শিস। ভিতরে কালো তিতিরের জমাট রক্ত; আমি তো তাহাদের দেশ হইতেই প্রেরিত! ব্লেড হাতে নিয়া তুমি আসিও, প্রখর করিও লিখিবার আগে।
আপাত কঠিন, কিন্তু প্রকৃতির প্রস্তাবে যখন চাঁছা হতে থাকে পরতে পরতে– দেহই থাকে না। পড়িয়া থাকে কেবল বকুলের কিছু অবশেষ।
আমার ভাষা বিন্দুময়। সংগীতই আদি কারণ, যাহা আমি শুনি আর বিন্দু ফাঁপিয়া বৃত্তের জলে নামি। আমি লিখিয়া চলি অজস্র রেলধনু আঁকা এক আকাশে। অস্থি ঘষিয়া ঘষিয়া যতই লিখি পত্রে, কাষ্ঠে অথবা দেওয়ালে—ক্ষয় হই।
লিখিয়াই তো গিয়াছি সব, ফিরিয়া আসিলে চক্ষু শ্যেন করিয়া আসিও। যেই চোখে তিরস্কার সেইরকম দৃষ্টি পাতিয়া দেখিও; অক্ষরগুলির সিথানে সুরমার গুঁড়ার মতো যাহা পড়িয়া আছে, তাহা অভিমান।
জানিও, ওইগুলি আমি এখনো লিখিয়া উঠিতে পারি নাই।
আবিদা পাগলির পাউডার বৃষ্টি
এই বৃষ্টি আমার না, এই বৃষ্টি আবিদা পাগলির। আবিদা পাগলি, পিটিআই মোড়ে একটা আমগাছের নিচে যে সারাদিন বউ সেজে দাঁড়িয়ে থাকে। বাহের দেশের প্রতিটি রিকশাওয়ালা প্যাডল চালিয়ে যাবার সময় তাকে 'সুন্দরীইই' বলে ডাকে। সে কখনো হাসে, কখনো খিস্তি করে। আবিদা পাগলী জানে অপেক্ষা আর তিতীক্ষার মধ্যে শুয়ে থাকে এক কালিগুড়া ঝরানো কাক।
এই নষ্টনিকষ শহরের কালিঝুলি মুছতে আবিদা তিব্বত পাউডারে আকাশটা সাদা করে ফেলে।
এই বৃষ্টি আমার না, এই বৃষ্টি আবিদা পাগলির। বৃষ্টিতে যখন আবিদার গাল-কপাল ঠোঁট থেকে রং গলে গলে যায়, তাকে তখন ভাসানে দেওয়া প্রতিমার মতো করুণ দেখায়। তখন কেউ যদি তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এত এত পাউডার তোমাকে কে কিনে দেয় আবিদা?’
শোঁশানি তোলা গলায় সে উত্তর করে: মোতাহের মাস্টার।
রাত্রির ভাষায়
রক্তের কপাট খুলে আমি নাহয় আর না থাকি। অভঞ্জনীয় আলোয় জেগে না উঠি নগরীর মতো। আমার সত্তার সুর নিশিন্দারা, এ পাখায় মাটিডালি ও পাখায় শান্তাহার—রোদের কুচন্দন মাখা কপাল আমার। আমি এক অহেতুক বিরাজ করা নাম—আধচেতা বন। নিখিলের হাপর থেকে বয়ে আসে বায়ু, ডেকে ওঠে পাখ আমার ভেতর।
এখানে বৃক্ষের ও জাহাজের থিতি, সামুদ্রিক শ্বাসের শেষ বন্দর। শূন্যতা ফাঁপিয়ে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া পাহাড়ের মতো আমিও বিস্তারিত সন্ধ্যাদেশে।
অনেক বাতির বাসনায় জর্জর এ দেহ শহর। মন এক গ্রাম। শিয়রে রেখে ক্ষয়শীলা চাঁদ; ঘুমাতে পারে সে বর্ষণে ক্ষতবিক্ষত আকাশের নিচে। আমি জেগে থাকি না এ বিশ্বে; রাজধানীগুলির মতো ভয়ে ও প্রতাপে। আমি চুপচাপ ভাষার মতো অশরীরী হয়ে যাব। মান্ধাতার কোনো এক ভাষায় খুলব মূক ও বধির শ্রেণীর ইস্কুল। সে ভাষার ছায়াপথে ঢেউকাঞ্চন ঢেউ। স্তরে স্তরে পোনা মাছেদের তুরন্ত ঝাঁক, হেমন্তের মেঘেদের থইথই। তার তল ছুঁয়ে নেচে যায় কোনো কোনো পাখি। সে ভাষার চেতনজ্বরা বইবে ভাষায় আমার।
ক্ষতমুখের মতো আর না জেগে থাকি। আমার ভাষায় সতত রাত্রি নামুক।
স্মৃতি ও ডুমুর
স্মৃতিই অক্ষর যে শিলাপৃষ্ঠার তার নাম জীবন। স্মৃতিদীপ ছাড়া প্রাণসাঁই, কীভাবে অপরশ চলে যাই? চিমনিটা মুছতে গিয়ে ভেঙ্গে গেল; কী করে সামলাই বায়ুজ্বর?
একে একে খুলে যাচ্ছে তারকাদের মুখ। যে নক্ষত্র নতুন দ্যুতিচিহ্ন নিয়ে ফোটে, ব্যর্থ অভিলাষ নিয়ে চলে যায় যে গুঞ্জরিত মাছি, আমারও স্মরণ থেকে উবে যাচ্ছে কথা। শিমুলের খোলের মতো বিদীর্ণ করে উড়ে যাচ্ছে আমারই আত্মার আঁশ। স্মৃতির বর্ণমালা ভেসে যাচ্ছে পাকে—স্রোতে। আমিও মুছে যাচ্ছি আমারই স্বপ্নের ভেতর। বিনা সংকেতে কীভাবে পার হব বিধি—চরাচর?
আয়না থেকে তুলে মায়ার পারদ—তোমাকে যেতেই হবে। তোমাকে শুধতেই হবে দানে-প্রতিদানে নিঃশেষ-নজরের ঋণ। জাহাজও পাঠাচ্ছে ডাক—সময় ঘনিয়ে এল বন্দরে তোমার।
যখের গহনার মতো বিচূর্ণ স্মৃতির বালি চিকচিক করে যদি চোখে সেদিন, সে কেবল কাহিনীর অবলেশ। নিখিলের হাতে তুলে দিয়ে তোমাকে, স্মৃতি কুড়াচ্ছি আমি এই হিমে; তাদের গায়ে রোদ দিচ্ছি, ধূপ দিচ্ছি। সোনারূপায় গলানো আগুনের হার জ্বালছি তাদের প্রাণে। ধরে ধরে তাদের জিজ্ঞাসা করছি, ‘তাকে দেবার ডুমুরটি কই? করতল কেন ফাঁকা আমার?’
নিজেকেও তুমি জিজ্ঞাসিও, তমোহর ডুমুরটি কোথায় হারিয়েছিলে?
প্রকৃতির প্রস্তাব
প্রকৃতির প্রস্তাবে আমিও তাহাই—মানুষ। অধিকখানি জল কিছুটা অস্থিমাটি আমাকে খুঁড়িলেও পাইবে। প্রকৃতির প্রস্তাবেই দৃষ্টি, নিদ্রা ও মৃত্যু ছাড়া আর সবই আমাকে শিক্ষা করিতে হয়। এ জরাজটিল অরন্য, যার নাম জীবন, তা কত সম্পর্কের পরিখা দিয়া ঘেরা। আমি সেসকল যথারীতি প্রদক্ষিণ করি, তাহাদের উপশিরায় প্রবাহিত করি পীতরস। যথারীতি আমি পুরুষ; প্রকৃতির প্রস্তাবে কিছুটা ধাতব—তাপ ও পীড়নে প্রসারণশীল। খরস্রোতে আমি শানিত করি ছুরি। আমার দুচোখে দুটি ছিন্ন শিমুলের কুঁড়ি। প্রকৃতির সরল প্রস্তাব হয়তো ইহাই ছিল যে, আমি লিখিব সমুদায় নীরবতা।
আমাকে তাই আর উচ্চারণ করিও না।
- ট্যাগ:
- সাহিত্য
- কবিতা
- কবিতা
- ফারুক ওয়াসিফ