ছবি সংগৃহীত

পাই বন্দনা

দীপ্র
লেখক
প্রকাশিত: ১৮ আগস্ট ২০১৩, ০৭:৩৯
আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০১৩, ০৭:৩৯

আমরা মোটামুটি ভাবে সবাই পাই এর সাথে পরিচিত। গণিতে হাতেখড়ি হবার পর থেকেই কমবেশি পরিচিত হতে হয় এই আশ্চর্য ধ্রুবকটির সাথে। শুণ্যের মত পাই নিয়েও মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। প্রাচীন গ্রীক, ভারতীয়, মিশরীয় ও ব্যাবীলনিয় জ্যামিতিকদের ভালো ভাবেই জানা ছিল যে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত সর্বদা সমান ও ৩ এর থেকে বড়। ভারতীয় পুস্তক "Satapatha Brahamana" তে পাইয়ের মান ৩.৩১৯ উল্লেখ করা হয়েছিল। পাইয়ের মান সর্বপ্রথম সঠিকভাবে গণনা করেন গ্রীক গণিতবিদ আর্কিমিডিস। তিনি বৃত্তের ভিতরে সুষম বহুভূজের পরিসীমা বের করে তিনি এই কাজটি সমাধা করেন। ৯৬ বাহুবিশিষ্ট এক বহুভূজ এঁকে তিনি প্রমাণ করলেন ২২৩/৭৩ < পাই < ২২/৭। পাই নিয়ে গবেষণার সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয় ক্যালকুলাস ও অসীম ধারা আবিষ্কারের পর থেকে। অসীম ধারা আবিষ্কারের পরে গণিতবিদরা বুঝতে পারেন বেশি বেশি পদ যোগ করে পাইয়ের মান অধিক সূক্ষ্ম ভাবে নির্ণয় করা যাবে। ১৪০০ সালে সঙ্গামাগ্রামার মাধব সেরকম ধারা খুঁজে পান যার দ্বারা পাইয়ের মান অধিকত সূক্ষ্মতর ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। মাধব পাইয়ের মান 3.14159265359 নির্ণয় করেন যা ১১ ঘর পর্যন্ত সঠিক। ১৪২৪ সালে ইরানের জ্যোতির্বিদ জামশিদ আল-কাশি ১৬ ঘর পর্যন্ত পাই এর মান বের করলে মাধবের রেকর্ড ভেঙ্গে যায়। জার্মান গণিতজ্ঞ লুডলফ ভন চিউলেন আর্কিমিডিসের পর প্রথম ইউরোপীয় হিসাবে পাই গণনায় শরীক হোন। তিনি জ্যামিতিক পদ্ধতিতে দশমিকের পর ৩২ ঘর পর্যন্ত সঠিকভাবে পাই গণনা করেন। এই গণনা করে তিনি এত বেশি আনন্দিত ও গর্বিত হোন যে, মৃত্যুর পর তার সমাধিতে সেটি উৎকীর্ণ করা হয়। এই সময়ে ইউরোপে ক্যালকুলাস, অসীম ধারার সমাধান ও জ্যামিতিক গুণন পদ্ধতির আবির্ভাব হয়। আইজ্যাক নিউটনও পাই এর জন্য ধারা লিখেছেন এবং ১৫ ঘর পর্যন্ত মান বের করেছেন। জন মাচিন হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কী না ১০০ ঘর পর্যন্ত পাই-এর মান বের করেন। আঠারো শতকে তত্বীয় অগ্রগতি থেকে জানা গেল কেবল গাণিতিক গণনা করে পাই এর মান বের করা যাবে না। ১৭৬১ সালে জোহান হেনরিক ল্যাম্বার্ট আবিস্কার করলেন পাই একটি অমূলদ সংখ্যা। ১৭৯৪ সালে আদ্রে-মারি লেজেন্ড্রে আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে দেখালেন (পাই)২ ও একটি অমূলদ সংখ্যা। বিশ শতকে কম্পিউটারের উদ্ভাবনের পর পাই গণনায় নতুন জোয়ার আসে। জন ভন নিউম্যান ১৯৪৯ সালে ২০৩৭ ঘর পর্যন্ত গণনা করেন। এনিয়াক কম্পিউটারে এই গণনার জন্য মাত্র ৭০ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। বিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজন পাই গণনার বেশ কটি নতুন সূত্র বের করেন। তার একটি বিখ্যাত সিরিজ হল 1/π=(2√2)/9801 ∑_(k=0)^∝▒((4k)!(1103+26390k))/((k)!^4 〖396〗^4k ) যা কি না প্রতি পদে ১৪ ঘর করে মান বের করতে পারে। অনেক ক্যাচাল হল এখন আসুন পাই নিয়ে কিছু মজার তথ্য জেনে নেই।

  • ১. পাই এর ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও পাই এর প্রতীক π মাত্র ২৫০ বছর ধরে গণিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
  • ২. এই পর্যন্ত পাইয়ের মান ৬.৪ বিলিয়ন ঘর পর্যন্ত সঠিক ভাবে জানা গিয়েছে।
  • ৩. পাইয়ের মান নির্ভূলভাবে একনাগাড়ে বলে যাওয়ার রেকর্ড হল চীনের ২৪ বছর বয়স্ক লু চাও এর। তিনি ২৪.৪ ঘন্টা সময় নিয়ে পাইয়ের মান দশমিকের পর ৬৭,৮৯০ ঘর পর্যন্ত সঠিকভাবে বলতে সক্ষম হন।
  • ৪. পাইয়ের দশমিকের পরে ৭৬৩ তম স্থান থেকে পরপর ৬ টি ৯ রয়েছে। ইহা ফেম্যান পয়েন্ট নামে পরিচিত।
  • ৫. অনেক মানুষ বিশ্বাস করে পাইয়ের মধ্যে মহাবিশ্বের সকল মহিমা লুকানো রয়েছে।
  • ৬. লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি তার বিখ্যাত "ভিটরুভিয়ান ম্যান" চিত্রকর্মটিতে বৃত্তের ভেতর বহুর্বিধ মাত্রা (মানুষ, চতুর্ভূজ) দিয়ে পাইয়ের মান প্রকাশের চেষ্টা করেছেন আর্কিমিডিসীয় পদ্ধতিতে।
  • ৭. পাই নিয়ে মানবজাতির গবেষণা ৪০০০ বছরের পুরোনো।
  • ৮. বিশ্ব পাই দিবস পালিত হয় বছরের তৃতীয় মাসের ১৪ তারিখ। অর্থাৎ মার্চের ১৪ তারিখ। এবং আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন শুরু হয় ঠিক ১.৫৯ মিনিটে। এতে পাইয়ের আদর্শ মান ৩.১৪১৫৯ সঠিক ভাবে উদযাপিত হয়।
৯. মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন পাই দিবসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জন্মতারিখ ৩.১৪.১৮৭৯ (মাস.দিন.বছর)। ১০.পাইয়ের মান অনেক ঘর পর্যন্ত মনে রাখার সবচেয়ে উন্নত পন্থা হচ্ছে পাইয়ের কবিতা বা পাইয়েম। যার প্রতিটা শব্দের দৈর্ঘ্য দশমিকের পর পাইয়ের ক্রমিক মানের সমান। পাই নিয়ে আসলে বলে শেষ করা যাবে না। পাই চলতেই থাকবে অসীমের পথে অপরূপ এক সৌন্দর্য নিয়ে। গণিতবিদেরা এজন্যি বলেন বৃত্তের অসংখ্য কর্ণ থাকার কারণেই আপাত দৃষ্টিতে বৃত্ত কর্ণহীন।