ছবি সংগৃহীত

দেশের জনসংখ্যা বোঝা নয়, এটি সম্পদ

priyo.com
লেখক
প্রকাশিত: ১২ জুলাই ২০১৪, ০১:৫৩
আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৪, ০১:৫৩

(প্রিয়.কম) দেশের জনসংখ্যা বোঝা নয়, এটি সম্পদ। মুখে মুখে এ স্লোগান চাউর হলেও বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হতে চলেছে। জনসংখ্যা বিশারদদের ভাষায় বাংলাদেশের জন্য এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যা থেকে ‘লভ্যাংশ’ পাওয়ার সময়। জনমিতির পরিভাষায় ডিভিডেন্ড বলতে বোঝায় ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী মানুষের আধিক্য। জনসংখ্যার বোনাসকাল যাকে বলে। এ বয়সসীমার মানুষই সবচেয়ে কর্মক্ষম, যাঁরা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেন। কিন্তু এ কর্মশক্তির দক্ষতা বাড়িয়ে দেশ ও বিদেশের শ্রমবাজার থেকে কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি নেই বাংলাদেশের। অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ যেখানে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী স্বল্পতায় শঙ্কিত, বাংলাদেশে সেখানে ৬৫ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৫৯-এর মধ্যে। ২০১২ সালে এ বোনাস কালে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এ সময়টাতে সবচেয়ে কম থাকে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী। আর সবচেয়ে বেশি থাকে কর্মক্ষম জনসংখ্যা। কিন্তু এ সুবর্ণ সুযোগ ভেস্তে যাচ্ছে। অথচ একটি রাষ্ট্র জনসংখ্যা পরিবর্তনে এ সুযোগ একবারই পেয়ে থাকে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে ঢুকছেন। তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা তরুণও রয়েছেন। কিন্তু যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁরা চাকরি পাচ্ছেন না। বিদেশে শ্রমবাজারে রয়েছে প্রায় ৭০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি। তাঁদের বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। বাংলাদেশ থেকে অনেক কম জনশক্তি রপ্তানি করেও কয়েক গুণ বেশি রেমিট্যান্স আয় করে ফিলিপাইনসহ এশিয়ার অনেক দেশ। দক্ষতাই তাদের মূল পুঁজি, যা বাংলাদেশের নেই বললেই চলে। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। সবশেষ তথ্য মতে, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৫ কোটি ৬৬ লাখ। এর ৬৫ ভাগ অর্থাৎ প্রায় পৌনে ১০ কোটিই পূর্ণ মাত্রায় কর্মক্ষম। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সরকার তা নিচ্ছে না। কেবল দেশেই নয়, বিদেশের শ্রমবাজারেও রয়েছে দক্ষ জনশক্তির বিরাট চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণে দক্ষতা তৈরির সরকারি উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়। জনশক্তি রপ্তানিতে বেসরকারি খাত মূল ভূমিকা পালন করলেও বিদেশের শ্রমবাজার উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে তাদের ভূমিকাও গৌণ। তাঁরা বলছেন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে জরুরি ভিত্তিতে কতগুলো বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবার আগে প্রয়োজন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। আর এ জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এ ছাড়া নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি সব ধরনের অসাম্য দূর করতে হবে। জনসংখ্যার বোনাস কালকে কাজে লাগাতে চাইলে সবার জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত, বয়স্কদের জন্য নিরাপত্তাবেষ্টনী সম্প্রসারণ, মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য উপযোগী ও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে নিযুক্ত প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করতে যে ধরনের পদক্ষেপ দরকার, তা দেখা যাচ্ছে না। বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ স্থবির। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাহলে জনসংখ্যাকেও জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব।’ এদিকে গতকাল ১১ জুলাই শুক্রবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’। এবারের জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘তারুণ্যে বিনিয়োগ, আগামীর উন্নয়ন’। জনসংখ্যা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা। দিবসটি উপলক্ষে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে র‌্যালি ও আলোচনা সভার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। তারা চাকরি পাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে শ্রমশক্তির পরিমাণ পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৪১ লাখ মানুষের কাজ আছে। এর অর্থ মাত্র ২৬ লাখ বেকার। তবে জরিপেই বলা আছে, পরিবারের মধ্যে কাজ করে কিন্তু কোনো মজুরি পায় না- এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১১ লাখ। এ ছাড়া আছে আরো এক কোটি ছয় লাখ দিনমজুর, যাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেকারত্ব দূর করতে কর্মমুখী শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে তাঁরা সরকারের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। গত সোমবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার মান খুবই হতাশাজনক। শিক্ষার মান দুর্বল হওয়ার কারণে আর্থসামাজিকভাবে অন্যান্য দেশ থেকে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। অনেক তরুণ বেকারত্বের ফাঁদে পড়ে আছে। আবার অযোগ্যতার কারণে ভালো জায়গায় চাকরিও হয় না। অনেক ক্ষেত্রে চাকরি পেলেও বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। শিক্ষার মান বাড়াতে প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। বলা হয়েছে, শিশুদের পুষ্টির নিশ্চয়তা দিতে হবে। বাড়াতে হবে শিক্ষকদের মান ও দক্ষতা। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি শিশুদের জন্য প্রণোদনা বাড়াতে হবে। এগুলো নিশ্চিত করতে পারলে শিক্ষার মান বাড়বে বলে আশাবাদী বিশ্বব্যাংক। জনসংখ্যার বোনাসকাল প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, এই ডিভিডেন্ডকে অবশ্যই সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। একে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাঁদেরকেই নিতে হবে অগ্রণী ও ইতিবাচক ভূমিকা। সর্বাধিক কর্মক্ষম এই জনগোষ্ঠীকে সর্বাধিক কাজে লাগাতে হলে প্রচুর কাজের সুযোগ এবং পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সংঘাতমূলক রাজনীতি এড়িয়ে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাকে অক্ষুণ্ন রাখা। তিনি আরো বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগকে সর্বোচ্চ সুযোগ দিতে হবে। যাতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। এর জন্য অবকাঠামো সৃষ্টিতে সর্বাধিক সরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে, বিশেষভাবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত ও ব্যবহারিক উপযোগিতার দিকে বেশি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির জন্য ও আয় বৈষম্য কমিয়ে রাখার প্রয়োজনে- দুর্নীতি দমনে সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাতে হবে। সুপরিকল্পিতভাবে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে এগিয়ে গেলে কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্যের এই বোনাস জাতীয় জীবনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চেহারার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূর-উন নবী চৌধুরী বলেন, যেকোনো দেশের জন্য জনসংখ্যার বোনাসকাল একবারই আসে। আর এটি ৩০ থেকে ৩৫ বছর স্থায়ী থাকে। তাই এই সুযোগ কাজে লাগাতে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। নূর-উন নবী বলেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যার স্থানান্তর ও নগরায়ণ পরিকল্পিত নয়। কর্মসংস্থান না থাকায় বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ রাজধানীর দিকে ছুটছে। এ জন্য ঢাকায় দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। তিনি বলেন, প্রতিবছর এক শতাংশ হারে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। এতে ধান উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা হুমকির সম্মুখীন হবে। সে ক্ষেত্রে দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে যাবে। এ জন্য প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তথ্য সুত্রঃ কালের কণ্ঠ