ছবি সংগৃহীত

গর্বা-বইংগ্যা-জাফাইন্যা: আঞ্চলিক ভাষাবৈচিত্র্য সন্ধান প্রসঙ্গে

Helal Mohiuddin
লেখক
প্রকাশিত: ২৪ অক্টোবর ২০১৪, ০৮:১৯
আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৪, ০৮:১৯

টকফল? TOCFL, অ্যাব্রিভিয়েশন Test of Chittagonian as a Foreign Language চাঁটগার ভাষা‍য় এমন অনেক মৌলিক শব্দ আছে যা বুঝতে হলে চাঁটগাঁয় জন্ম নেয়া ছাড়া উপায় দেখি না। “গর্বা” অর্থ অতিথি। নোয়াখালীতে বলে ম্যাআমন বা ম্যায়মন। ‘মেহমান’ শব্দের স্থানীয় বিকৃতরূপ। অথবা ‘ম্যাজ্জন’। সম্মানবাচক ‘মেহমানজন’ এর অপভ্রংশ। খানিকটা মনোযোগি হলেই ভিন জেলার মানুষও অর্থ বুঝবেন। কিন্তু ‘গর্বা’? শিক্ষক ক্লাবে আড্ডায় হাস্য-কৌতুক করতাম যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে TOEFL আদলে একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হতে হবে এমন—‘টকফল-এ ৫৫০ এর কম স্কোর করা ব্যক্তিগণ আবেদনের অযোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবেন’। কারণ? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েই গুরুতর ভাষা সমস্যায় পড়তে হল। ১৯৯৪ এর শুরুর দিকে। দেখতাম দু’জন চট্টগ্রামের ভাষাভাষি শিক্ষক এক হলেই প্রাণ খুলে নিজেদের ভাষায় কথা বলছেন। সামান্যই বোধগম্য হত। কথা থামলেই ঘনিষ্ঠজনদের খেপাতাম। বলতাম—‘এতক্ষন যা যা বললেন বাংলায় অনুবাদ করে দেন!’ আঞ্চলিকতাবিদ্বেষ হতে মোটেই নয়, আড্ডার জমজমাট মজা-মস্করার জন্য চট্টগ্রামের শিক্ষকরা অন্য অঞ্চলের শিক্ষকদের ভাষা ও আচার-আচরণ নিয়ে কচালি জমিয়ে তুলতেন। নিতান্ত নিরূপায় হয়ে একটা মারণাস্ত্র আবিষ্কার করলাম। অনেকক্ষণ সব বদনামগাঁথা শুনেটুনে বলতাম—“ভাই, চট্টগ্রামের মানুষ নাকি কলাও চা’য়ে চুবিয়ে খায়? এটা কী ঠিক?” আর যায় কোথা! বদনামগাঁথার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হত। বাহাসগুলো উপভোগ করতাম। ভাষাবৈচিত্র্য দিয়ে গড়া সাংস্কৃতিক পরিচয়বৈচিত্র্য গভীর মনোযোগে খেয়াল করার মত বিষয়ই বটে! হাউজ টিউটর হিসেবে শামসুন নাহার হলের লাগোয়া কোয়ার্টারটিতে থাকতাম। রীতিমত দোভাষি লাগত হল কর্মচারীদের ভাষা বুঝতে। [ইয়াসিন, সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ সদ্য যোগ দেয়া মাস্টার রোল স্টাফ আমার দোভাষির কাজটি করত]। আমার স্ত্রীর হয়ে টুকটাক ফাই-ফরমাশ খাটার জন্য দশ-এগারো বছরের এক স্থানীয় বালিকা গৃহকর্মীও থাকত আমাদের সাথে। এক দুপুরে গভীর ভাতঘুম ঘুমাচ্ছিলাম। মৃদূভাষি মেয়েটি কানের কাছে বসে অনেকক্ষণ বলে চলছিল—“খালু খালু, গর্বা আইস্যে”। সে দরজার বাইরে কিছু একটা ইংগিত করছিল। উঠে দেখি এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অতিথিকে (গর্বাকে) সে আধা ঘন্টা দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আমাদের অনুমতি ছাড়া দরজা না খুলে দেয়ার প্রশিক্ষণের ফল। পরদিন হতে জনে জনে জিজ্ঞেস করলাম ‘গর্বা’ শব্দের উৎস কি? সন্তোষজনক উত্তর এখনো মেলেনি। বুধবারে বা বিষ্যুদবারে ক্যম্পাস হতে হাটহাজারি বাজারে বাজার বাস যেত। চাঁটগাঁর ভাষা জানিনা বলে স্থানীয় শিক্ষকদের কাজকর্ম দূর হতে পর্যবেক্ষণ করে নকল করতাম। একবার একজন সিনিয়র শিক্ষক দশ টাকা কেজি দামে বরবটি কিনলেন। মিনিট পর আমিও তাঁর মত করে প্রশ্ন করলাম-‘খী দর?’ --‘কুড়ি টিঁয়া’। সব্জিওয়ালা বিরক্তিভরা তাচ্ছিল্য নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো উত্তর দিল। ভান্ডারেতো আঞ্চলিক ভাষা আর নেই। শুদ্ধ ভাষায় সসম্মানেই প্রশ্ন করলাম—‘ভাই, আপনি অমুক স্যারকেতো দশ টাকা দামে দিলেন?’ আরো ঝাঁঝালো যে উত্তর পেলাম তার অর্থ—এই দামে কিনলে কিনো, নয়তো রাস্তা মাপো। অপমানবোধ নিয়ে পাশের দোকানির কাছে গেলাম। আগের সব্জিওয়ালা পরেরজনকে যা বললো হুবহু মুখস্থ রেখেছি—“অঔডা, বইংগ্যা আইস্যে! বুঝিহুনি দর গল্লাইস?” ইনিও কুড়ি টাকাই দাম চাইলেন। তবে দুটো দশ টাকার নোট দেয়ার পর নিঃশব্দে একটি নোট ফেরত দিলেন। বুঝলাম সবাই ‘ব্যাড অ্যাপল’ নয়। রাগের বদলে কৌতুকবোধই বেশি হয়েছিল। পরে জেনেছিলাম—‘বইংগ্যা’ শব্দের মানে ‘চট্টগ্রামে আসা বহিরাগত’। ‘জাফাইন্যা’ মানে নোয়াখালীর মানুষ—এটা জানলেও ‘বইংগ্যা’ রহস্য জানা ছিলনা। এটি ‘বঙ্গ’ শব্দের অপভ্রংশ কি? সেটা হলে চাঁটগাবাসী ‘বইংগ্যা’ শব্দ দিয়ে কি পুরো বংগীয় জনগোষ্ঠীর চেয়ে নিজেদের আলাদা সাংস্কৃতিক পরিচিতি নির্মাণেই বেশি আগ্রহী? চট্টগ্রামের মানুষ প্রচন্ড আঞ্চলিকতাবাদী—এরকম প্রচলিত সাধারণীকরনের সাথে কোনোকালেই একমত নই, হবার কারণও নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েই এর নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গভীর প্রেমে যেমন পড়েছিলাম; সজ্জন, আন্তরিক, উদার ও উপকারমনা, সদাহাস্য-সুরসিক ও সুচিন্তায় ঋদ্ধ মানুষের বিচরণেও অভিভুত হয়েছিলাম। অনেক পুরনো কৌতুহল—‘বইংগ্যা’ শব্দটি ‘সচেতন আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক পরিচয়-নির্মাণ প্রয়াস’ না ‘বিদ্বেষপ্রবণ আঞ্চলিকতাবাদ’ নির্দেশক। যাঁরা diversity নিয়ে আকাডেমিক কাজ করেন, তাঁরা ভাষাবৈচিত্র্যের এই দিকগুলো, বিশেষত ‘বইংগ্যা’ ধরণের শব্দের ব্যবহারিক গুরুত্ব নিয়ে কোন কাজ করেছেন, বা গবেষণার সাথে পরিচিত আছেন কি? জানলে, জানালে উপকৃত হব।