ছবি সংগৃহীত

গণজাগরণ মঞ্চ, যেভাবে বিকৃত হয় ইতিহাস

শরিফুল হাসান
প্রোগ্রাম হেড, মাইগ্রেশন, ব্র্যাক ও সাবেক সংবাদকর্মী
প্রকাশিত: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ১৪:৫০
আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ১৪:৫০

মুক্তিযুদ্ধ আর শাহবাগের গণজাগরণের মধ্যে এতো মিল! এ যেন ইতিহাসেরই পুনুরাবৃত্তি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেন বিকৃত হয়, কেন রেডিওতে কেবল ঘোষণা দিয়েই কেউ নেতা হয়ে যান, কেন মুক্তিযুদ্ধ না করেও অনেকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়ে যায়, কেন রাজাকাররা আবার এই দেশে ফিরে আসে আর কেন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা ধুকে ধুকে মরে আমি এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই গণজাগরণ মঞ্চের কর্মকাণ্ড দেখে। গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে যে গণজাগরণ সেটি ছিলো স্বতস্ফুর্ত। ফেসবুকের কারো ইভেন্ট কিংবা কারো ডাকে নয়, কোন টিভিসি দেখে নয়, বরং বিবেকের ডাকেই সেদিন পিলপিল করে শাহবাগে আসতে শুরু করেছিলো মানুষ। হ্যাঁ, বোয়ানসহ কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ সব ছাত্র সংগঠন, স্লোগান ৭১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সাবেক কিছু নেতাকর্মী, আমরা কিছু সাংবাদিক এবং কিছু সাধারণ মানুষ প্রথম দিন সেখানে ছিলাম। আমরা যারা প্রথম দিন ছিলাম, তারা হয়তো একটু আনন্দ বোধ করতে পারি যে- প্রথম দিন থেকে ছিলাম। কিন্তু আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, প্রথম দিন রাত পর্যন্ত আমরা যারা শাহবাগে ছিলাম তারা কেউই ভাবতে পারিনি পরদিন শাহবাগে লাখ লাখ মানুষ আসবে। তৈরি হবে এতো বড় গনজাগরণ। কিন্তু মানুষ এসেছিল। দিনের পর দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে মানুষ নতুন এক বাংলাদেশ চেয়েছিল। আর তাই নতুন স্বপ্নে শাহবাগে এসেছিল তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়র বিভিন্ন ছাত্র ও সামাজিক সংগঠক, কিছু ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শুরু থেকে কেবল সেই আন্দোলনকে সুসংগঠিত করতে কাজ করেছেন। কিন্তু সেই আন্দোলন বা গণজাগরণের কৃতিত্ব একক কারো নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাসহ বেশিরভাগ মানুষ এই বিষয়টা মানেন। তাই তারা উদারতা দেখিয়ে, সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে নেতৃত্ব নিয়ে মারামারি করেননি। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে কিছু সুবিধাভোগী। গণজাগরণের এক বছর পর গণজাগরণ মঞ্চের গত তিনদিনের কর্মসূচি, লিফলেট, স্মৃতিচারণ দেখে মনে হলো- কেবল ইমরান এইচ সরকার এবং তার কয়েকজন সঙ্গী-সাথীই যেন এই গণজাগরণ তৈরি করেছিল। এমন কি প্রথম কয়েকদিন শাহবাগে ছিলেন না এমন লোকজনও আজ শাহবাগের সংগঠক হয়ে জাতিকে সবক দিচ্ছেন। তারাই আজ লিখছেন শাহবাগের ইতিহাস। কি নির্লজ্জ মিথ্যাচার। ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত যারা শাহবাগে গিয়েছিলেন, তারা তো জানেন সবকিছুই। আর তাই ক্ষোভ এবং অভিমান নিয়েই সেদিনকার প্রায় সব মানুষই দেখছি গণজাগরণ মঞ্চ থেকে সরে গেছে। আবার অনেকে দেখছি ফেসবুকে সেদিনকার ঘটনার স্মৃতিচারণ করছেন। না, কোন বিতর্ক সৃষ্টি করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য গঠনমূলক আলোচনা। কাউকে আহত করে থাকলে আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি চাই সত্যিকারের ইতিহাস লেখা হোক। আমি জানি না, শাহবাগের সত্যিকারের ইতিহাস কিভাবে লেখা হবে। যারা প্রথম দিন সেখানে ছিলেন তারা প্রত্যেকেই যদি স্মৃতিকথা লিখেন, তবে কি সম্ভব ইতিহাস বিকৃতি বন্ধ করা? আদৌ কি সম্ভব শাহবাগের প্রত্যেক সংগঠককে খুঁজে বের করা। আমি জানি না। তবে আমি এটা জানি, এই শাহবাগ নিয়ে অনেকেই বাণিজ্য করছেন এবং করবেন। তাদের জন্য আমার ঘৃণা। কিন্তু যারা বিবেকের তাড়নায় সেদিন শাহবাগে গিয়েছিলেন, যারা সত্যিকারের মানুষ, যারা কেবল দেশকে ভালোবাসেন, যারা দেশপ্রেম বা চেতনা নিয়ে বাণিজ্য করেন না, যারা কোন প্রাপ্তির কথা চিন্তা না করে এখানে সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন তারাই শাহবাগের সত্যিকারের নেতা। তাই স্যালুট তাদের প্রত্যেককে।