ছবি সংগৃহীত

কোথায় ছিলো সামুদ সম্প্রদায়ের বসতি?

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
লেখক
প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০১৫, ০৩:২৩
আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৫, ০৩:২৩

সামুদ সম্প্রদায় কোথায় বসবাস করতো এবং পৃথিবীর কোন অংশে তারা ছড়িয়েছিলো—এ-সম্পর্কে মীমাংসিত বক্তব্য এই যে, তাদের বসতিগুলো হিজর নামক স্থানে অবস্থিত ছিলো। হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যস্থলে ওয়াদিউল কোরা পর্যন্ত যে-প্রান্তরটি দেখা যায়, এ-সবই তাদের আবাসস্থল ছিলো। বর্তমানে তা ফাজ্জুন নাকাহ নামে প্রসিদ্ধ। সামুদ সম্প্রদায়ের বসতিগুলোর ধ্বংসাবশেষ এবং তার চি‎হ্নসমূহ আজো বিদ্যমান। এ-যুগেও কোনো কোনো মিসরীয় তত্ত্বজ্ঞানী এগুলো স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য হলো, তাঁরা এমন একটি বাড়িতে প্রবেশ করেছেন যাকে শাহি হাবিলি বা রাজকীয় প্রাসাদ বলা হতো। এই প্রাসাদে অনেকগুলো কক্ষ আছে এবং প্রাসাদের সংলগ্ন অনেক বড় একটি হাউজ আছে এবং গোটা বাড়িটি পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে। আরবের বিখ্যাত ঐতিহাসিক মাসউদি লিখেছেন— যে-ব্যক্তি সিরিয়া থেকে হিজাযে আগমন করে তার পথপার্শ্বে সামুদ সম্প্রদায়ের ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতিসমূহের ভগ্নাবশেষ এবং তার প্রাচীন চি‎‎হ্নসমূহ দৃষ্টিগোচর হয়। হিজরের এ-স্থানটি—যা হিজরে সামুদ বলে পরিচিত—মাদায়িন শহর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এমনভাবে অবস্থিত যে তার সামনে রয়েছে আকাবা উপসাগর। যেভাবে আদ সম্প্রদায়কে আদে-ইরাম বলা হয়েছে (এমনকি কুরআনুল কারিম ইরাম শব্দটিকে তাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশেষণই বানিয়ে দিয়েছে), তেমনি আদে-ইরামের ধ্বংসের পরবর্তী সম্প্রদায়কে সামুদে-ইরাম বা দ্বিতীয় আদ বলা হয়েছে। প্রাচ্য, বিশেষ করে আরব সম্পর্কে ইউরোপের প্রাচ্যবিদগণের প্রশ্ন হলো, সামুদের মূল কী এবং কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা দুই দলে বিভক্ত হয়েছেন। একদল বলেন, সামুদ ইহুদিদের একটি সম্প্রদায় ছিলো। তারা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করেনি; বরং এখানেই বসতি স্থাপন করেছিলো। কিন্তু এই বক্তব্য কেবল তথ্যবহির্ভূত নয়; বরং চূড়ান্তভাবে ভ্রান্তিপূর্ণ। কেননা, সকল ইতিহাসবেত্তা এ-বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন যে, হজরত মুসা আ. বনি ইসরাইলকে নিয়ে মিসর থেকে বের হওয়ার অনেক আগেই সামুদ সম্প্রদায়ের বসতিগুলো ধ্বংস ও হেজেমজে গিয়েছিলো এবং তাদের মূলোৎপাটিত করে দেয়া হয়েছিলো। তাছাড়া কুরআনুল কারিমও স্পষ্ট বর্ণনা করছে যে, যখন মুসা আ.-কে ফেরআউন ও তার সম্প্রদায় অবিশ্বাস করলো, তখন ফেরআউনেরই বংশধরদের মধ্য থেকে একজন মুমিন ব্যক্তি তাঁর সম্প্রদায়কে ভীতি প্রদর্শন করেছিলেন এই কথা বলে—তোমাদের এই মিথ্যা-প্রতিপাদনের পরিণাম কখনো যেনো এমন না হয় যা তোমাদের পূর্বে হজরত নুহ আ.-এর সম্প্রদায়, আদ ও সামুদ এবং তাদের পরবর্তী সম্প্রদায়গুলোর তাদের নবিদেরকে অস্বীকার ও মিথ্যা প্রতিপাদনের কারণে হয়েছিলো। প্রাচ্যবিদদের দ্বিতীয় দল বলেন, এরা (সামুদ সম্প্রদায়) আমালিকা সম্প্রদায়ের একটি শাখা ছিলো এবং ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরের বসতি ত্যাগ করে এখানে বসতি স্থাপন করেছিলো। তাঁদের মধ্যে কারো কারো ধারণা, এরা আমালিকা সম্প্রদায়ের একটি দল, যাদেরকে মিসরের বাদশাহ আহমাস মিসর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তারা মিসরে অবস্থানকালে পাথর কেটে গৃহনির্মাণ শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছিলো। এ-কারণে তারা হিজরে গিয়ে পাহাড় ও পাথর কেটে অনুপম প্রাসাদসমূহ নির্মাণ করলো এবং সাধারণ প্রচলিত নিয়মেও বিরাট বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করলো। কিন্তু আমরা আদ সম্প্রদায়ের ঘটনায় এ-কথা প্রমাণ করে এসেছি যে, আদ ও সামুদ উভয় সম্প্রদায়ই সামের বংশধরভুক্ত। আর এটাও প্রমাণ করেছি যে, আরববাসীগণ কেবল ইহুদিদের ভুল অনুসরণের কারণে এদেরকে আমালিকা সম্প্রদায়ভুক্ত বলে ফেলে, অথচ এই বংশের সঙ্গে আমলিক বিন উদের কোনোই সম্পর্ক পাওয়া যায় না। সুতরাং, এ-ধরনের বক্তব্য ঠিক নয়। এসব মতের বিপরীতে প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানীদের মত এই যে, সামুদ সম্প্রদায় হজরত হুদ আ.-এর সময়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্প্রদায়েরই অবশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা হুদ আ.-এর সঙ্গে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এটাই বিশুদ্ধ ও প্রবলতম মত। আর হাযরামাউতবাসীর দাবি—সামুদ সম্প্রদায়ের বসতি ও অট্টালিকাগুলো আদ সম্প্রদায়েরই কারিগরি ও শিল্পবিদ্যার ফল—এ-উক্তিটির বিরোধী নয় যে, সামুদ সম্প্রদায় অট্টালিকা নির্মাণশিল্পে বিশেষ দক্ষ ও পরাদর্শী ছিলো এবং তাদের সময়ের ওই অট্টালিকাগুলো তাদের নিজেদের হাতেই নির্মিত। কেননা, প্রথম আদ আর দ্বিতীয় আদ সবসময় আদই বটে। হজরত সালেহ আ. তাঁর সম্প্রদায়ে যে-সম্বোধন করেছিলেন তাও এ-কথা সমর্থন করে— وَاذْكُرُوا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِنْ بَعْدِ عَادٍ وَبَوَّأَكُمْ فِي الْأَرْضِ تَتَّخِذُونَ مِنْ سُهُولِهَا قُصُورًا وَتَنْحِتُونَ الْجِبَالَ بُيُوتًا فَاذْكُرُوا آَلَاءَ اللَّهِ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ স্মরণ করো, আদ জাতির পর তিনি তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন, তিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে তোমরা সমতল ভূমিতে প্রাসাদ নির্মাণ ও পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করছো। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়িও না। [সুরা আরাফ : আয়াত ৭৪] তথ্যসূত্র : কাসাসুল কুরআন, তাফসিরে ইবনে কাসির হাফেজ মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর