
ছবি সংগৃহীত
একাধিকবার হজ না করে গরিব-দুস্থদের আর্থিক সাহায্য করা উত্তম!
আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ০১:২৮
নবী করিম (সা.) বলেছেন, ঈমানের ৭০টির অধিক শাখা রয়েছে, যার সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ আর সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস হটিয়ে দেয়া। (আল মুজামুল কাবির, তবরানি : ৫/৭৫)। বোঝা গেল, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্তরের মাঝে রয়েছে আরও অনেক স্তর। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, তোমরা কি হাজীদের পানি সরবরাহ ও মসজিদুল হারাম আবাদকরণকে সেই লোকের সমান মনে করো, যে ঈমান রাখে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি এবং যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে, এরা আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান নয়। (সূরা তওবা : ১৯)। বোঝা গেল, ইসলামের সব বিধান সমান নয়। সব আমলের মর্যাদা এক নয়। আমাদের দেশে এরূপ অনেক লোক পাওয়া যায়, যারা তাদের অধীনে চাকরি করে শ্রমিক হিসেবে অথচ তাদের প্রাপ্য মজুরি ও ন্যায্যমূল্য পরিশোধ করা হয় না। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার করে, অধীনস্থদের তাদের পাওনা থেকে বঞ্চিত করে। আবার দেখা যায় এ ধরনের কিছু লোক কিন্তু প্রতি বছর হজ করে। তাদের জানা থাকা দরকার যে, প্রতি বছর নফল হজের চেয়ে মানুষের অর্থনৈতিক হক আদায় করা তার চেয়ে উত্তম। ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা ফরজ আদায় করার আগে নফল কবুল করেন না। আর যে ব্যক্তি ফরজ আদায় করার পর নফলের সুযোগ পায় না সে মাজুর। কিন্তু যে ব্যক্তির নফল ইবাদতে মশগুল হওয়ার কারণে ফরজ ছুটে যায় সে ধোঁকাগ্রস্ত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, শেষ যুগে মানুষ খুব বেশি হজ করবে। তাদের জন্য সফর খুবই আসান হবে। ধন-সম্পদের প্লাবন সৃষ্টি হবে। জনমানব ও তরুলতাহীন মরুভূমিতে একজন ব্যক্তি তার উট হাঁকাবে এবং হজের সফরে যাবে। অথচ তার প্রতিবেশীর অবস্থা খুবই খারাপ থাকবে। কিন্তু দরিদ্র প্রতিবেশীর অবস্থা নিয়ে তার ভাবনা থাকবে না। হাদিসের উদ্দেশ্য হলো, তারা হজের উদ্দেশে মরুভূমি ও জনমানবহীন জায়গায় সফর করবে এবং তার প্রতিবেশীকে এত নাজুক অবস্থা রেখে যাবে যে, তারা ক্ষুধার্ত, দরিদ্র এবং প্রয়োজনের সম্মুখীন হয়ে থাকবে। তাদের অবস্থা কেউ জিজ্ঞেস করবে না। এটিই হচ্ছে বর্তমানে। ঘন ঘন হজ করার চেয়ে উত্তম হলো, সমাজের অনাথ-অসহায়, ক্ষুধার্ত ও বিধবাদের খাবার দেয়া, আশ্রয় দেয়া এবং আর্থিক সাহায্য করা আর অসুস্থকে সুস্থতার জন্য চিকিৎসার খরচ দেয়া, এতিমদের দায়িত্ব গ্রহণ করা, অসহায় নারীদের জরুরত পূর্ণ করা। এশিয়া, আফ্রিকা ও অন্যান্য অনেক দেশে ইবাদতের জন্য মসজিদ-মাদরাসা নেই, সেসব স্থানে মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা অন্যান্য নেক কাজে শরিক হওয়া। তাছাড়া দারিদ্র্যপীড়িত বিভিন্ন মুসলিম দেশে খ্রিস্টান মিশনারি ও এনজিওগুলো সচ্ছলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যাদের কাজ ইসলামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা, মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরানো, মুসলিমদের ইসলাম থেকে খারিজ করা এবং খ্রিস্টান বানাতে না পারলেও কমপক্ষে তাদের ইসলামের চেতনা নড়বড়ে করে দেয়া। আবার অনেক ইসলামী প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে পারে না শুধু অর্থের অভাবে। এর জন্য মুসলমানদের সম্পদ স্বল্পতা দায়ী নয়। বর্তমানে অনেক মুসলিম দেশই বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আবার দাতা ও ব্যয়কারীরও অভাব নেই; কিন্তু অনেক অর্থ ও দানই অপাত্রে করা হচ্ছে। অবহেলিত হচ্ছে প্রয়োজনীয় খাত। আরেকটি বিষয় হল, একশ্রেণীর লোক হজকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। হজের মত একটি পবিত্র ইবাদতকে ব্যবসা হিসেবে নেয়া এবং হাজীদের নিয়ে প্রতারণা, ভাল থাকা-খাওয়ার লোভ দেখিয়ে মক্কা ও মদীনা শরিফে গিয়ে সে ওয়াদার বরখেলাপ করা জঘন্যতম অন্যায়। এর খেসারত নিশ্চয়ই অতি মারাত্মক। এখন মুসলমানের সাহায্যের খুব প্রয়োজন। মুসলমানরা আজ বড় দুর্দিন পার করছে। বিশ্বে তারা আজ ভয়ানক এক সঙ্কটের জালে জড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বের মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি অপদস্থ ও অসহায়ত্বের শিকার। অপরদিকে কাফের, মোশরিক ও নাস্তিকরা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মুসলমানদের ওপর তারা বিভিন্নভাবে ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার করছে। প্রতিনিয়ত মুসলিম জনপদ কোনো না কোনো মজলুম মুসলমানের রক্তে রক্তাক্ত হচ্ছে। তাই বর্তমানে বিশ্বের অসহায় মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে আসা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি গুরুত্ব বহন করে। মানুষের মাঝে এ সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। প্রতি বছর যে লাখ লাখ মুসলমান নফল হজ ও ওমরা পালন করেন তারা যদি তাদের নফল হজের অর্থ ইসলামী প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে খরচ করেন অথবা ইসলামী ফান্ডগুলো স্ফীত করতে সাহায্য করেন, আর তা সঠিকভাবে ব্যয় করা হয় তাহলে তা পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্য আর্থসামাজিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারে। ইসলামের পথে একনিষ্ঠভাবে দাওয়াতরত ব্যক্তিরা এর দ্বারা খিস্টান মিশনারি, সমাজতন্ত্রী, নাস্তিক প্রভৃতি প্রাচ্যের ধর্মহীন ষড়যন্ত্র তথা উম্মাহর মাঝে অনৈক্য বজায় রাখা, বিশুদ্ধ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি সংরক্ষণ ইত্যাদি মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। এসব ধর্মীয় কাজে টাকা ব্যয় করা নফল হজের তুলনায় অবশ্যই বেশি উত্তম। প্রত্যেক মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই। একজনের প্রতি অপরজনের অর্থনৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, পুরো সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন। আল্লাহর কাছে প্রিয় সৃষ্টি হলো, যে তার সৃষ্টির প্রতি সদয় আচরণ করে। যারা দুনিয়ার জীবনে এতিম, মিসকিন, অসহায় ও বন্দিদের উপকার করে আল্লাহ তায়ালা তাদের আখেরাতে জান্নাত ও জান্নাতের অনেক নেয়ামত দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। এতিম, মিসকিনদের প্রতি সহায়তা দান জান্নাতিদের স্বভাব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, তারা দুনিয়ার জীবনে খাদ্যদ্রব্যের প্রতি নিজেদের আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও কয়েদিদের আহার দান করে। (সূরা দাহর : ৭৬)। মজলুমকে সাহায্য করা আর জালিমকে বাধা দেয়া ঈমানি দায়িত্ব। কোনো মুসলমান যদি এর বিপরীত করে অর্থাৎ মজলুমকে জালেমের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা না করে, অথবা জালিমকে বাধা না দেয়, তবে সে ব্যক্তি ইসলামের অবারিত নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে। হজরত আউস ইবনে শুরাহবিল (রা.) থেকে এক হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি জালেমের সঙ্গে থেকে তাকে শক্তি জোগায় অথচ তার জানা আছে যে, লোকটি জালেম; তবে সে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। (বাইহাকি, মেশকাত : ৪৩৬)। অবশ্য এজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনো সংস্থা গঠিত হতে পারে, যার কাজ হবে বিষের ধনাঢ্যদের টাকা উত্তোলন করে অসহায় মজলুম মুসলমানদের দেখাশোনা করা। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। সঠিক বিষয় আল্লাহই ভালো জানেন। মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব সৌজন্যে : দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ