ছবি সংগৃহীত

আশারায়ে মুবাশশিরিন-৬ : অন্তর্বর্তী খলিফা হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)

priyo.Islam
লেখক
প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৪:০৯
আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ০৪:০৯

ইসলাম ও মানবতার কল্যাণে বিশেষ অবদানের জন্য যাঁরা রাসুলের পবিত্র জবানে জীবদ্দশায় জান্নাতের শুভ সংবাদ লাভ করেছিলেন, প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করে যাঁরা 'সাবেকিনে আওয়ালীন'-এর বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)। জাহেলি যুগে তাঁর নাম ছিল 'আবদে আমর' মতান্তরে 'আবদে কাবা'। ইসলাম গ্রহণের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর নাম রাখেন 'আব্দুর রহমান'। তাঁর মায়ের নাম ছিল 'শিফা'। তাঁর মা-বাবা উভয়েই 'যুহরা' গোত্রের লোক। হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ৫৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। সে হিসেবে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে ১০ বছরের ছোট ছিলেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রেসালাত লাভের আগে মক্কার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ হজরত আবু বকরের বাড়িতে নিয়মিত বৈঠক করতেন। উসমান, সাদ, তালহা, যুবাইর ও আব্দুর রহমান ইবনে আউফ সে বৈঠকের নিয়মিত সদস্য ছিলেন বলে ঐতিহাসিকদের মত। আর ওই পাঁচজনই হজরত আবু বকরের প্রেরণায় ইসলামের সূচনা লগ্নে মুসলমান হয়ে যান এবং তাঁরা পাঁচজনই জীবদ্দশায় রাসুল (সা.)-এর মুখে জান্নাতের শুভ সংবাদ লাভ করেন। তাঁরা সবাই 'সাবেকিনে আওয়ালীন'-এর মর্যাদাপ্রাপ্ত। একবার কোনো এক ব্যাপারে হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফের সঙ্গে বচসায় লিপ্ত হন। বিষয়টি রাসুলে করীম (সা.) অবগত হয়ে হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে ডেকে সাংঘাতিকভাবে তিরস্কার করেন। তিনি বলেন, 'সাবেকিনে আওয়ালীন' একজন সাহাবির সঙ্গে এভাবে তর্ক ও ঝগড়া করা তোমার জন্য শোভনীয় নয়। আল্লাহর শপথ তুমি যদি উহুদ পাহাড় সমপরিমাণ স্বর্ণের মালিক হয়ে যাও এবং তার সম্পূর্ণটা আল্লাহর রাস্তায় দান করে দাও, তাহলেও তুমি আমার ওই সব সাহাবির কারো সমকক্ষ হতে পারবে না।' প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) ষষ্ঠ হিজরিতে খন্দকের যুদ্ধের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। যৌবনের শুরুতেই ইসলাম গ্রহণ করে হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ইসলাম প্রচারে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত হন। 'দারুল আরকামে' রাসুলে করীম (সা.)-এর মজলিসের তিনি ছিলেন নিয়মিত অংশগ্রহণকারী। ইসলামের সূচনালগ্নে যাঁরা আল্লাহর দ্বীন কবুল করেছিলেন তাঁরা সবাই কাফির-মুশরিকদের চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। জীবন ও দ্বীন রক্ষার্থে তাঁকে প্রিয় জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে একাধিকবার হিজরত করতে হয়েছে।আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ছিলেন সাংঘাতিক কর্মতৎপর, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন এবং আত্মনির্ভর ব্যক্তি। মদিনায় হিজরত করার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে মদিনার বিশিষ্ট সম্পদশালী ব্যক্তি হজরত সাদ ইবনে রাবীর সঙ্গে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন দেন। সাদ ইবনে রাবী ছিলেন অত্যন্ত উদার প্রকৃতির লোক। তিনি আব্দুর রহমান ইবনে আউফকে বললেন, 'আমি কবিলায়ে খাজরাজের বিশিষ্টজন। সবাই জানেন আমি মদিনার সম্পদশালীদের একজন। আমার যা সম্পদ আছে সমান দুই ভাগ করে এক ভাগ আপনাকে দিয়ে দিতে চাই। আর আমার দুজন স্ত্রী আছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁকে আপনার পছন্দ হয় আমি তাঁকে তালাক দিয়ে দেব। আপনি তাকে বিয়ে করে নিবেন। দ্বীনি ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বললেন, ভাই এ সবের কোনোই প্রয়োজন নাই। আপনি শুধু আমাকে বাজারের পথ দেখিয়ে দেন। মদিনা গমনের দ্বিতীয় দিন থেকেই তিনি 'কায়নুকার' বাজারে ব্যবসা শুরু করেন। সামান্য ঘি আর পনির দিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে যান। হজরত উসমানের পর সাহাবাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সফল ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) অল্প দিনের মধ্যেই এক আনসারি মহিলাকে বিবাহ করেন। মক্কার মুশরিক ও ইসলামের দুশমনরা বার বার ইসলাম ও মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে আক্রমণ করেছে। ফলে বদর, উহুদ, খন্দক, হুনাইনের মতো বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) প্রায় সব যুদ্ধেই অসামান্য অবদান রেখেছেন, বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেছেন। উহুদের যুদ্ধে হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন। ইবনে হাজারের মতে, উহুদের দিন তিনি সারা শরীরে মোট ৩১টি আঘাত প্রাপ্ত হন।রাসুল (সা.) ও তাঁর পরিবারের জন্য আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ছিলেন সর্বদা মুক্তহস্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে খুবই ভালোবাসতেন। তাবুক অভিযানকালে একদিন আল্লাহর রাসুল (সা.) ফজরের সময়ে প্রাকৃতিক প্রয়োজন মিটাতে বাইরে গেলে ফিরে আসতে বিলম্ব হয়। এদিকে সূর্যোদয়ের সময় নিকটবর্তী হয়ে এলে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) সমবেত সাহাবিদের অনুরোধে ইমাম হয়ে নামাজ শুরু করে দেন। এক রাকাত শেষে রাসুলুল্লাহর উপস্থিতি বুঝতে পেরে তিনি পেছনে সরে আসতে চাইলে রাসুল (সা.) তাঁকে নিজ স্থানে থাকতে ইশারা করেন এবং তাঁর পেছনে ইকতেদা করে রাসুল (সা.) নামাজ আদায় করেন। ষষ্ঠ হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) 'দুমাতুল জানদালে' একটি অভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযানে আব্দুর রহমান ইবনে আউফকে আমির নিযুক্ত করা হয় এবং আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজ হাতে তাঁকে পাগড়ি পরিয়ে দেন। হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ছিলেন কোরআন ও হাদিসের জ্ঞানে পরিপূর্ণ, পরামর্শ দানে বিজ্ঞ, বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, ফতওয়া দানে অভিজ্ঞ। তাই প্রথম তিন খলিফাই তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসন দান করেছিলেন। হজরত আবু বকরের খিলাফতকালে আটজন বিশিষ্ট সাহাবিকে ফতওয়া দান ও বিচার কার্য পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। হজরত আব্দুর রহমান ছিলেন ওই আটজনের একজন। হজরত আবু বকর (রা.) অন্তিম শয়ানে তাঁকে ডেকে একান্তে হজরত উমরকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়নের জন্য পরামর্শ করেন। হজরত উমর (রা.) তাঁর খিলাফতকালে হজরত আব্দুর রহমানকে বিশেষ পরামর্শকের মর্যাদা দান করেন। তিনি যখন রাতের বেলায় একাকী মদিনাবাসীর অবস্থা পরিদর্শনে বের হতেন, মাঝেমধ্যে হজরত আব্দুর রহমানকে সঙ্গে নিতেন। খলিফা হজরত উমর (রা.) সাহাবায়ে কেরামের ভাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে জিযিয়া ও খারাজি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এবং আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হজরত উমর (রা.) আবু লুলু কর্তৃক ছুরিকাহত হয়ে যখন মৃত্যু শয্যায়, তখন তিনি পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্যের যে বোর্ড গঠন করে গিয়েছিলেন, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ ছিলেন ওই বোর্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি তাঁর নিজের দাবি ত্যাগ করে উসমানকে (রা.) খলিফা নির্বাচনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মসজিদে নববীর ইমামতিসহ খলিফার যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হজরত উসমানের খিলাফতকালে খলিফার মজলিসে শুরার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ইসলামী খিলাফত ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম হলেও ধন-সম্পদের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র লালসা ছিল না। তিনি খুব সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। ধৈর্যশীলতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাকওয়া বা দায়িত্বনিষ্ঠতা তাঁর চরিত্রে এনে দিয়েছিল এক বিশেষ ঔজ্জ্বল্য। মক্কায় গেলে তিনি তাঁর বাড়িঘরের দিকে ঘুরেও দেখতেন না। লোকে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, এগুলো তো আমি আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিয়েছি। একবার তিনি বন্ধুদের দাওয়াত দিলেন। ভালো ভালো খাবার পরিবেশন করা হলো। খাবার দেখে তিনি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। তাঁকে ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে বললেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বিদায় নিয়েছেন। তিনি নিজের ঘরে যবের রুটিও পেট ভরে খেয়ে যেতে পারেননি। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সম্পর্কে বলতেন, আব্দুর রহমান আসমান ও জমিনের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। তিনি হজরত উসমান (রা.)-এর খিলাফতকালে ৩২ হিজরিতে ৭৫ বছর বয়সে মতান্তরে ৭২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। হজরত উসমান অথবা জুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন এবং মদিনার 'জান্নাতুল বাকী' গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। মোহাম্মদ মাকছুদ উল্লাহ পেশ ইমাম ও খতিব, রাজশাহী কলেজ কেন্দ্রীয় মসজিদ