শেয়ার বাজার মাছের বাজার নয়, তাই গবেষণা জরুরি
শেয়ারবাজার মাছের বাজার নয়—এই বাক্যটি যতটা সরল, এর অন্তর্নিহিত বার্তা ততটাই গভীর। মাছের বাজারে মানুষ যায় দরদাম করে তাজা মাছ কিনতে, বিক্রেতা উচ্চৈঃস্বরে ডাকে, ক্রেতা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়—মুহূর্তের আবেগই সেখানে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু শেয়ারবাজার এমন নয়। এখানে আবেগ, তাড়াহুড়া, হুজুগে সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীকে মুহূর্তেই ক্ষতির দিকে ঠেলে দেয়। কারণ শেয়ারবাজার কোম্পানির অংশীদারিত্বের জায়গা, যেখানে মূল্য নির্ধারিত হয় কোম্পানির আয়, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সেক্টরের অবস্থাসহ নানা গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে অনেকেই শেয়ারবাজারে আসে দ্রুত লাভের আশায়, গবেষণা ছাড়া, তথ্য না জেনে। ফলে বাজার যখন নেমে যায়, আতঙ্ক তৈরি হয়, ক্ষতির বোঝা বাড়ে, আবার যখন দাম বাড়ে তখন সবাই হুড়োহুড়ি করে কিনে ভবিষ্যৎ পতনের মুখে পড়ে। তাই ২০১০ সালের ভয়াবহ পতনের পর প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও বাজার মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী স্থিতিশীল হয়নি—যে বাজারে গবেষণা কম, সেখানে টেকসই উন্নতি ধীরই হবে, এটা স্বাভাবিক।
২০১০ সালের ধসে দেশের লাখো বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সারাদেশে শেয়ারবাজার নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছিল, অনেক পরিবার সঞ্চয় হারিয়েছিল। সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও মানুষের আস্থায় ধস নামে। অথচ একই সময়ে যারা মৌলিক বিশ্লেষণ করেছে, শক্তিশালী কোম্পানির শেয়ার ধরে রেখেছে, তারা দীর্ঘমেয়াদে লাভ পেয়েছে—এ বাস্তবতাও অস্বীকার করা যায় না। ধসের পর গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বেক্সিমকো ফার্মাসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি ডিভিডেন্ড ও ক্যাপিটাল গেইনে বাজারের তুলনায় ভালো রিটার্ন দিয়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী বলেন, “ধসের সময় সবাই বিক্রি করছিল, আমি তখন গবেষণা করে ভালো শেয়ার সংগ্রহ করেছি। সময়ের সাথে লাভ পেয়েছি।” তাদের অভিজ্ঞতা বলে, বাজার পতনেই আসল সুযোগ লুকিয়ে থাকে—যদি বিনিয়োগের ভিত্তি জ্ঞান হয়, গুজব নয়।
বিদেশি বাজারের ইতিহাস আরও বড় উদাহরণ হিসেবে দাঁড়ায়। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দায় S&P 500 সূচক প্রায় ৫০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। ওয়াল স্ট্রিটে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, হাজারো কোম্পানি দেউলিয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছু প্রজ্ঞাবান বিনিয়োগকারী সেই সময় গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় কোম্পানি চিহ্নিত করে কিনেছিল। ওয়ারেন বাফেট এই সময় ব্যাংক অফ আমেরিকা, গোল্ডম্যান স্যাকসসহ গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগে নজীর স্থাপন করেন। দশ বছর পর সেই শেয়ারের মূল্য বহু গুণ বেড়ে যায়। তার বিখ্যাত উক্তি—“Risk comes from not knowing what you are doing.”— অর্থাৎ জ্ঞানের অভাবই আসল ঝুঁকি।
পিটার লিঞ্চ বলেছিলেন, “Know what you own, and know why you own it.” বিনিয়োগের আগে কোম্পানিকে বুঝতে না পারলে শেয়ার কেনা মানে অচেনা জগতে চোখ বেঁধে হাঁটার মতো। বেঞ্জামিন গ্রাহাম—যাকে ভ্যালু ইনভেস্টিংয়ের জনক বলা হয়—বলেছেন, “The intelligent investor is a realist who sells to optimists and buys from pessimists.” অর্থাৎ বাজার যখন অতিশয় আশাবাদী হয়ে ওঠে তখন সতর্ক থাকা উচিত, আর সবাই যখন ভয় পায় তখন সুযোগ তৈরি হয়।
বাংলাদেশের বিনিয়োগ সংস্কৃতিতে বড় সমস্যা হয় গুজব ভিত্তিক ট্রেডিং। অনেকেই “ফলান কোম্পানি শিগগিরিই স্প্লিট দেবে, বোনাস দেবে, দাম বাড়বে”—এমন কথায় বিনিয়োগ করে ক্ষতির মুখে পড়ে। গবেষণা করলে দেখা যেত হয়তো কোম্পানির মুনাফা কমছে, ঋণ বাড়ছে, সেক্টর দুর্বল। আবার যেসব কোম্পানি নিয়মিত ডিভিডেন্ড দেয়, আয়ের স্থিতিশীলতা রয়েছে, ব্যবসার পরিধি বাড়ছে—সেগুলোই দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ। বিদেশে অনেক দেশে বিনিয়োগকারীদের গবেষণা ও বিশ্লেষণ শেখানোর সিস্টেম রয়েছে, স্কুল-কলেজ পর্যায়েই ফাইন্যান্স লিটারেসি শেখানো হয়। ফলে সাধারণ মানুষও জানে কীভাবে ঝুঁকি কমিয়ে লাভ নিতে হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের জ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো শুরুতে। শেয়ারবাজার নিয়ে বই, প্রশিক্ষণ, গবেষণাধর্মী আলোচনা বাড়ানো জরুরি। মিডিয়াতে বাজারের ওঠানামা নিয়ে রোমাঞ্চ নয়, বিশ্লেষণ প্রচার হওয়া উচিত।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গবেষণা
- বিনিয়োগ
- শেয়ারবাজার