মাজার-ভাস্কর্য-বাউল: তালিকা কি দীর্ঘতর হচ্ছে?

বিডি নিউজ ২৪ আজাদুর রহমান চন্দন প্রকাশিত: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫৩

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ যেন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, মাজার, সাধু-সন্ন্যাসী, বাউল-ফকির, সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলা থামছেই না। পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ যখন রাজপথে নেমেছিল, তখন কেউ ভাবতে পারেনি যে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক থেকে বাউলের আখড়া, মাজার থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ—সবকিছুই আবার ধর্মীয় উগ্রতার নিশানায় পড়ে যাবে।


মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শিল্প-সংস্কৃতি ও নাগরিক বোধের ওপর এই সংগঠিত হামলাগুলো প্রশ্ন তোলে—সংস্কার-পরবর্তী বাংলাদেশ ঠিক কোন পথে হাঁটছে? রাষ্ট্রের নীরবতায় ফুলেফেঁপে বিকশিত হচ্ছে ধর্মীয় উগ্রতা, তাদের হামলার তালিকাও দীর্ঘতর হচ্ছে। বাংলাদেশ এগোচ্ছে আত্মবিনাশী পথে, যে পথের বাঁকে ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’ কিনা জিজ্ঞেস করার মতো লোকের বড্ড অভাব দেখা দিয়েছে। যারা আছেন, নিজেদের অনৈক্যে কোনো প্রতিরোধ তৈরি করতে পারছেন না তারা।


বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব হামলায় ইসলামপন্থী একটি গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে, যারা ভয়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। হামলাকারীরা সাধারণত নিজেদের ‘তৌহিদী জনতা’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। তাদের নিবৃত্ত করার ব্যাপারে সরকারের তৎপরতার অভাব স্পষ্ট, প্রশ্ন উঠছে তাদের আন্তরিকতা নিয়েও। সর্বশেষ ঘটনার সূত্রপাত মানিকগঞ্জের ঘিওরে বাউল আবুল সরকার মহারাজের পালাগানকে কেন্দ্র করে।


সেদিন জীব ও পরম—এই দুই পক্ষে লড়াই করছিলেন আবুল সরকার মহারাজ, প্রতিপক্ষের নামও ছিল আবুল সরকার, যিনি ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন। মানিকগঞ্জের আবুল সরকার মহারাজ ছিলেন জীবের পক্ষে, পরমের বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তিনি। চার ঘণ্টার দার্শনিক বাহাসের কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও কেটে ‘ধর্ম অবমাননা’র অভিযোগ তুলে মামলা দেওয়া হয় এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর থেকে এই বাউলশিল্পীর ভক্ত-অনুরাগী, বিশিষ্টজন, শিক্ষক নেটওয়ার্ক, মহিলা পরিষদসহ নানা সংগঠন মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছে। মুক্তি তো দূরের কথা, বাউলদের ওপর হামলাও থামেনি। এরই মধ্যে ২৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জে আবুল সরকার মহারাজের ভক্ত-অনুরাগীদের ওপর প্রথমে হামলা হয়। ২৬ নভেম্বর হামলা হয়েছে ঠাকুরগাঁও ও খুলনায়।


সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতেই হোক আর যে কারণেই হোক, শেষপর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে বাউলদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়ার কথাও বলা হয়।


আদতে কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে বলে শোনা যায়নি, বরং অবস্থার মধ্যেই সারাদেশে বাউলদের ওপর হামলা ও কারাবন্দী বাউল আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে ২৮ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে হামলার চেষ্টা করে জুলাই মঞ্চ নামে একটি ব্যানারে। জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘গানের আর্তনাদ’ নামের ওই কর্মসূচির আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা’। মূলত বামপন্থীদের একটি অংশ ছিল এই আয়োজনের পুরোভাগে।


বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে জুলাই মঞ্চের একদল কর্মী। পরে উভয়পক্ষ মুখোমুখি হলে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ‘গানের আর্তনাদ’ কর্মসূচির আয়োজকদের অভিযোগ, কর্মসূচি চলা অবস্থায় হঠাৎ করে জুলাই মঞ্চের ২০-২৫ জন সেখানে গিয়ে অতর্কিত হামলা করে। হামলাকারীরা মঞ্চ ভাঙচুর করে এবং নারীসহ কয়েকজনের গায়ে হাত তোলে। তারা মাইকে বলতে থাকে যে বাউল আবুল সরকারে মুক্তি দাবি করা যাবে না। প্রতিরোধের মুখে হামলাকারীরা চলে গেলে অনুষ্ঠান আবার শুরু হয়। পরে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদী মশাল মিছিল।


সর্বস্তরের মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বৈষম্যের প্রাচীর ভাঙার জুলাই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটলে সংস্কারের এক প্রবল আবহ ছড়িয়ে পড়ে। সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্য সত্ত্বেও দেশের বেশ কিছু বামপন্থী দল বছরের পর বছর নির্বাচনব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে আমূল সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছে। ওইসব দলের অনেক নেতাকর্মীও মনে করলেন, এবার বুঝি তাদের কাঙ্ক্ষিত সেই সংস্কার হবে! কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট থেকেই একটি বিশেষ মহল ভাস্কর্য-জাদুঘরসহ শিল্প-সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের সব স্মারক ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। জুলাই আন্দোলনের কিছুদিন আগেও ছাত্রলীগের হেলমেটে মাথা-মুখ আড়াল করে রাখা এমনকি সংগঠনটির বিভিন্ন পদপদবি নিয়ে সুবিধা ভোগ করা কেউ কেউ হঠাৎ হিরো সেজে সংস্কারের নামে কখনো জাতীয় সংগীত, কখনো সংবিধানসহ রাষ্ট্রের মৌল চেতনায় আঘাত হানতে শুরু করে।


ধর্মকে শিখণ্ডি করেও এবার যে জুলাই মঞ্চ তেমন একটা সুবিধা করতে পারল না এর প্রধান কারণ, বাম ও উদারপন্থীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারকের ওপর গত দেড় বছর ধরে হামলা চললেও বামপন্থীদের কারও কারও মৌনতা পরোক্ষে সমর্থন জুগিয়েছে হামলাকারীদের। শুধু তাই নয়, বামপন্থীদের একাংশ তাদের সমমনা অপরাংশকে ‘মুজিববাদী বাম’ বলে নিজেদের মধ্যে অনৈক্য তৈরি করেছে।


জুলাই মঞ্চ যে বামপন্থীদের আয়োজনে হামলা করেছে, গত বছরের জুলাইয়ে তারাও কিন্তু কারফিউ অমান্য করে ঢোল-করতাল নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন। জুলাইয়ে তাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির নাম ছিল ‘কারফিউ ব্রেক’ ও ‘গানের মিছিল’। এ ছাড়া চব্বিশের ২ অগাস্টের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি ছিল বাম-প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সবচেয়ে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ। জুলাইয়ে ‘কারফিউ ব্রেক’ ও ‘গানের মিছিল’ আয়োজনের ওই দিনগুলোতে এখনকার হামলাকারীদের কাউকে রাজপথে দেখা যায়নি। ‘গানের আর্তনাদ’ কর্মসূচিতে হামলাকারী সংগঠন জুলাই মঞ্চের আহ্বায়ক হলেন আরিফুল ইসলাম তালুকদার, যিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতা। অভিযোগ আছে, সেই আরিফুল এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন।


শাহবাগে হামলার পরও মার্কিন সহায়তায় মৌলবাদীদের নিয়ে ‘ইনক্লুসিভ’ বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বপ্নে ভাটা পড়বে বলে মনে হয় না। গত দেড় বছর ধরে সংস্কার, নয়া বন্দোবস্ত, বাংলাদেশপন্থা—এমন নানা মুখরোচক বুলি এমনভাবে আওড়ানো হচ্ছে যেন তাদের প্রস্তাবগুলো ছাড়া সংস্কার বা নয়া বন্দোবস্ত বলে আর কিছু নেই। যারা ওইসব বুলি আওড়ে গলা ফাটাচ্ছেন তাদের কথাবার্তায় মনে হয়, তারা ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশপন্থী নন, এমনকি যারা রণাঙ্গণে লড়াই করে দেশটি স্বাধীন করেছিলেন তারাও নন। সংস্কারের নামেও দেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা দৃশ্যমান। সুফিবাদী, বাউল, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ প্রগতিমনা ব্যক্তি-সংগঠনের ওপর হামলার ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিরোধী মতাদর্শের ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে কাফের-ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে কোণঠাসা করার অপচেষ্টা মাথাচাড়া দিচ্ছে। রাজনীতিতে ধর্মের এমন অপব্যবহার এক আত্মবিনাশী পথ ছাড়া আর কিছুই নয়।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও