সুন্দরবন থেকে আমাজন বন ঝাঁঝরা কেন
পর্তুগিজ উপনিবেশের সময় তৈরি বেলেম শহরের দালানগুলো যেন সকালের রোদে গনগন করছে। আমাজন অঞ্চলের প্রথম ঔপনিবেশিক শহর এটি। আমাদের জন্য আমাজনীয় নাশতার আয়োজন হলো ১৩ তারিখ সকালে। টাপিওকা পাটিসাপটা, ম্যানিওক আলু সেদ্ধ, আচায়ে ফল, পাকা আম, টুকুপি ও পেয়ারার শরবত। আমাজন বনের ফল আচায়ে আজ ‘সুপারফুড’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
নাশতা খেতে খেতে ব্রাজিল, পেরু ও ইকুয়েডরের আমাজন অঞ্চলের বন্ধুরা বিশ্বের বড় বনের নিদারুণ দশা বর্ণনা করছিলেন। জঙ্গলজুড়ে বাণিজ্যিক খনন, পরিবেশ-হত্যা, বন নিধন, আদিবাসী বসতি উচ্ছেদ, বন্য প্রাণী পাচার, লুটতরাজ, প্রাণ ডাকাতি চলছে প্রশ্নহীনভাবে। বাংলাদেশের সুন্দরবনসহ লাউয়াছড়া, রেমা-কালেঙ্গা, সাতছড়ি, লাঠিটিলা, রাতারগুল, পাবলাখালী, সাঙ্গু, সিংড়া, আলতাদীঘি কিংবা মধুপুর শালবনের ওপর লাগাতার উন্নয়ন আঘাতের গল্পগুলোও সকালের নাশতার টেবিলে নিয়ে আসি। বিশ্বজুড়ে সব বনের গল্পই রক্তাক্ত, নয়া উদারবাদী আগুনে চূর্ণবিচূর্ণ।
বেলেম সম্মেলনের প্রথম চার দিনের বহু অধিবশনে বনকে কেবল কার্বন-শোষণাগার হিসেবে না দেখে জীবনপ্রবাহ হিসেবে দেখার দাবি উঠেছে। বনের ওপর সব ধরনের অন্যায় বাণিজ্যিক নিপীড়ন বন্ধ করার দাবি উঠেছে। আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (১৯৯২) কিংবা গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত বন ও বৃক্ষ সুরক্ষার ঘোষণার (২০২১) বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। তাহলে বছরের পর বছর জলবায়ু সম্মেলনের কী দরকার? যখন দিনদুপুরে বিশ্বনেতাদের সামনে খুন হচ্ছে আমাজন।
আমাজনে বন-ডাকাতি আর লুটপাট
জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থলসহ বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান সংরক্ষণে কাজ করা বৈশ্বিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের (ডব্লিউডব্লিউএফ) তথ্যমতে, বিশ্বের বৃহত্তম বন হলেও এই বন পৃথিবীর মোট আয়তনের মাত্র এক ভাগ। জাগুয়ার, ডলফিন, ম্যাকাউ পাখি, আর্মাডিল্লো, পিরানহা আর অ্যানাকোন্ডার আবাসস্থল এই বন।
১৫ হাজার কোটি থেকে ২০ হাজার কোটি টন কার্বন শোষণ করে রাখা এই বন প্রতিদিন ২ হাজার কোটি টন পানি ছাড়ে বাতাসে। ৩০০ ভাষাভাষী প্রায় ২২ লাখ আদিবাসী জাতির ঠিকানা এই বন। প্রায় ৩৭টি বাংলাদেশের সমান এই বন ছড়িয়ে আছে ব্রাজিলসহ ৯টি দেশে। ‘আধুনিক ওষুধের’ প্রায় ২৫ ভাগ এসেছে এই বন থেকে।
কিন্তু মানুষ এই বনের অবদান মনে রাখেনি। কাঠ বা ঔষধি গাছ ডাকাতি, তেল-গ্যাস-কয়লা উত্তোলন, সোনা-তামা খনির নামে প্রতিদিন ঝাঁঝরা হচ্ছে আমাজন। পতুর্গিজ উপনিবেশ থেকে লুটতরাজ শুরু হলেও আজ নয়া উদারবাদী মুনাফার আগুনে পুড়ছে আমাজন। ১২ নভেম্বর আমাজন বনবিষয়ক এক অধিবেশনে ব্রাজিলের কারিপুনা আদিবাসী নেতা লুয়েনে কারিপুনা জানান, ‘৬০ বছর ধরে খনিজ উত্তোলনের নামে আমাজন বন এবং আদিবাসীদের জীবন ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে। কোনো বন্য প্রাণী, গাছপালা, মানুষ কেউ থাকতে পারছে না। এত জীবাশ্ম জ্বালানি আর খনিজ না তুললে কি আমাদের চলবে না?’
লুয়েনের কথায় চোখের সামনে বাংলাদেশের পুড়ে যাওয়া লাউয়াছড়া বন ভেসে ওঠে। মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল, শেভরন ও ইউনোকল গ্যাস খননের নামে উল্লুক গিবনের প্রিয় বনটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। সেই পরিবেশ-গণহত্যার কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি এখনো বাংলাদেশ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি