ট্রাম্প থেকে শুরু করে মোদি—যেকোনো ডানপন্থী রাজনীতি টিকেই থাকে কোনো জনগোষ্ঠী কিংবা নাগরিকদের একটি অংশের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ জারি রেখে। ঘৃণা হচ্ছে এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। জাতিকেন্দ্রিক হোক আর ধর্মকেন্দ্রিক হোক, জাতীয়তাবাদ ধরনের দিক থেকে এমনিতেই খারিজিমূলক। নয়া উদারবাদী বিশ্বব্যবস্থায় সম্পদের গরিষ্ঠ অংশ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের ঘষায় হাতে গোনা কয়েকজনের কাছে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় দুর্বিষহ বেকারত্ব ও কায়দা করে বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্যে বিশ্বের দেশে দেশে নতুন ধারার ডানপন্থার জোয়ার দেখা যাচ্ছে। এ ব্যবস্থায় প্রাণভোমরায় কোনো গোষ্ঠীকে এমনভাবে শয়তানরূপে আঁকা, যাতে মনে হবে, জনগণের সব দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে সেই জনগোষ্ঠী।
দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প সে কারণেই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছেন। শিকলে বেঁধে সামরিক বিমানে করে অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছেন। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তথাকথিত ঘৃণার আগুনও আবার ডলারের তেজের কাছে পানি হয়ে যায়। ট্রাম্প নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, ৫০ লাখ ডলারে কেনা যাবে মার্কিন নাগরিকত্ব। ফলে এখানে ঘৃণা আর বিদ্বেষটাও রাজনৈতিক আর সিলেক্টিভ; অথচ যুক্তরাষ্ট্র দেশটাই গড়ে উঠেছে অভিবাসীদের হাতে।
ভারতে মোদি, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যের রাজনীতির প্রাণভোমরাও মুসলিম, দলিত ও আদিবাসীদের প্রতি ঘৃণা। এখানেও মূল শিকার গরিব ও প্রান্তিক লোকেরা। গরুর মাংস রপ্তানিতে ভারত বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ হলেও গোরক্ষার নামে ‘মব লিঞ্চিং’ সে কারণেই রাজনৈতিক বৈধতা পায়। বুলডোজারে বাড়িঘর, স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়াটাও রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে ওঠে। কেননা, তাতে সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে উন্মাদনা তৈরি করা যায়, আফিমের নেশার মতো ভুলিয়ে রাখা যায় বাস্তব জীবনের দুর্বিষহ সংকটগুলোকে।
অভিবাসী খেদানো, বুলডোজারে গুঁড়ানো আর উচ্ছেদ বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী অভিধানের প্রিয় সব শব্দে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভার্চু৵য়ালি এই যুদ্ধ জারি রাখা, অ্যালগরিদমকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা ব্যাপক বিনিয়োগ করে। যেকোনো বিরোধী মতের মানুষের জন্য এই ভার্চ্যুয়াল যোদ্ধারা রীতিমতো আতঙ্কের নাম।
দুই.
ওয়ার আর টেররের দীর্ঘ দুই দশকের অভিঘাত, নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সম্পদের পূঞ্জীভবন ও পাচার, হাসিনার দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসন—বাংলাদেশের সমাজে পরিষ্কারভাবে ডানপন্থার উল্লম্ফন ঘটিয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের বড় একটি অংশের মধ্যে ডানপন্থী রাজনীতির বিস্তার ঘটেছে। সম্প্রতি ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ জয়ে তার ইঙ্গিত মিলেছে।
২০০৮ সালের পর দেশে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়ায় কত শতাংশ নাগরিক ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন, সেটি ধারণা করা কঠিন। ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়ে দেশের সামগ্রিক রাজনীতির ল্যান্ডস্কেপ সম্পর্কে ধারণা করাটাও বাস্তবসম্মত নয়; কিন্তু মধ্যপন্থী ও উদারপন্থী রাজনীতি যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, সেটি স্পষ্ট।
গত কয়েক সপ্তাহে জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মূলধারার গণমাধ্যমের খবর ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনা-তর্কবিতর্কের অন্যতম একটি কেন্দ্র হয়ে রয়েছে। ডাকসু নেতারা ক্যাম্পাস থেকে হকার, ভবঘুরে, ভাসমান পরিবার ও পথশিশুদের উচ্ছেদে রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছেন। একজন তো এই হুমকি দিয়ে বসেছেন যে এ উচ্ছেদ অভিযান সফল না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়নি। কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জোরালোভাবেই উচ্ছেদ অভিযানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, ডাকসু নেতারা মিছিল নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছেন। মানুষের জীবিকার সম্বলগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অভিযানের সময় কয়েকজন হকারকে পেটানোর অভিযোগও উঠেছে। এভাবে উচ্ছেদ করা যে কতটা ঠিক ও ন্যায্য, এর পক্ষে উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডাকসুর একজন নেতাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডাকসুর একজন নেতাকে সাফাই গাইতে দেখা গেছে।
সংগঠনের অন্য নেতা-কর্মীরও এ কাজ যে বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য, তা প্রমাণে সংঘবদ্ধ প্রচারে নেমেছেন। যাঁরা এভাবে উচ্ছেদ ও পেটানোর সমালোচনা করেছেন, তাঁদের গাঁজাখোর, মাদকসেবী, চাঁদাবাজের সহযোগী তকমা দিয়েছেন। অতি সম্প্রতি আরেকটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ডাকসুর সেই আলোচিত নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রো স্টেশনের কাছে লাঠি হাতে একজন বৃদ্ধকে শাসাচ্ছেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- উচ্ছেদ অভিযান
- ডাকসু
- ভাসমান মানুষ