বামপন্থা, গণতন্ত্র ও প্রগতিশীলতা : বাংলাদেশে পরিচয়ের রাজনীতি

যুগান্তর ড. হাসান মাহমুদ প্রকাশিত: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৩৮

বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ‘বাম’ এবং ‘ডান’-এ দুটি পরিভাষা শুধু আদর্শগত নয়, বরং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অর্থও বহন করে। কেউ কেউ বলে থাকেন, বামপন্থা হলো গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক, মানবিক ও প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতীক। এর বিপরীতে ডানপন্থাকে চিত্রিত করা হয় অগণতান্ত্রিক, অসহিষ্ণু ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসাবে। এ বিভাজন প্রবণতা কেবল রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য নয়; এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠন, মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ এবং জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তবে প্রশ্ন হলো-এ ধারণাগুলো কতটা ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রতিফলন, আর কতটা রাষ্ট্র ও সমাজের তৈরি করা পাবলিক ন্যারেটিভ?


১. মুক্তিযুদ্ধ ও বাম-উদার ঐতিহ্যের জন্ম : মূলধারার ইতিহাস হিসেবে দাবিকারীদের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে একটি মুক্তির আন্দোলনের মাধ্যমে, যা সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল।


তাদের দাবি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল শুধু পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেই নয়, বরং একটি সমাজমুখী, মানবমুক্তির সংগ্রাম। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও ‘সমাজতন্ত্র’-এর ভিত্তিতে রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন। এ রাজনৈতিক কাঠামো বামপন্থাকে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতীয় চেতনার কেন্দ্রে স্থাপন করে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার হিসাবে বামপন্থা হয়ে ওঠে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈধতার ধারক, আর ডানপন্থাকে বিশেষত ইসলামধর্মনির্ভর রাজনৈতিক ধারা, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এ সূত্র থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বাম মানেই ‘প্রগতিশীলতা’ এবং ডান মানেই ‘প্রতিক্রিয়া’ এ মানসিক প্রতীকায়ন গড়ে ওঠে।


২. বামপন্থার পাবলিক ন্যারেটিভ : গণতন্ত্র, উদারতা ও প্রগতিশীলতা : বামপন্থি দল ও সংগঠনগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের রক্ষক হিসাবে পাবলিক ন্যারেটিভে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে। স্বাধীনতার পরপরই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী-বাকশালী সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকারের রাজনীতি শুরু করে এবং সরকারি বাহিনী ও আওয়ামী লীগের হাতে তীব্র অত্যাচারের শিকার হয়। ১৯৮০-৯০ দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনেও ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক দল ও নাগরিক সংগঠনগুলো সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়; যা বাম রাজনীতিকে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারক হিসাবে জনপ্রিয় করেছে বলে দাবি করা হয়।


তাদের বক্তব্য, বামপন্থার মূল শক্তি তার ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতাবাদী মনোভাব। ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি এবং ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের মাধ্যমে বাম ও লিবারেল শক্তিগুলো প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের উত্তরাধিকারী।


এ ধারাবাহিকতা বাম রাজনীতিকে ‘প্রগতিশীল’ ও ‘নৈতিকভাবে উচ্চতর’ হিসাবে প্রতীকায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়া হিসেবে অভিহিত অংশটিতে তাদের প্রভাব ব্যাপক থাকায় তারাই বামপন্থা ও ডানপন্থার সংজ্ঞা নির্ধারণ করছে।


৩. ডানপন্থার ইমেজ : বাংলাদেশে ডান রাজনীতির উৎস ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যে বলে বামধারা থেকে দাবি করা হয়ে থাকে। তারাই জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থি দলগুলো মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশবিরোধী ভূমিকা এবং পাকিস্তানপন্থি অবস্থানের কারণে অগণতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করে।


জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন বাংলাদেশের ডান রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় বলে বলা হয়ে থাকে। এ সময় সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া, ‘ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম’ করা এবং বাজারমুখী অর্থনীতি প্রবর্তন করা হয়; যা ডান রাজনীতিকে গণতন্ত্রবিরোধী ও কর্তৃত্ববাদী ধারা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি, বামপন্থি ‘গণতন্ত্র বনাম সামরিক শাসন’ বয়ানের বিপরীতে ডানপন্থাকে দাঁড় করানো হয় ‘প্রথাগত, সংস্কারবিরোধী’ এবং শৃঙ্খলা ও কর্তৃত্বের অনুগামী হিসাবে। সাম্প্রতিক উদাহরণ যেমন ২০১৩ সালের হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন, ২০২১ সালের মূর্তি ও কার্টুন ইস্যু, কিংবা ধর্মনিন্দা বিতর্ক-সবকিছুই জনমনে ডান রাজনীতিকে অসহিষ্ণু ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চলে। এ ধারাকে কেউ কেউ ‘ইসলামি ফ্যাসিবাদ’ বা ‘সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।


৪. সমসাময়িক রাজনীতি ও বয়ানের রূপান্তর : যদিও বাম-উদার বয়ান এখনো বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মূলধারা নিয়ন্ত্রণ করে, বাস্তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রটি এখন প্রায় সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রনির্ভর ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। সদ্য সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীলতার উত্তরাধিকার বহন করলেও বাস্তব রাজনীতিতে অর্থনৈতিক উদারীকরণ, প্রশাসনিক কর্তৃত্ববাদ ও বিরোধী দমন বাম ধারার মূল্যবোধের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং ডানপন্থার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একজোট হয়ে রাজনীতি করার কারণে বামপন্থার প্রগতিশীলতা ও উদারনৈতিকতার প্রতি সাধারণ জনতার মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি, ডানপন্থার ধর্মীয় ভাষ্য, সমাজে ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতিকে শক্তিশালী করে তুলছে। ফলে প্রগতিশীলতা মূলত প্রতীকী ও ন্যারেটিভ শক্তি, বাস্তব রাজনৈতিক কর্মধারা নয়।


বাম দলগুলো সাংগঠনিকভাবে দুর্বল, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং জনসংযোগে সীমিত। তারপরও, বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজ, একাডেমিয়া ও গণমাধ্যমে বামপন্থা ও উদারধারার প্রভাব ঐতিহাসিকভাবে প্রবল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম, সাহিত্য ও নাট্যচর্চা, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সবখানেই প্রগতিশীলতার ভাষা প্রাধান্য পায়। ফলে ডান রাজনীতি অনেক সময় জনসাধারণের ভোটে শক্তিশালী হলেও সংস্কৃতিগত বৈধতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও