সংবিধান সংস্কার নিয়ে ২৭০ দিনের বাধ্যবাধকতা প্র্যাকটিক্যালি অসম্ভব
রিদওয়ানুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা এবং গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও বিচারিক সক্রিয়তা নিয়ে তাঁর লেখা ও সম্পাদিত বই বের হয়েছে দেশের বাইরের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ, গণভোট, সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দিয়েছে। এরই মধ্যে এই সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দল এটাকে ইতিবাচক বলছে, আবার কোনো রাজনৈতিক দল এটাকে অসংগতিপূর্ণ বলে দাবি করেছে। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাইছি।
রিদওয়ানুল হক: ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে কিছু অসংগতি যেমন রয়েছে, তেমনি জটিলতাও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে গণভোটের প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমি মনে করি, জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট একটা ভালো উদ্যোগ এবং এটা করা সম্ভব। কিন্তু সেই গণভোট হতে হবে সুনির্দিষ্ট একটি প্রশ্নের ওপর। গণভোটের প্রশ্ন দীর্ঘ ও জটিল হলে সাধারণ মানুষের তা বুঝতে সমস্যা হবে। এর ফলে যে উদ্দেশে্য গণভোট, সেটা সফল না–ও হতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ঐকমত্য কমিশন এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়নি।
আরেকটা জটিলতা বা অসংগতি দেখা দিয়েছে নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে। এ ধরনের প্রক্রিয়ায় নোট অব ডিসেন্ট বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নোট অব ডিসেন্ট থাকা মানে হলো সব বিষয়ে নয়, কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। যে রাজনৈতিক দলের যে বিষয়ে ভিন্নমত বা আপত্তি রয়েছে, তারা সেই প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। এর ফলে ক্ষমতায় এলে সেই দলকে তার নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য চাপ দেওয়া বা জোর করা যাবে না।
নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে বিএনপির অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়া দরকার ছিল। কারণ, বিএনপি একটা বড় দল। তারা ঐকমত্য কমিশনের সব প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছে এবং কিছু প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন যেভাবে নোট অব ডিসেন্ট বাদ দিয়ে সুপারিশ করেছে, তাতে বিএনপি নিজেদের প্রতারিত মনে করতেই পারে। এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয়, পুরো প্রক্রিয়ায় কিছু অস্বচ্ছতা ও আস্থার অভাব রয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, কমিশন কিছু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চেয়েছে, যেটা কমিশনের কাজ নয়।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। সেটা করতে না পারলে ২৭০ দিন পর প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে। এভাবে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সংবিধান সংস্কার করা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, সমালোচনা করেছেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
রিদওয়ানুল হক: ভবিষ্যতে নির্বাচিত যে সংসদ আসবে, সেটা আবার সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে—কমিশনের এই সুপারিশটাও একটা অসংগতিপূর্ণ ধারণা। নির্বাচিত সংসদ সংবিধান সভা বা কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি হিসেবে কাজ করতে পারে, যদি সেটা নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তো নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। তারা তো কিছু যোগ–বিয়োগ করে বর্তমান সংবিধানই বহাল রাখার কথা বলেছে। সংবিধানের যে ৪৮টি অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করার কথা বলা হচ্ছে, সেটা তো সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করেই করা সম্ভব। এটার জন্য আলাদা করে সংবিধান সংস্কার পরিষদের প্রয়োজন নেই।
সংবিধান সংস্কার নিয়ে ২৭০ দিনের যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে, এমনটা এর আগে কোনো দেশে দেখা যায়নি। এটা থিওরেটিক্যালি যেমন সমস্যাজনক, তেমনি প্র্যাকটিক্যালিও অসম্ভব। সংবিধান নিয়ে আলাপ–আলোচনায় আমরা তো আগে থেকেই কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারি না। পার্লামেন্টে আলাপ–আলোচনার মধ্য দিয়েই এটা করতে হবে। সংবিধানটা কার্যকর করে কে? রাজনৈতিক দলগুলোই তো। তাহলে তাদের মধ্যকার আলাপ–আলোচনাকে কেন গুরুত্বহীন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে?
ঐকমত্য কমিশন সরকারকে যেভাবে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ, ২০২৫ জারির সুপারিশ করেছে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সংসদের অনুপস্থিতিতে সংবিধান অনুযায়ী সব ধরনের অধ্যাদেশ জারি হচ্ছে রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে। তাহলে জুলাই সনদ নিয়ে সরকার কীভাবে আলাদা করে আদেশ জারি করবে?
ভুলে গেলে চলবে না, বৈশিষ্ট্যগতভাবে অন্তর্বর্তী সরকার আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো। এই সরকার বর্তমান সংবিধানকেই তার বৈধতার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন বা আদেশের মাধ্যমে। এরপর সংসদের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি অনেকগুলো অধ্যাদেশ পাস করেছেন। জুলাই সনদকে যদি বৈধতা দেওয়ার প্রয়োজন হয়, সেটাও রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমেই দিতে হবে।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ দেখে মনে হয়েছে, যেকোনোভাবে সরকারের মাধ্যমে একটা আদেশ দিলে এবং সেটা গেজেট আকারে প্রকাশ করলেই তা আইন হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হবে না। সংসদ না থাকায় এটা অধ্যাদেশের মাধ্যমেই করতে হবে। আগামী সংসদের ওপর নির্ভর করবে তারা এই অধ্যাদেশটা রাখবে কি না। কিন্তু সুপারিশে এ বিষয়গুলো যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।