ভ্যাকসিনের যত প্রযুক্তি ও অনুমোদন প্রক্রিয়া : টাইফয়েড ভ্যাকসিন প্রসঙ্গ
ভ্যাকসিন আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম একটি আশির্বাদ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মধ্যে ভ্যাকসিনকে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে ভ্যাকসিনের কারণে পঞ্চাশ বছরে কমপক্ষে ১৫.৪ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে।
ভ্যাকসিনের যত প্রযুক্তি
এ পর্যন্ত ভ্যাকসিন তৈরিতে প্রধান ছয়টি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এগুলো হলো, লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড, ইনঅ্যাক্টিভেটেড, সাবইউনিট, টক্সয়েড, এমআরএনএ এবং ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন।
লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড ভ্যাকসিনে রোগের জন্য দায়ী জীবন্ত কিন্তু দুর্বল জীবাণু (ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া) ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের ভ্যাকসিনগুলো শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। তবে, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তাদের জন্য এটি উপযুক্ত নয়। হাম, মাম্পস, রুবেলা (MMR), জলবসন্ত (চিকেনপক্স) এবং রোটাভাইরাস ভ্যাকসিন এ প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি।
ইনঅ্যাক্টিভেটেড (নিষ্ক্রিয়) ভ্যাকসিনে তাপ, রাসায়নিক বা বিকিরণ দ্বারা মেরে ফেলা জীবাণু ব্যবহার করা হয়। ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত নিষ্ক্রিয় জীবাণু রোগ তৈরি করতে পারে না, কিন্তু শরীর এ নিষ্ক্রিয় জীবাণুগুলো সক্রিয় হিসেবে বিবেচনা করে এবং শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সাধারণত এ ধরনের ভ্যাকসিনের জন্য বুস্টার শট প্রয়োজন হয়। হেপাটাইটিস এ, পোলিও (ইনজেকশন) এবং বেশিরভাগ ফ্লু শট এ প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি।
টক্সয়েড ভ্যাকসিনে নিষ্ক্রিয় টক্সিন ব্যবহার করা হয়, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে টক্সিনকে প্রতিরোধ করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শেখায়। যেমন ডিপথেরিয়া এবং টিটেনাস ভ্যাকসিন এক প্রকারের টক্সয়েড ভ্যাকসিন।
সাবইউনিট, রিকম্বিন্যান্ট, পলিস্যাকারাইড এবং কনজুগেট ভ্যাকসিন ভ্যাকসিনে জীবাণুর একটি নির্দিষ্ট অংশ (যেমন প্রোটিন বা শর্করা) ব্যবহার করে। তাই এটি বেশ নিরাপদ প্রযুক্তি। হেপাটাইটিস বি, হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (HPV) এবং নতুন আবিষ্কৃত টাইফয়েড ভ্যাকসিন এ প্রযুক্তির মধ্যে পড়ে।
এমআরএনএ ভ্যাকসিন একটি অত্যাধুনিক নতুন প্রযুক্তির ভ্যাকসিন যেখানে মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) ব্যবহার করে কোষকে ভাইরাসের প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। এই প্রোটিন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে উৎসাহিত করে। ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন এ প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি।
ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিনও একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ভ্যাকসিন যাতে একটি নিরাপদ, পরিবর্তিত ভাইরাস (ভেক্টর) ব্যবহার করে জেনেটিক উপাদান কোষের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়, যা শরীরকে নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরি করতে শেখায়। অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন এবং ইবোলা ভ্যাকসিন এ প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি।
টাইফয়েড ভ্যাকসিনের বিভিন্ন প্রজন্ম এবং বাংলাদেশে টাইফয়েড ভ্যাকসিনের বাজার
প্রথম প্রজন্মের টাইফয়েড ভ্যাকসিনটি আবিষ্কৃত হয় ১৮৯৬ সালে। এটি ছিল ইনঅ্যাক্টিভেটেড (নিষ্ক্রিয়) প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। অর্থাৎ Salmonella Typhi ব্যাকটেরিয়াকে তাপ বা ফরমালিন দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে এটি তৈরি কার হতো। এটি কার্যকর হলেও তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন জ্বর, ব্যথা ও মাথাব্যথা সৃষ্টি করত এবং এর সুরক্ষা মাত্র ৩ বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
এরপর ১৯৮০-এর দশকে তৈরি হয় দ্বিতীয় প্রজন্মের টাইফয়েড ভ্যাকসিন যেটি ছিল সাব-ইউনিট পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন। এ প্রযুক্তিতে Salmonella Typhi ব্যাকটেরিয়ার কোষের বাইরে অবস্থিত ক্যাপসুল আবরণের ভিআই পলিস্যাকারাইড (Vi polysaccharide) অ্যান্টিজেন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
স্যানোফি পাস্তুর- এর Typhim Vi এবং গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন-এর Typherix ভ্যাকসিন ২য় প্রযুক্তির ভ্যাকসিন। বাংলাদেশের ইনসেপ্টা ফার্মার Vaxphoid ভ্যাকসিনটিও ভিআই পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন যেটির বাজারমূল্য ৫০০ টাকা। ভি-আই পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম, কিন্তু এটি ২ বছরের নিচের শিশুদের মধ্যে কার্যকর নয় এবং মাত্র ২-৩ বছর পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়।
টাইফয়েডের তৃতীয় প্রজন্মের ভ্যাকসিন হলো লাইভ-অ্যাটেনুয়েটেড ভ্যাকসিন Ty21a (Vivotif) যেহেতু মুখে খাওয়া যায়। এই ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে কম, কিন্তু এর অসুবিধা হলো এটি একাধিক ডোজে দিতে হয়, রেফ্রিজারেশনের প্রয়োজন হয় এবং ছয় বছরের নিচের শিশুদের জন্য উপযুক্ত নয়। এর ফলে ছয় মাস বয়স থেকে দেয়া যায় এবং দীর্ঘমেয়াদে কাজ করবে এমন কোন টাইফয়েড ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা জরুরি ছিল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- টিকাদান কর্মসূচি
- টাইফয়েড