গণভোটের ফাঁদে বিএনপি এবং নির্বাচন!
গণভোটের ফাঁদে আটকে গেছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই ফাঁদের ফস্কা গেরো বিএনপির জন্য এখন বজ্র আঁটুনিতে পরিণত হতে চলেছে। গণতন্ত্রের ‘পুনর্জন্ম’ ঘটাতে চাওয়া দলটিকে তাই গণভোট নামের মরীচিকার পেছনে ছুটতে হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনাও ফিকে হয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংস করে দুই মেয়াদে (২০১৪ ও ২০১৮) ক্ষমতায় থাকা। এরপরও ২০২৪ সালে আরেকটি নির্বাচনের নাটক সাজিয়ে আরও পাঁচ বছরের টিকিট কেটেও শেষরক্ষা করতে পারেনি। গণতন্ত্রের মৌলিক নিয়মটাই তারা এমনভাবে বদলে ফেলেছিল যেন নির্বাচন মানে ভোট নয়, বরং আমলাতন্ত্র আর পুলিশের তত্ত্বাবধানে ‘ক্ষমতা নবায়ন অনুষ্ঠান’। অর্থাৎ অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য-বিশ্বাসযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন—যা শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের একমাত্র উপায়—সেটিকেই যেন রাজনীতি থেকে নির্বাসন দণ্ডে পাঠানো হয়েছিল।
সংবিধান বলে, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। কিন্তু বাস্তবতা যেন বলছে, জনগণ মালিক নয়, বরং ‘মালিকানা হস্তান্তরিত’ হয়ে গেছে অন্য কোথাও—একটা নির্দিষ্ট কার্যালয়, দপ্তর বা দলে। এই জনগণকেই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেশে একপ্রকার আনঅফিসিয়ালি একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়েছিল—যেন ‘গণতন্ত্র’ নয়, ‘গণতন্ত্রায়িত কর্তৃত্ববাদ’। এটাই ছিল বিগত সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম ও প্রধান অভিযোগ, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
আর এ কারণেই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন নৃশংসতা শুরু করল, তার বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে আসল। যাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তারা হঠাৎ আবিষ্কার করল—রাষ্ট্রের ‘মালিক’ তারা শুধু সংবিধানের পাতায়। সেই মালিকানা ফিরিয়ে আনতে রাস্তাঘাট, মিলকারখানায় জ্বালাল ক্ষোভের আগুন। সংবিধান দেশের মানুষকে যে সকল ক্ষমতার মালিক বলে ঘোষণা দিয়েছে, সেই ক্ষমতার প্রয়োগ হয় কেবল ভোটের মধ্য দিয়ে। অতএব সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অর্থই হল জনগণের কাছ থেকে ক্ষমতার মালিকানা কেড়ে নেওয়া। দেড় দশক ধরে মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে জুলাই অভ্যুত্থানে।
অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হওয়ার পরে মানুষের মনে এই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে, এবার একটি নির্বাচিত সরকার আসবে যারা গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ শাসন করবে। দেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় ফিরবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত না হলেও অন্তত দুর্নীতি নিয়ন্ত্রিত হবে। মানুষের মনে স্বস্তি ও নিরাপত্তার বোধ তৈরি হবে। ট্যাগিংয়ের রাজনীতির অবসান হবে। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরে গত এক বছরে এর একটি স্বপ্নও পূরণ হয়েছে বা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটি জোর দিয়ে বলার সুযোগ আসেনি।
সবার আগে প্রয়োজন যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, সেই সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে কিনা, মানুষের মনে এই প্রশ্নও তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ গণভোটের তর্কে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনিশ্চিত পড়বে কিনা, জনপরিসরে এই আলোচনা জোরদার হচ্ছে। তাছাড়া অনেক দিন ধরেই এটা বলা হচ্ছে যে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর তথা একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ পরিচালিত হোক, এটি অনেকেই চায় না। বিশেষ করে যাদের জনসমর্থন কম। নির্বাচনে জয়ী হয়ে এককভাবে যাদের সরকার গঠনের সম্ভাবনা কম এবং নির্বাচন না হলে দেশে যে অস্থিরতা তৈরি হবে, সেই সুযোগে যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়, তারাও হয়তো নানা উসিলায় নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়। যদিও সবশেষ ৩১ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা নির্বাচনে জয়ী হলে সবাইকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে চান। সাধারণ মানুষ এবং রাজনীতি-সচেতন মানুষের অনেকেই এটা মনে করেন যে, দেশের বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণের একটি বড় উপায় হতে পারে জাতীয় সরকার। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য।
পরিতাপের বিষয় হল, প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিশনই ঐক্য স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। এই কমিশনে মাসের পর মাস আলোচনার মধ্য দিয়ে যে জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হল, সেই সনদই এখন অনৈক্যের উপলক্ষ্য হয়েছে। এই সনদ বাস্তবায়নে কমিশন যে সুপারিশ করেছে, সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে জামায়াত ও এনসিপির মতামত ও দাবির প্রতিফলন ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অথচ ঐকমত্য কমিশন কোনো এক বা একাধিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে না—এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু কমিশনের সুপারিশ স্পষ্টতই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। দেশের অন্যতম প্রধান ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এরই মধ্যে যে ভাষায় কমিশনের সমালোচনা করেছে, সেটি ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না। বরং ধীরে ধীরে পরিস্থিতি সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠবে বলেই অনেকের মনে ভয় তৈরি হচ্ছে।