 
                    
                    কে চায় নির্বাচন, কে চায় অচলাবস্থা?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও জমে উঠছে নির্বাচন পূর্ববর্তী উত্তেজনা। যেন একটি অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে—যেখানে প্রতিটি পক্ষ বলছে তারা গণতন্ত্রের পক্ষে, অথচ তাদের অবস্থান, বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে দেখা যাচ্ছে বিপরীত সংকেত। প্রধান উপদেষ্টা যখন আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন, ‘নির্বাচন বানচালের জন্য ভেতর থেকে, বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে’, তখনই অন্যপ্রান্তে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের মন্তব্য বলছেন, ‘কোনো কারণে তো সঠিক সময়ে নির্বাচন না-ও হতে পারে’। এই দুই বিপরীত বক্তব্য যেন দেশের মানুষকে এক গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে—আসলে কে চায় নির্বাচন, আর কে চায় অচলাবস্থা?
নির্বাচনের ফুল কবে ফুটবে—জনমনে যখন এই প্রশ্ন তখন সরকারের পক্ষ থেকে এখন দৃঢ় ঘোষণা আসছে, নির্ধারিত সময়েই ভোট হবে, যত বাধাই আসুক। কিন্তু অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি জামায়াত বলছে, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ ও সংস্কার প্রশ্নে গণভোট দিতে হবে।’ সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন আসতে পারে নির্বাচনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে হঠাৎ গণভোটের দাবি কেন? এটি কি সত্যিই গণতান্ত্রিক সংস্কারের উদ্যোগ, নাকি নির্বাচনের গতি শ্লথ করার একটি পরিকল্পিত কৌশল?
বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই উত্তেজনা, পথ অবরোধ, হরতাল, কখনও রক্তপাত। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। কারণ, এবার নির্বাচনের আয়োজন করছে একটি তত্ত্বাবধায়ক কাঠামো, যার নেতৃত্বে আছেন একজন প্রধান উপদেষ্টা, যিনি কার্যত সরকারের নির্বাহী প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি যখন বলেন, ‘ছোটখাটো না, বড় শক্তি নিয়ে বানচালের চেষ্টা হবে’, তখন স্পষ্ট হয়ে যায়, এটি কেবল রাজনৈতিক সতর্কবার্তা নয়—এর ভেতরে নিরাপত্তা, কূটনীতি ও ভূরাজনীতির সমীকরণও লুকিয়ে আছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনি রাজনীতি সবসময়ই দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। ভারতের কূটনৈতিক দৃষ্টি ও কৌশল যেমন দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে, তেমনি চীনের বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত প্রভাবও সমানভাবে উপস্থিত। আবার পশ্চিমা বিশ্ব—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন চায় এমন এক স্থিতিশীল বাংলাদেশ, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে এবং তাদের স্বার্থও সুরক্ষিত থাকবে। ফলে, যদি নির্বাচন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে, তার অভিঘাত শুধু রাজনৈতিক হবে না—অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অস্থিতিশীলতাও বাড়বে।
এই প্রেক্ষাপটে জামায়াত নেতা সৈয়দ তাহেরের বক্তব্য নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছেন, ‘কোনো কারণে তো সঠিক সময়ে নির্বাচন না-ও হতে পারে! তখনো তো জুলাই সনদ পাস করতে হবে।’ তার এই মন্তব্যে লুকিয়ে আছে একাধিক ইঙ্গিত। প্রথমত, তিনি যেন আগেভাগেই ধরে নিচ্ছেন, নির্বাচনের সময়সূচি ভেস্তে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সেই আশঙ্কাকে গণভোটের মতো নতুন ইস্যু দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা।
কিন্তু গণভোটের এই প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত? স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি গণভোট হয়েছে, এবং অধিকাংশই ছিল রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার। এখন আবার সেই ধারণা ফিরিয়ে আনার অর্থ কী? এটি মূলত একটি ট্যাকটিকাল মুভ—রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে মনোযোগ সরানোর প্রচেষ্টা।
জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে প্রান্তিক অবস্থানে ছিল। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর তারা আবার আলোচনায় ফিরে এসেছে। জাতীয় নির্বাচন হলে সেই প্রাসঙ্গিকতা দ্রুত হারিয়ে যেতে পারে—তাই গণভোট নামের নতুন ইস্যু সামনে এনে তারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখার পথ খুঁজছে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে দুটি শব্দ—‘ভেতরের শক্তি’ ও ‘বাইরের শক্তি’। ‘ভেতরের শক্তি’ বলতে বোঝানো হতে পারে সেই সব রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও স্বার্থান্বেষী মহলকে, যারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার চেয়ে অচলাবস্থাকে নিজেদের জন্য বেশি লাভজনক মনে করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতিবিদ, কেউ তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, আবার কেউ আছে যারা গণতন্ত্রের পক্ষে বলে দাবি করলেও আসলে গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
 
                    
                 
                    
                 
                    
                 
                    
                 
                    
                 
                    
                -68f7ebaa39de2-6903ee942e8e5.jpg) 
                    
                